১৫ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সাংবাদিক নির্যাতন : নিরাপত্তার দায় কার?

-


প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা, প্রতিটি সরকারের সময়; সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনো শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, কখনো শিকার হচ্ছেন হয়রানির। কখনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে, কখনো রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়গ। হামলা, মামলা, আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন। সম্প্রতি সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহকালে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলে লাইভ ও সংবাদ প্রচারের ওপর বিধিনিষিধ আরোপের বিষয়টি রীতিমতো অশনি সঙ্কেত। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জিগাতলায় সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তোলার সময় মারধর করে থানায় নিয়ে চার ঘণ্টা আটকে রাখা হয় এবং তাদের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। একই পত্রিকার আরেক সাংবাদিক সুস্মিতা সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে লাঞ্ছিত হন সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে। ধানমন্ডিতে পুলিশের সামনে ধরে ধরে সাংবাদিকদের পিটিয়েছে হেলমেট পরা যুবকেরা। এ ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমের আরো অন্তত চারজন সাংবাদিক চলমান আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহে আহত হয়েছেন। এর আগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোর স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়। ফটোজার্নালিস্ট ও দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আলমের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে গুজব ও উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায় আবার সাত দিনের রিমান্ডও দিয়েছেন আদালত।
গণমাধ্যমের এ আক্রান্ত অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র যে রুগ্নতম সময় পার করছে তা অনুমেয়। কেননা, গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র অবস্থানের দিক থেকে একই সুতোয় গাঁথা। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করলেও পুলিশি নির্যাতনেরও শিকার হতে হয় সংবাদকর্মীদের। যদিও উভয়েই ঝুঁঁকির মধ্যে কাজ করেন। কিন্তু রাজপথে, বিপজ্জনক মুহূর্তে মাঝে মধ্যে পুলিশই হয় সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ। পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতির ঝাল মেটান সাংবাদিকদের ওপর। পরে ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো মৌখিক দুঃখ প্রকাশও করেন। এটুকুতেই প্রতিকারের সমাপ্তি। একইভাবে রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকের সম্পর্ককে আখ্যায়িত করা হয়Ñ পানি ও মাছের সম্পর্কে। কিন্তু যতই বস্তুনিষ্ঠ হোক, নিজের বা নিজ গ্রুপের বিপক্ষে গেলেই প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন রাজনীতিবিদেরাও। তারাও হুমকি-ধামকি দেন, কর্মক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে সাংবাদিকদের ‘উপহার’ দেন বেকারত্ব। নিজস্ব সুবিধাবাদীদের দিয়ে মামলায় জড়িয়ে দেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। আমলারা করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা হয়রানি। সাংবাদিকতার নৈতিকতায় সাংবাদিকেরা কারো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু হতে পারেন না। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হয়। ফলে সাংবাদিকেরা হয়ে পড়েন অপছন্দের পাত্র। তাদের গলা টিপে ধরতে সচেষ্ট হয় সবাই। অথচ অপছন্দের কথাগুলো তুলে ধরতে হয় দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের সময়ই সাংবাদিকদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবাদিকেরা নির্যাতিত হচ্ছেন তাই নয়, স্বার্থান্ধ রাজনীতিবিদদের ক্যাডার ও সন্ত্রাসী চরমপন্থীদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, এমনকি খুন হচ্ছেন সাংবাদিকেরা।
প্রত্যেক সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সব সরকারই থাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখ প্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
প্রতিদিন সংবাদপিপাসু মানুষের দ্বারে নতুন নতুন খবর নিয়ে হাজির হন সাংবাদিকেরা। তাদের লেখনি বা সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে সকালে চায়ের কাপে ঝড় থেকে শুরু করে মানুষ সুফল পেতে শুরু করেন। নির্যাতিত মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে সাংবাদিকদের দারস্থ হন। আর সাংবাদিকেরা জাতির সামনে তুলে ধরেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতার কথা। কিন্তু সেই সাংবাদিক যখন নির্যাতিত হন, তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজো আমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে এই পৈশাচিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার দাবি করতে হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিচার না হলে সাহসী সাংবাদিক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে না আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। তাই সরকার, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন, সুষ্ঠু বিচার, প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থা গ্রহণের। সাংবাদিকদের পেশায় এ চলমান ঝুঁঁকি কমাতে রাষ্ট্র কি কোনো উদ্যোগ নেবে? দূর ভবিষ্যতে কি কোনো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে? হ
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 


আরো সংবাদ



premium cement