২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
স্টাডি গ্রুপের আলোচনায় অভিমত

আফগানিস্তান সম্পর্কে নিজ স্বার্থ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঢাকাকে

আফগানিস্তান সম্পর্কে নিজ স্বার্থ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঢাকাকে - ছবি : নয়া দিগন্ত

‘আফগানিস্তানে তালেবান সরকার : চ্যালেঞ্জ ও আঞ্চলিক প্রভাব’বিষয়ক এক ওয়েবিনারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, তালেবান শরিয়া আইনের অনুসারী হলেও আফগানিস্তানে এবারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জাতীয়তাবাদী চেতনা কাজ করেছে। এটা ধর্মযুদ্ধ ছিল না। লড়াইটা ছিল বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। নতুন তালেবান সরকারকে জনগণের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখন কট্টরপন্থা নয়, বরং ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতা দেখাতে হবে। আর আফগান সরকারের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এই ওয়েবিনারে আরো বলা হয়েছে, তালেবানের উত্থানের কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আফগানিস্তানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ না হলেও বাংলাদেশের উগ্রবাদী দল বা মতাদর্শের গোষ্ঠীগুলো তালেবানের উত্থানকে আদর্শিক বাতিঘর হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে হোলে আর্টিজানের সন্ত্রাসী ঘটনার পর বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উচ্চ মাত্রার সতর্কতার কারণে এ সব গোষ্ঠী সফল হবে না। এছাড়া বাংলাদেশে আলেম-ওলেমারা সচেতন বলেই এখানে উগ্রবাদের প্রসার অতীতে ঘটেনি, ভবিষ্যতেও এ ধরনের যে কোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।

বুধবার স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স ‘আফগানিস্তানে তালেবান সরকার : চ্যালেঞ্জ ও আঞ্চলিক প্রভাব’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এতে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ছাড়াও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মোবিন চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল অব: মুনিরুজ্জামান, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন ও ইসলামি ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফায়েজুল্লাহ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আয়োজক সংস্থার প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক আমির খসরু।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আফগানিস্তানে এবারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জাতীয়তাবাদী চেতনা কাজ করেছে। লড়াইটা ছিল বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। নতুন তালেবান সরকারকে জনগণের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখন কট্টরপন্থা নয়, বরং ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতা দেখাতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে আফগানিস্তানের মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। আফগানিস্তানকে সহায়তায় জন্য তহবিল গঠনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জাতিসঙ্ঘ ১২০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। আফগান জনগণের দুর্ভোগ লাঘবকেই এখন গুরুত্ব দিতে হবে।

মেজর জেনারেল অব: মুনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের ওপর আফগানিস্তানের প্রভাব অনেক আগে থেকেই রয়ে গেছে। আফগানিস্তানে জিহাদ করে আসা মানুষদের হাত ধরেই বাংলাদেশে চরমপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশে এসব গোষ্ঠীর পুরুজ্জীবিত হয়ে উঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, তালেবানের উত্থানের কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই কারণে এ সব কর্মকাণ্ডের ওপর আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আফগানিস্তানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ না হলেও বাংলাদেশের উগ্রবাদী দল বা মতাদর্শের গোষ্ঠিগুলো তালেবানের উত্থানকে আদর্শিক বাতিঘর হিসাবে বিবেচনা করছে।

মুনিরুজ্জামান বলেন, তালেবানের ক্ষমতা দখলের আঞ্চলিক প্রভাব ও মেরুকরণের লক্ষণগুলো বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। আফগানিস্তানে ক্ষমতা তালেবানের হাতে আসায় এ অঞ্চলে সবচেয়ে লাভবান হতে যাচ্ছে পাকিস্তান। আফগান পরিস্থিতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও প্রভাব বিস্তার করতে পাকিস্তান সক্ষম। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। গত সপ্তাহে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আফগানিস্তান সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক দেশগুলোর গোয়েন্দা প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেছে। এতে চীন, রাশিয়া ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো যোগ দিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, আঞ্চলিক দেশগুলোর গোয়েন্দা কার্যক্রমের কেন্দ্রে চলে আসার জন্য পাকিস্তান পদক্ষেপ নিচ্ছে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার পর সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে চীন সচেষ্ট। আফগানিস্তানে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রমাণিত খনিজ সম্পদের প্রতিও চীনের দৃষ্টি রয়েছে। এ সব নিয়ে আফগান সরকারের সাথে চীন ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে।

১/১১-এ আল-কায়দার সন্ত্রাসবাদী হামলার পর আফগানিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন অনৈতিক ছিল বলে মন্তব্য করে শমসের মোবিন চৌধুরী বলেন, তালেবানকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে আফগানিস্তানে বসানো সরকার নৈতিকভাবে বেশ দুর্বল ছিল। বিশেষ করে আশরাফ গনি সরকারের আমলে প্রশাসনে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আর রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের এই নৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর তালেবান বিদ্যুৎ গতিতে রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়, যা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। তবে আগের আমলের মতো তালেবানের মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা ভালো ফল বয়ে আনবে না। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তালেবানের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের কারণে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশের এ ধরনের মতাদর্শী গোষ্ঠিগুলো নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। তবে আমার মতে, এতে তারা সফল হবে না। কেননা আইএসের মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পাঁচ বছর আগে রাজধানীর হোলে আর্টিজানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটানোর পর বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো উচ্চ মাত্রার সতর্কতায় রয়েছে। এটা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (১/১১) যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়দার সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের মতোই বাংলাদেশের জন্য জেগে উঠার সঙ্কত ছিল। হোলে আর্টিজানের ঘটনার আগে বাংলাদেশের প্রশাসনেরও চরমপস্থীদের ভয়াবহ আক্রমনের ক্ষমতা সম্পর্কে এক ধরনের অস্বীকৃতির মনোভাব কাজ করত।

তিনি বলেন, কট্টর শরিয়া আইন প্রয়োগের আগের মতাদর্শ থেকে তালেবান কতটা সরে আসে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান সরকারের যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে তার ইঙ্গিত খুব একটা ভালো না। কেননা আফগানিস্তান অনেক গোত্রের দেশ। তালেবান এক্ষেত্রে শুধু পশতুনদের প্রাধান্য দিলে আফগান যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এটা বলা যাবে না। অন্য গোত্রদের বাদ দিয়ে তালেবান এককভাবে কিছু করতে গেলে সামনে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের কারণে আফগানিস্তানের জন্য আরো দুর্ভোগ অপেক্ষা করবে।

আফগানিস্তানে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিজয়ে পুরো বিশ্বে মুসলমানরা উচ্ছ্বাস ও তৃপ্তিবোধ করছে উল্লেখ করে মুফতি ফায়েজুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকা তালেবানের মধ্যে কঠোরতা ছিল। বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে ভিন্ন হবে বলে তালেবান নেতৃবৃন্দ ঘোষণা দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তালেবান নারী অধিকারকে সমুন্নত রেখে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী ইনসাফ ও উদারনীতি গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চায় বলে জানিয়েছে।

তিনি বলেন, তালেবানের বিজয়ে উজ্জীবিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের চিন্তা বাংলাদেশে কেউ করছে বলে মনে হয় না। আর যদি কেউ এ ধরনের কোনো চিন্তা করেও থাকে, তবে তারা ক্ষুদ্র কোনো গোষ্ঠী হতে পারে। বাংলাদেশে আলেম-ওলেমা সচেতন বলেই এখানে উগ্রবাদের প্রসার অতীতে ঘটেনি, ভবিষ্যতেও এ ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।


আরো সংবাদ



premium cement