২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একজন মোস্তফা এবং পল্লী নিবাসে এরশাদের সমাধির গল্প

এরশাদকে রংপুরে সমাহিত করার আন্দোলন এবং (ইনসেটে) এরশাদের লাশ বহন করা গাড়িতে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা (টুপি পরিহিত) - - নয়া দিগন্ত ফাইল ছবি

সাবেক প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সমাধি সিদ্ধান্তকৃত রাজধানীর বনানী কবরস্থানের পরিবর্তে রংপুরের পল্লী নিবাসে হওয়ার ব্যাপারে একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন দেখেছে দেশবাসী। এই আন্দোলনের রূপকার হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত হয়ে এখন আলোচনায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, মহানগর সভাপতি ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।

তার নেতৃত্বে লাখো জনতার নজীরবিহীন বিক্ষোভ ও অংশগ্রহণে রংপুরেই সমাহিত হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ। ২০১৯ সালের ৮ জুলাই মাত্র ১৫ মিনিটের একটি জরুরি বৈঠকের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে জনসমক্ষে এই দাবি এনেছিলেন মোস্তফা। পরবতীতে ১৯২ ঘণ্টায় সেটি গণদাবিতে পরিণত হয়ে সফলতা পায়। এই দাবি আদায়ে রয়েছে মোস্তফা এবং উত্তরাঞ্চল জাতীয় পার্টি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের শ্বাসরুদ্ধকর গল্প।

আট জুলাই ২০১৯। দুপুর। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল তখন। রংপুর সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে নামতেই এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাকের। তিনি জরুরি মিটিং আছে বলে মেয়র মোস্তফার রুমে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৫ মিনিটের একটি জরুরি বৈঠক হলো। প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফার সভাপতিত্বে এসময় উপস্থিত থাকলেন জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি আজমল হোসেন লেবু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক ও শাফিউল ইসলাম শাফি, মহানগর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুজ্জামান নাজিম, জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মুন্সি আব্দুল বারী, মহানগর দপ্তর সম্পাদক জাহিদ হোসেন লুসিড, জেলা জাতীয় সমাজের যুগ্ম আহবায়ক আল-আমীন সুমনসহ জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন স্তরের জনা কুড়ি খানেক নেতাকর্মী। মোস্তফার কাছে ওপরের নেতৃবৃন্দ এরশাদকে রংপুরের পল্লী নিবাসে সমাহিতের দাবি জানিয়ে যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য দিলেন। পান চিবুতে চিবুতে মোস্তফা সব নেতার বক্তব্য শুনলেন। সভাপতির বক্তব্যে মোস্তফা দাবির প্রতি একমত পোষণ করে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দিলেন।

বৈঠক শেষে সন্ধ্যা ৬টায় পার্টি অফিসে জরুরি সংবাদ সম্মেলনের জন্য প্রচারণা করা হলো। লিখিত বক্তব্য ও ব্যানার তৈরি করা হলো। এরই মধ্যে রংপুর বিভাগের সকল জেলা ও মহানগর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করলেন মেয়র মোস্তফা। রংপুর বিভাগ, জেলা ও মহানগরসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহাসিক সেই সংবাদ সম্মেলন।

এরশাদকে পল্লী নিবাসেই সমাহিত করার দাবি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র মোস্তফা বললেন, প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মে পৃথিবী থেকে চলে গেলে আমাদের রাজনৈতিক পিতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি মহোদয়কে তার ওছিয়তকৃত স্থান পল্লী নিবাসেই সমাহিত করতে হবে। কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ঢাকায় খোলা স্পেসে তাকে সমাহিত করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমরা এরশাদের দেয়া জাতীয় তিন নেতার মাজারের পাশে অথবা সংসদ ভবনের পাশে আসাদ গেট এলাকায় মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কবরের পাশে জায়গার জন্য সরকারকে বলেছি। কিন্তু সে ব্যপারে আমাদের কোনো আশ্বাস দেয়া হয়নি। মোহাম্মদপুর কবরস্থানে সেই এলাকার মেয়র মাত্র একটি কবরের জায়গা দেয়ার জন্য রাজি হয়েছেন। এরশাদকে সেখানে সমাহিত করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। ক্যান্টনমেন্টে এরশাদকে সমাহিত করা হলে আমরা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা তার কবরও জিয়ারত করতে পারবো না। সেকারণে তার সমাধি রংপুরের মাটিতে নিজের গড়া পল্লী নিবাসেই হতে হবে। অন্য কোথাও আমরা স্যারের কবর মানবো না। অন্য কোথাও দেয়ার চিন্তা করা হলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিহত করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে রংপুরে কর্মরত অনেক গণমাধ্যম উপস্থিত থাকলেও প্রায় অর্ধেক গণমাধ্যমেই খবরটি সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসেনি। অনেক রিপোর্টারদের কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয়েছে এখনও এরশাদ মারাই যায়নি, তাহলে কবরের দাবি নিয়ে কেন আন্দোলন। কিন্তু এক দিন পর গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষরাও দাবিটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার ও প্রকাশ করতে থাকে। ঢাকা থেকে ১৬ জুলাই সমাধির ব্যপারে ঢাকায় করায় সিদ্ধান্তের কথা বলা হলে স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ইতোমধ্যেই পল্লী নিবাসে সমাহিতের দাবি রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের গণদাবিতে পরিণত হয়।

চৌদ্দ জুলাই, ২০১৯। রোববার সকাল পৌণে ৮টায় এরশাদ মারা যাওয়ার খবর ব্রেকিং নিউজের চাংকে স্থান পায়। সাথে সাথে তাকে রংপুরের ওসিয়তকৃত পল্লী নিবাসে সমাহিত করার দাবিতে একাট্টা হয়ে মাঠে নামেন নেতাকর্মীরা।

ওই সন্ধ্যায় আবারো সংবাদ সম্মেলন করেন সিটি মেয়র মোস্তফা। এবার তিনি দাবি আদায়ের ব্যপারে আরো কঠোর ঘোষণা দেন। বলেন, রক্তের বিনিময়ে হলেও স্যারের সমাধি তার ওছিয়তকৃত পল্লীনিবাসে দিতে হবে। সেদিন ঢাকা থেকে আসা মহানগর সেক্রেটারি এসএম ইয়াসিরও উপস্থিত হন সংবাদ সম্মেলনে। দাবি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি লাশ রংপুরে জানাজা ও দাফনের প্রস্তুতিও চলতে থাকে। পরের দিন সোমবার দুপুরে (১৫ জুলাই, ২০১৯) দলীয় কার্যালয়ে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগীয় নেতৃবৃন্দের জরুরি যৌথসভা ডাকেন মোস্তফা। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে আবারো এরশাদকে পল্লী নিবাসে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়।

যৌথসভা শেষে আবারো প্রেস ব্রিফিংয়ে আসেন মেয়র মোস্তফা। তিনি যেকোনো মূল্যে পল্লী নিবাসে সমাধির ঘোষণা দিয়ে বলেন, বনানী কবরস্থানে সমাধি দেয়ার মাধ্যমে তাকে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে যদি জাতীয় নেতার মর্যাদা দিয়ে ঢাকায় আমাদের প্রস্তাবিত খোলা স্পেসে সমাধি দেয়া হতো, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু যেহেতু তা করা হচ্ছে না, সেকারণে রংপুরেই তাকে সমাহিত করতে হবে।

এ সংবাদ সম্মেলনে মোস্তফা দাবির ব্যাপারে আরো যুক্তি তুলে ধরে বলেন, এরশাদ স্যার বেঁচে থাকতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সব সময় তাকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। মুক্তভাবে তাকে রাজনীতি করতে দেয়া হয়নি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে স্যার সেটি বলে গেছেন। বাংলাদেশের মানুষ তার সাক্ষী। তার মৃত্যুর পরেও তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। তাকে শৃঙ্খলিত জায়গায় সমাধি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

মোস্তফা ঘোষণা দিয়ে বলেন, এরশাদের সুসময় ও দুঃসময় রংপুরের মানুষ ঢাল হয়ে তার পাশে থেকেছে। তাকে ভালোবেসেছে। তাকে জেলে থেকে দুই বারসহ পাঁচ বার এমপি নির্বাচিত করে সম্মানিত করেছে। এরশাদের জীবদ্দশায় তার বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে, রংপুরের মানুষ পিনপতন নীরবতায় নজীরবিহীন আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিহত করছে। তার লাশ রংপুরের পল্লী নিবাসে সমাহিত করার ব্যাপারে যদি কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা বাধা দেয়া হয়, তাহলে আগের মতোই কঠোর প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আমাদের প্রিয় নেতাকে তার পল্লী নিবাসেই সমাহিত করা হবে।

এরপর ওইদিন বেলা ৩টায় এরশাদের পল্লী নিবাস ক্যাম্পাসের ভেতরে গড়া বাবা মকবুল হোসেন মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক হাসপাতলের লিচু বাগানের উত্তর-পূর্ব পাশে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে নিজ হাতে কবর খনন শুরু করেন। পরে কবরটি পুরোপুরি খনন করেন নগরীর দর্শনা মোড় এলাকার জাতীয় পার্টি কর্মী মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, কামাল ও সৈয়দ আলী, বিনোদপুরের নয়া মিয়া এবং বালাপাড়া এলাকার জাকির হোসেন ও সবুজ আহমেদ। সোমবার রাত পৌনে ৮টায় কবর খনন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। রাত সোয়া ১০টায় খননকৃত কবর পরিদর্শন শেষে আবারো গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন মোস্তফা।

এবার তিনি আরো শক্তভাবে দাবি আদায়ের পক্ষে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ও তিন বাহিনী প্রধানের কাছে রংপুরে এরশাদের সমাধি দেয়ার ব্যপারে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী রংপুরের গৃহবধূ, তিনি রংপুরের নাড়ীর টান বুঝবেন। এরশাদকে রংপুরে সমাহিত করার ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন। সেনাবাহিনীর প্রধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেছিলেন সেনাবাহিনীর সাথে যেমন এরশাদের আত্মার টান আছে, তার থেকেও বেশি টান আছে রংপুরের মানুষের। তাকে যখন জেলে রেখে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তখন তাকে পাঁচটি আসনে নির্বাচিত করে ভালোবাসা জানিয়েছিলেন রংপুরের মানুষ। গত নির্বাচনেও তিনি এক দিনের জন্য রংপুরে আসেননি। তবুও তাকে রংপুরের মানুষ বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে। তার দুঃসময়ে এবং সুসময়ে রংপুরের মানুষ পাশে ছিল এবং তিনিও রংপুরের মানুষের পাশে ছিলেন। এরশাদকে নিয়ে জীবিত অবস্থায় যেমন ষড়যন্ত্র হয়েছে, মৃত্যুর পরও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এরশাদকে পল্লী নিবাসে দাফনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করেন।

এরশাদের মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকেই দেশের প্রতিটি গণমাধ্যম মোস্তফার নেতৃত্বে গড়ে উঠা রংপুরের মানুষের দাবিটিকে ব্যাপক ফলাও করে প্রচার করতে থাকে। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই, ২০১৯) সকালে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকায় বনানীতে কবরস্থ করার ঘোষণা আসার পর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। তারা মোস্তফার নেতৃত্বে লাশ আসলে জীবন দিয়ে হলেও পল্লী নিবাসে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। সেকারণেই মঙ্গলবার ১২টা ১৪ মিনিটে লাশ কালেক্টরেট মাঠে আসার সাথে সাথেই লাশকে ঘিরে রেখে শুরু হয় বিক্ষোভ। সাথে চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ততা। বিক্ষোভ আরো বেড়ে গেলে বেলা ২টায় হাতে মাইক নিয়ে মোস্তফা ঘোষণা দেন, স্যারের লাশ আমাদের কাছে আছে। কেউ লাশ নিয়ে যেতে পারবে না। রক্তের বিনিময়ে হলেও পল্লী নিবাসেই স্যারের সমাধি আমরা করবো।

এভাবে বিক্ষোভ আর ফুলেল ভালোবাসার মুখে বেলা ২টায় জানাজা নামাজের প্রস্তুতি শুরু হয়। জানাজার প্রস্তুতির মধ্যে বক্তব্য রাখেন এরশাদপুত্র রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এসময় লাখো জনতা সেখানে বিক্ষোভ করতে থাকে এবং রংপুরে সমাধি চাই দাবি তোলে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলে চরম উত্তেজনা। সেখানে আন্দোলনকারী কয়েকজন নিগৃহীত হন। মঞ্চের মধ্যে উত্তেজনা বেশি ছড়িয়ে পড়লে মেয়র মোস্তফা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কাছ থেকে মাইক নিয়ে ঘোষণা দেন, স্যারের সমাধি পল্লী নিবাসেই হবে। জানাজার প্রস্তুতি নিন। এরপর ২টা ২৭ মিনিটে শুরু হয় জানাজা। ইমামতি করেন রংপুর করিমিয়া নুরুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইদ্রিস আলী। জানাজা নামাজ শেষে আবারো লাশের গাড়িকে ঘিরে বিক্ষোভ করতে থাকে।

এরই মধ্যে এক পর্যায়ে বেলা ২টা ২৭ মিনিটে লাশের গাড়ির ড্রাইভার আব্দুর রহিমকে টেনে নামিয়ে দিয়ে নিজেই স্টিয়ারিংয়ে বসে পড়েন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। অপরদিক থেকে এরশাদের ব্যক্তিগত ড্রাইভার বাদশাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে উঠে পড়েন মহানগর সেক্রেটারি এসএম ইয়াসির। পরে ড্রাইভার রহিমকে তুলে নেন মোস্তফা। এরইমধ্যে রোল পড়ে যায় লাশ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। বিক্ষোভ আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে নিজেই ড্রাইভ করে গাড়ি চালিয়ে মাঠের পূর্ব দিক দিয়ে রওনা দেন মেয়র মোস্তফা।

এসময় বিক্ষুব্ধ জনতাকে আশ্বস্ত করতে মহানগর সেক্রেটারি লাশের গাড়ি থেকে মাইকে বারবার ঘোষণা দিতে থাকেন লাশের গাড়িতে মোস্তফা ভাই আছেন। আমরা পল্লী নিবাসে যাচ্ছি। আপনার শান্ত হন। তারপরেও হাজার হাজার জনতা গাড়ির সামনে পেছনে স্লোগান দিতে থাকে। লাশের গাড়ি এগুতে থাকে অতি ধীরে। লাশ ডিসির মোড় হয়ে যাওয়ার কথা থাকায় চেকপোস্ট পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে প্রশাসন। কিন্তু মোস্তফা নিজে গাড়ি চালিয়ে সিটি করপোরেশনের দিকে ঘুড়িয়ে পথ চলা শুরু করেন।

লাশের গাড়ি যখন সিটি করপোরেশনের সামনে। ঠিক তখনই জিএম কাদের সাংবাদিকদের জানান, আমিও চেয়েছিলাম রংপুরের হোক ভাইয়ের সমাধি। কিন্তু ভাবীসহ অন্যরা ঢাকায় হওয়ার পক্ষে ছিল। রংপুরের মানুষের ভালোবাসার বিষয়টি আমি সাথে সাথে ভাবি রওশন এরশাদকে জানাই। তিনিও রংপুরে দাফনের অনুমতি দেন এবং কবরের পাশে তার জায়গা রাখার কথা বলেন।

মুহূর্তেই তা ব্রেকিং নিউজের চাংকে স্থান পায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটি বিশ্বাস করছিলেন না। সেকারণে এরশাদের লাশ বহনকারী লাশটির সামনে পিছনে বিক্ষোভ চলতেই থাকে। ধীরে ধীরে এগুতে থাকে গাড়ি। পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, শাপলা, খামার মোড় লালবাগ কলেজপাড়া দর্শনা হয়ে পল্লী নিবাসে গিয়ে লাশের গাড়ি পৌঁছায় বিকেলে ৪টা ৪৭ মিনিট। পল্লী নিবাসে গিয়ে মোস্তফা এরশাদের লাশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নামেন। পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি। পরে সেনাবাহিনী তাকে স্যালুট জানায় এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়।

ঘটনা প্রসঙ্গে সাক্ষাতকার নিতে গেলে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জানান, আমাদের রাজনৈতিক পিতা এরশাদ স্যারকে শেষ পর্যন্ত রংপুরের পল্লী নিবাসে তার ওসিয়তকৃত স্থানে সমাহিত করতে পেরে মহান আল্লাহ তায়ালার শোকর করছি। তিনি বলেন, সরকারের কাছে ঢাকায় খোলা স্পেসে আমাদের নেতারা এরশাদকে সমাহিত করার ব্যাপারে কোনো জায়গা বরাদ্দ নিতে পারেননি। বনানীতে কবর দেয়া হলে এরশাদের জীবনকর্ম ও দর্শন এবং জাতীয় পার্টি বিলীন হয়ে যেতো। সেকারণে রংপুরের প্রতিটি মানুষ চেয়েছে রংপুরে তাকে সমাহিত করতে। তারা এই দাবিকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমাকে সামনে রেখে আমার ওপর আস্থা রেখেছে। বিগত আটটি দিন নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে। অনেকেই নফল নামাজ পড়েছেন, রোজা করেছেন। আমিও সকল ধরনের চেষ্টা করে তাদের দাবি আদায় করে দিতে পেরেছি, এ জন্য আল্লাহর কাছে শোকরিয়া করছি।

তিনি বলেন, এই দাবি আদায় করতে গিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা আমাদেরকে চিরঋণী করে রাখলো। তিনি বলেন, দাবি আদায় করতে গিয়ে যদি আমাকে জীবন দিতে হতো তবুও তা আমি করতাম। আমার সাথে থাকার জন্য উত্তরাঞ্চলবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। এখন আমাদের কাজ স্যারের সমাধিকে ঘিরে পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে স্যারের দর্শন ও চিন্তা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া এবং জাতীয় পার্টিকে বাংলাদেশের এক নম্বর প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের রংপুরবাসীর এখন এই মিশন।

সূত্র জানায়, রংপুরে স্বশরীরে প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা এবং ঢাকায় বিভিন্নভাবে এই দাবি আদায়ের জন্য কাজ করেছেন আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফখর উজ-জামান জাহাঙ্গীর ও মহানগর সেক্রেটারি এসএম ইয়াসির। এরমধ্যে প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফখর উজ-জামান জাহাঙ্গীর গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করার মূল কাজটি করেছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement