২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
বার্লিন প্রাচীর থেকে বুয়েট

গ্রাফিতির প্রতিবাদি ক্যানভাস

-

যদি প্রশ্নটা এমন হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যানভাস কোনটি? তবে সহজ উত্তর, বার্লিন প্রাচীর। সেই সময় বিভিন্ন দেশের পর্যটক ও স্বাধীন চিত্র শিল্পীরা ১৫৫ কিলোমিটারের প্রাচীরটিকে প্রতিবাদ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। রঙ তুলিতে রঙিন ক্যানভাসের রূপ দিয়েছিল পুরো দেয়াল। যা প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল বিভক্ত জার্মান জাতির। প্রাচীর ভেঙে দুই দেশ মিলে একীভূত হয়ে রূপ নেয় বর্তমান জার্মানির।

২০১৭ সালে ঢাকার রাস্তায় দেয়ালে দেয়ালে ‘সুবোধ’ শিরোনামের ‘গ্রাফিতি’ সবার নজর কাড়ে। নাম পরিচয়হীন শিল্পীর আহ্বান অনুযায়ী সময় পক্ষে না থাকায় ‘সুবোধ’ পালিয়ে যায়। সময় এখনো পক্ষে আসেনি। পরিণতিতে হত্যার শিকার হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ।

দিনের পর দিন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের ব্যথা, মত প্রকাশ করতে না পারা, নির্যাতনে সহপাঠীর লাশ হয়ে যাওয়া সবই রঙ তুলিতে রঙিন হয়ে উঠেছে বুয়েটের দেয়ালে দেয়ালে। শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাসম্পাসজুড়ে ‘গ্রাফিতি’ দিয়ে তুলে ধরেছেন তাদের প্রতিবাদি অবস্থান।

গ্রাফিতিতে ‘নিরাপদ আসিস’, ‘ড্রিমডেথ’, ‘রাজনীতি’, ‘হোক কলরব’, মুষ্ঠিবাঁধা হাতে‘ হোক প্রতিবাদ’, চুপ করিয়ে রাখার মুখোশসহ দেয়ালে নানা বার্তা উপস্থিত করেছেন শিল্পীরা।

‘গ্রাফিতি’ আঁকিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের ১৭তম ব্যাচের (নাম প্রকাশ না করে) শিক্ষার্থী জানান, আমাদের চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘গ্রাফিতি’ আঁকা হয়েছে। মূলত ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাই বুয়েট ক্যাম্পাস জুড়ে গ্রাফিতিগুলো এঁকেছে।

একই বিভাগের ১৬তম ব্যাচের অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, গ্রাফিতিতে আমরা আবরার ফাহাদকে স্মরণ করেছি। সেই সাথে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছি। শেষ মুহূর্তে প্রতিবাদী হয়ে উঠার মাধ্যম ‘গ্রাফিতি’।

তারা জানায়, আবরার আমাদের মাঝে শহীদ হিসেবে আজীবন সমাদৃত হবে। আবরারের উপর নির্যাতনের নীরব প্রতিবাদ জানাবে এসব গ্রাফিতি। একই সাথে ক্যাম্পাসে আসা নতুনদেরও আবরারের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘Kilroy was here’ নামক ‘গ্রাফিতি’ আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ছিল লম্বা নাকওয়ালা এক লোক, যিনি দেয়াল ধরে বসে আছেন। সাদামাটা এ গ্রাফিতিটি আমেরিকান সেনাদের ব্যবহারে জার্মানদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করেন, এটা আমেকিান সেনাবাহিনীর গোপন কোনো কোড। যদিও আজ পর্যন্ত এর অর্থ জানা যায়নি।

‘ব্যাঙ্কসি’ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব নীতির বিরোধিতা করে ‘গ্রাফিতি’ আঁকেন।‘টার্গেট ডোভ’ নামে তার আঁকা গ্রাফিতিতে বুলেটগ্রুফ জ্যাকেট পরিহিত সাদা কবুতর মুখে একটি গাছের ডাল নিয়ে যাচ্ছে। আর ইসরাইলি স্নাইপারের বন্ধুকের ভিউপয়েন্ট তাকে অনুসরণ করছে। এ চিত্র অবরুদ্ধ পশ্চিম তীরের ইসরাইল-ফিলিস্তন বিভেদকারী দেয়ালে শোভাপাচ্ছে। বেথেলহামের দেয়ালে আঁকা ‘ব্যাঙ্কসি’র একটি ‘গ্রাফিতি’টি বলছে, ‘পৃথিবীর উপর শান্তি বর্ষিত হোক’। পাশেই তারকা চিহ্ন দিয়ে লেখা শর্ত প্রযোজ্য।

আধুনিক গ্রাফিতি চর্চার শুরু রেভ্যুলিওশনের জন্য বিখ্যাত শহর ফিলাডেলফিয়ায় চোরাগুপ্তাভাবে। যা নিউইয়র্ক হয়ে শিকাগো হয়ে পরে বার্লিন প্রাচীরে গিয়ে শিল্প মর্যাদা পায়। আর স্নায়ুযুদ্ধের পর বার্লিন প্রাচীর হয়ে ‘প্রাফিতি’ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।

‘গ্রাফিতি’ বলতে সহজ ভাষায় দেয়ালে আঁকা ছবি বা চিত্র। সাধারণ কোনো চিত্রকর্ম বা দেয়াল লিখন যাতে শিল্পীর সূক্ষ্ম বার্তা লুকানো থাকে। আমেরিকার শান্তির পক্ষে অবস্থানই ফুটে উঠে এসব গ্রাফিতি বা দেয়াল চিত্রে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক চিত্রের মাধ্যমেও সমাজের বাস্তবতা শিল্পীরা তার তুলির আচড়ে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন গ্রাফিতিতে।

পুরনো ইতিহাসও রয়েছে গ্রাফিতির। প্রাচীন রোম থেকে পম্পেই নগরীর বিভিন্ন সমাধির দেয়ালে, শিলালিপি, গুহাচিত্রেও গ্রাফিতির খোঁজ মিলে। প্রাচীন গ্রিক শহর এফিসাস বা বর্তমান তুরস্কে সেই সময়কার ‘গ্রাফিতি’ এখনো বর্তমান।

বিশ্বজুড়ে ‘গ্রাফিতি’ আঁকা হয়েছে গুহা, ভবনের দেয়াল, রাস্তা, ট্রেনসহ নানা স্থানে। ফিলিস্তিনের প্রায় প্রতিটি দেয়ালে এই ‘গ্রাফিতি’ লক্ষনীয়।

বিভিন্ন দেশে আবার ‘গ্রাফিতি’ আঁকিয়েদের সাজারও আইন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রাফিতি’ আঁকিয়েদের এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। একইভাবে শাস্তির বিধান আছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও। তা সত্ত্বেও বিরত রাখা যায়নি ‘গ্রাফিতি’ আঁকিয়েদের।

দুনিয়াজুড়ে মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে এই ‘গ্রাফিতি’। সমাজের অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রের নিপীড়ন, ঐক্য, স্বাধীনতা, মুক্তি, শান্তি ও শোষকের বিরুদ্ধে ‘গ্রাফিতি’ এক সৃষ্টিশীল বিষ্ফোরণ।


আরো সংবাদ



premium cement