২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টার্গেট আসলে বাংলাদেশ

-

গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর সাইন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে রাত ৯টার দিকে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে দুইজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। হামলার পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এগিয়ে এসেছে। ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন মহল বিভিন্ন ধরনের অনুসিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য ছুড়ছেন। কেউ বলছেন, এই আক্রমণের টার্গেট পুলিশ, কেউ বলছেন মন্ত্রী মহোদয়। আবার কেউ বলছেন, ‘আইএস’ এই হামলা চালিয়েছে। অন্যরা বলছেন, বাংলাদেশে গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর কাজ এটি। হামলাটা যার ওপরই হোক না কেন, মূল টার্গেট হলো আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
৩১ আগস্টের এই হামলার মতো নিকট অতীতে আরো বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে এর আগে। গত ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে ট্রাফিক পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা ছোড়া হয়। ২৬ মে মালিবাগে পুলিশের এসবি কার্যালয়ের সামনে একটি পিকআপে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এরপর ২৪ জুলাই ফার্মগেটের খামারবাড়ি ও পল্টন এলাকার পুলিশের দু’টি তল্লাশি চৌকির পাশ থেকে বোমাসদৃশ বস্তু উদ্ধার করা হয়েছিল। এর প্রতিটি ঘটনায় ‘আইএস’ দায় স্বীকার করেছে বলে আমরা মিডিয়া মারফত জানতে পেরেছি। কিন্তু সরকারি ভাষ্য মতে, বাংলাদেশে ‘আইএস’-এর অস্তিত্ব নেই বলে সবাই জানি। ৩১ আগস্টের সর্বশেষ ঘটনার পর সড়ক ও সেতুমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আইএস নেই।’ তিনি জানিয়েছেন, আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ আছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে (দৈনিক ডেইলি স্টার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। অন্য দিকে, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ৩১ আগস্টের হামলার সাথে আগের হামলাগুলোর ধারাবাহিকতার প্রমাণ মিলেছে। তাই তিনি এই হামলা ‘সুপরিকল্পিত’ বলে মন্তব্য করেছেন (দৈনিক প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)।
আলামত পর্যবেক্ষণে এটা সুস্পষ্ট যে, এই হামলাগুলো সুপরিকল্পিত এবং একই চক্রের ধারাবাহিক আক্রমণ। প্রশ্ন হলো, সেই অশুভ চক্রটি কারা? আমার মনে হয়, আক্রমণের ভয়াবহতার চেয়েও উদ্বেগজনক হলো এই চক্রকে চিহ্নিত করতে না পারা। এই সিরিজের প্রথম আক্রমণটি ঘটেছিল গত ২৯ এপ্রিল। সে ঘটনাটির তদন্ত অদ্যাবধি চলমান। কবে সম্পন্ন হবে সেটি বলতে না পারলেও ডিএমপি কমিশনার তদন্তে ‘অগ্রগতি হয়েছে’ বলে জানিয়েছেন। আশা করা যায়, তদন্ত সংস্থাগুলো যোগ্যতার সাথেই এগোচ্ছে। কিন্তু ব্যাধির কারণ জানতে না পারলে তো যথাযথ চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। কাজেই সেই ঘটনার উৎস বা চক্র সম্পর্কে যথাসময়ে জানতে পারলে আমাদের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটগুলো যোগ্যতার সাথেই পরবর্তী আক্রমণগুলো ঠেকাতে পারতেন অথবা Pre-empt করে আক্রমণের আগেই সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা তছনছ করে দিতে পারতেন। সুতরাং, এ ধরনের তদন্ত সময়সাপেক্ষ হলেও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে যতদ্রুত সম্ভব তা সম্পন্ন করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কারণ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সফলতা নির্ভর করে সন্ত্রাসী চক্রকে চিহ্নিত করে বা তাদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দেয়ার ওপর। এখানে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, আক্রমণগুলোর ধরন একই প্রকারের। ফলে তদন্তের ফলাফল পেতে যত দেরি হবে মানুষের মাঝে সন্দেহ, প্রশ্ন ও শঙ্কা ততই বাড়তে থাকবে। আমরা ইতোমধ্যে ‘আইএস’-এর নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা এবং সামর্থ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ‘আইএস’ এই হামলার দায় স্বীকার করলেও তাদের বর্বরতা বা নৃশংসতার প্রমাণ এসব হামলা বহন করে না। ‘আইএস’ বা যেকোনো জঙ্গিগোষ্ঠী সন্ত্রাসী হামলা চালায় সাধারণত নিরীহ মানুষের ওপর এবং তা দুটো কারণে : (ক) বিশ্বব্যাপী জানান দেয়া ও (খ) সাধারণ নাগরিকদের হতাশ বা ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা। এ জন্য তারা আক্রমণের ভয়াবহতার ওপরই জোর দেয়। অন্য দিকে ঢাকায় আক্রমণগুলো হয়েছে শুধু বিশেষ একটি বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে। কিন্তু আমাদের পুলিশ বাহিনীকে এ ধরনের বোমা ফাটিয়ে কি ভীতসন্ত্রস্ত করা সম্ভব? কারণ, তারা ২০১৬ সালের হোলে আর্টিজানের হামলায় বড় ক্ষয়ক্ষতি সামলিয়ে বীরত্বের সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং অত্যন্ত সফলভাবে ‘আইএস’-এর দেশীয় এজেন্টদের খাদে আটকে রেখেছে। কাজেই শুধু ‘আইএস’ বা ‘আলকায়েদা’ অথবা তাদের এ দেশীয় দোসরদের ওপর ফোকাস করলে হয়তো বা প্রকৃত আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব নাও হতে পারে। গত এক বছর দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যা অনেককেই হতাশ বা সংক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। কেউ কেউ সুযোগ বুঝে তাদের বিপথে ঠেলে দিতে পারে। এখানে কোনো Lone Wolf কিংবা সঙ্ঘবদ্ধ চক্র জড়িত থাকলে তা অবশ্যই আমাদের সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনীর জালে আটকা পড়ত। কারণ Lone Wolf সন্ত্রাসী সাধারণত ঘটনার পরপরই ধরা দেয় বা ধরা পড়ে। অন্য দিকে, আমাদের বিশেষ বাহিনীগুলোর কৌশলগত কারিগরি জাল দৃশ্যত এত শক্তিশালী যে, কোনো সঙ্ঘবদ্ধ দলের এর বাইরে থাকার সুযোগ নেই।
আমেরিকাভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স ‘আইএস’-এর দায় স্বীকারের কথা প্রকাশ করেছে। অন্য দিকে, আমাদের মন্ত্রী এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘আইএস’-এর উপস্থিতি বা তৎপরতা ‘বাংলাদেশে নেই’ বলে নিশ্চিত করেছেন। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, হামলাকারী চক্রটি ‘আইএস’-এর নাম ব্যবহার করে থাকতে পারে। তিনি আরো আশঙ্কা করছেন, এই ছোট ছোট হামলা কোনো বড় হামলার আলামত কি না! ‘তার এই আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের আরো বড় কোনো হামলার পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করতে প্রস্তুত করবে বলে আশা করা যায়। এমতাবস্থায় আমাদের এখন সর্বপ্রথম কর্তব্য হলোÑ হামলাকারী চক্রকে খুঁজে বের করা। আমাদের দেশে ‘আইএস’ নেই তা প্রমাণ করার জন্য হামলাকারী চিহ্নিত করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ ধরনের হামলা রোধের জন্যও তা অপরিহার্য। এটা বা এগুলো যে ‘আইএস’-এর হামলা নয় তা বোঝা যায়। ‘আইএস’ এসব ক্ষুদ্র আক্রমণ করে তার কুখ্যাতি কমাতে চাইবে না অবশ্যই। হামলার ধরন চিন্তা করলে বলা যায়, এগুলো ‘হোম গ্রোন’ বিপথগামীদের কার্যকলাপ। গত তিন-চারটি সিরিজ হামলার সবই কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের ওপর হয়েছে, যা কিনা অত্যন্ত সহজ ও সস্তা টার্গেট ছিল। এতে ভয়াবহ কিছু না হলেও অন্তত innocent foot soldier ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যারা কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ধরপাকড় কিংবা বল প্রয়োগ করার মতো ফৌজদারি অপরাধবিরোধী কার্যকলাপে সংশ্লিষ্ট নেই। উপরন্তু তারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণমূলক জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত থাকাকালে তাদের একেবারে সহজলভ্য টার্গেট বানানো হয়েছে। কারা এই কাপুরুষোচিত হামলাগুলো করছে এবং কেনই বা করছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা রাজপথে পারেনি, তারা পুলিশের মনোবল ভাঙতে চায়।’ প্রশ্ন হলো, পুলিশের মনোবল কি এতই ঠুনকো যে, দু-একজন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য আহত হলে তা ভেঙে যাবে? আইজিপি বলেছেন, ‘কিছু হলেই ধরা পড়ে, তাই পুলিশকে শত্রু মনে করছে।’ পুলিশকে কখনো কখনো কেউ শত্রু মনে করতে পারে। কিন্তু এগুলো কোনোভাবেই শত্রু নিধনের হামলা নয়। তা ছাড়া ধরা পড়ার ভয় তো আছে। দেশের মানুষের কেউ কেউ পুলিশের প্রতি কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু পুলিশকে শত্রু মনে করার মতো অবস্থা নেই। র্যাব মহাপরিচালক বলেছেন, ‘নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টার্গেট’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। আমাদের বুঝতে হবে, তখন এ বিষয়ে টার্গেট হতে পারে পুলিশের বিশেষ বাহিনীর (CTTC, ATU, CID, PBI, SB, DB, RAB) সদস্যরা, কিন্তু তা না হয়ে ট্রাফিক পুলিশ কেন? এ প্রশ্নের উত্তরটাকে এত সরলীকরণ করে দিলে জঙ্গিবাদকে মূলত আরো উসকে দেয়া হবে। তা ছাড়া, খুব সহজেই সরকারবিরোধী মহলকেও এর জন্য দোষারোপ করা যাবে। কিন্তু লাভবান হবে অশুভ চক্রটিই। কারণ, এতে শুধু আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক বিভাজনের রেখাটি আরো প্রশস্তই হবে। অন্য দিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির আগেই অনুসিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য করলে তদন্ত প্রভাবিত হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ ধরনের মন্তব্য তদন্তে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সব দিক মাথায় রেখে এগোবার সুযোগ সঙ্কুচিত করে ফেলে। ফলে প্রকৃত সন্ত্রাসী বা নেপথ্যের কুশীলবরা পার পেয়ে যেতে পারে। কাজেই কর্তৃপক্ষের চিন্তায় যা আছে তা সহ সব সম্ভাবনাকেই সন্দেহের জালে আবদ্ধ করতে হবে। ভাবতে হবে দেশী-বিদেশী সব সম্ভাব্য চক্রের ব্যাপারে এবং সজাগ থাকতে হবে উগ্রতা ছড়ানোর অন্যান্য উপাদান সম্পর্কেও। ‘আইএস’ নিজের শক্ত ঘাঁটিতেই পরাজিত হয়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক একেবারে ছিন্নভিন্ন প্রায়। এ দিকে, গত এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় তারা স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে বলে প্রতীয়মান। অন্য দিকে, রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন হতাশা সৃষ্টি করছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে। সর্বশেষ কাশ্মির ইস্যু এবং আসামের চলমান ঘজঈ ইস্যু জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে আশঙ্কা ও হতাশা সৃষ্টি করছে বলে অনেকে মনে করেন। এরই মধ্যে আমাদের এখানে একাধিক ভিনদেশী সংস্থা গোপনে তৎপর বলে জনশ্রুতিও রয়েছে। অন্য দিকে, দেশের সরকারের বিরোধী মহল অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় কোনো রকমে টিকে আছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতৃত্বের শূন্যতা, সিদ্ধান্তহীনতা আর দল ভাঙার আশঙ্কা ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। এসব বিষয় মাথায় রেখেই এ সিরিজ হামলার সুগভীর তদন্ত করা তাই বাস্তবতার দাবি।
সার্বিক বিবেচনা করে আমাদের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত, দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে প্রকৃত সন্ত্রাসীকে এবং এর পেছনের কুশীলবদের খুঁজে বের করা। আর এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্তব্য করা থেকে তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত বিরত থাকা। কেননা, এতে সন্ত্রাসীরাই ফায়দা হাসিল করার সুযোগ পায়। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, এই হামলার টার্গেট নিছক পুলিশ নয়, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এই দেশ আমাদের, পুলিশ বাহিনীও আমাদের। তবে সন্ত্রাসী চক্র আমাদের কেউ নয়। তাদের কোনো দেশ আর ধর্ম নেই। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement