২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফেসবুকে রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরা যেসব গুজব ছড়িয়েছেন

শেখ হাসিনার নোবেল পুরষ্কারের সম্ভাবনা নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। - ছবি: বিবিসি

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবরের বিষয়টি বেশ আলোচিত। এ ভুয়া খবরকে অনেকে নামকরণ করেছেন 'গুজব' হিসেবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল আলোচিত বেশ কিছু ভুয়া খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত আছে।

তবে এ লেখায় এমন কয়েকটি ভুয়া খবরের দিকে আলোকপাত করবো যেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এসব ভুয়া খবর ছড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরা।

শেখ হাসিনা ও নোবেল পুরষ্কার

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের অতি স্বল্প পরিচিত একটি ইংরেজি দৈনিক দ্য এশিয়ান এজ খবর দিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের নোবেল পুরষ্কারের জন্য ১০ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে।

কিন্তু এ তালিকা তারা কোথা থেকে পেয়েছে সেটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

নোবেল শান্তি পুরষ্কারের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন প্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা মনোনয়নকারী- উভয়ের নাম ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন রাখে নোবেল কমিটি।

নোবেল কমিটি এক্ষেত্রে গোপনীয়তার কঠোর নীতি অনুসরণ করে।

নোবেল পুরষ্কার দেবার চতুর্থ ধাপে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়।

কিন্তু এ সংক্ষিপ্ত তালিকায় কয়জনের নাম থাকে সেটিও জানা সম্ভব নয়। এরপর সেটি আরো যাচাই-বাছাই হয়।

সুতরাং শেখ হাসিনা নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকার বিষয়টিকে একটি ভুয়া খবর হিসেবেই দেখছেন ফ্যাক্ট অনুসন্ধানকারীরা।

যাচাই নামে একটি ফ্যাক্ট অনুসন্ধানকারী ওয়েবসাইট বলছে, নোবেল পুরষ্কারের জন্য শেখ হাসিনা সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছেন বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটি ভুয়া খবর।

অথচ এ ভুয়া খবরের উপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন ফেসবুকে।

তারেক রহমান ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি

 

তারেক রহমানের সংক্রান্ত এ খবরটি নিয়ে বিএনপি কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একটি বিষয় ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয়েছিল। সেটির শিরোনাম হচ্ছে, "তারেক জিয়াকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবার আমন্ত্রণ।"

এ ধরণের একটি বিষয় স্বভাবতই কৌতূহল সৃষ্টি করে। ফেসবুকে এটি শত-শত শেয়ার হচ্ছিল।

যারা এসব খবর শেয়ার করছিলেন তারা তারেক রহমানের নানা প্রশংসা করে সেগুলো শেয়ার করেছেন।

বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে যারা এটি শেয়ার করছেন, তাদের অনেকই বিএনপির সমর্থক।

এ খবর শেয়ার করার মাধ্যমে বিএনপি সমর্থকরা তারেক রহমানের 'যোগ্যতা' সম্পর্কে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

পত্রিকা ডটকম নামে একটি অখ্যাত ওয়েবসাইট এ খবরটি প্রকাশ করেছে এবং বিএনপি সমর্থকরা সেটি লুফে নিয়েছে।

এ খবরটিতে কোন তথ্যসূত্রও উল্লেখ করা হয়নি। কারো কোন বক্তব্য ছিল না। বাংলাদেশের কোন মূল ধারার গণমাধ্যম এ খবরটি প্রচারও করেনি।

এমনকি তারেক রহমানকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কথিত আমন্ত্রণের বিষয়ে ঢাকায় বিএনপির কেউ জানতেনও না।

ঢাকায় বিএনপির একাধিক নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টিকে একেবারেই উড়িয়ে দেন।

কারণ তারেক রহমান যদি সত্যিই অক্সফোর্ডে আমন্ত্রণ পেতেন তাহলে বিএনপি সেটিকে ঘটা করে প্রচার করতো। এক্ষেত্রে তা হয়নি।

শেখ হাসিনা ও দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী


চলতি বছরের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মন্ত্রীসভার এক বৈঠক শেষে মন্ত্রী পরিষদ মো: শফিউল আলম এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় মন্ত্রী পরিষদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন, সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'দ্য স্ট্যাটিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল'এর জরিপে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।

মন্ত্রীসভায় অভিনন্দন জানানোর কয়েকদিন আগে কয়েকটি ওয়েবসাইটে এ খবরটি ছড়ানো হয়। যেটি পরে ফেসবুকেও অনেকে শেয়ার করেছেন।

কিন্তু 'দ্য স্ট্যাটিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল' নামের কোন সংস্থার অস্তিত্ব ইন্টারনেটে গুগল সার্চের মাধ্যমে আসেনি।

বর্তমান সময়ে সাধারণত যে কোন সংস্থার একটি ওয়েবসাইট থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।

তাছাড়া যে প্রতিষ্ঠান সরকার প্রধানদের নিয়ে জরিপ করে, তাদের একটি ওয়েবসাইট না থাকাটি খুবই অস্বাভাবিক।

শুধু প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, এ সংক্রান্ত নানা ইংরেজি শব্দ এবং বাক্য দিয়ে গুগলে সার্চ দেবার পরও কোন ফলাফল আসেনি।

মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেছেন, শেখ হাসিনা দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে প্রথম হয়েছেন কে? কিন্তু সে উত্তরও মিলছে না।

বাংলাদেশে ভুয়া খবর সনাক্তকারী একটি ওয়েবসাইট বিডি ফ্যাক্ট চেক বলছে, শেখ হাসিনার 'দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী' হবার খবরটি ভুয়া।

কিন্তু মন্ত্রী পরিষদের এ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিনন্দন জানানোর পর বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো মূলধারার গণমাধ্যম কোন প্রশ্ন ছাড়াই এটি প্রকাশ করেছে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও জিগাতলা সংঘর্ষ

চলতি বছরের আগস্ট মাসে ঢাকায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামে।

পর-পর চারদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিক্ষোভ করে।

বিক্ষোভের পঞ্চম দিন বিকেলে ঢাকার জিগাতলা এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।

অভিযোগ উঠে সে সময় ছাত্রলীগের হামলায় কয়েকজন আহত হয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজনকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছিল।

কিন্তু সে ঘটনার পরপরই ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে জিগাতলায় চারজন নিহত এবং কয়েকজন স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

কয়েকজনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

অনেকে নানা রকমের রক্তাক্ত ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে ফেসবুকে।

কিন্তু সেসব ঘটনা জিগাতলা সংঘর্ষের সাথে সম্পৃক্ত কি না সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না।

এ বিষয়গুলো ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকের সাথে কথা বলা হয় বিবিসির তরফ থেকে। যারা এসব পোস্ট শেয়ার করেছেন তাদের সাথেও কথা বলা হয়।

কিন্তু ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। সবাই বলেছেন, তারা মৃত্যু এবং কথিত ধর্ষণের কথা শুনেছেন।

বিবিসির তরফ থেকে বিভিন্ন হাসপাতালেও যোগাযোগ করা হয়। হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের কাছে সংঘর্ষের সময় গুরুতর আহত এমন কোন ব্যক্তি হাসপাতালে আসেননি যারা পরবর্তীতে মারা গেছেন।

তবে আহত কয়েকজন হাসপাতাল প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন বলে জানা যায়।

তাছাড়া অস্বাভাবিকভাবে কারো মৃত্যু হলে সাধারণত সরকারি হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হবার কথা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে সে রকম কোন ময়না তদন্তের খবরও পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া কোন নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান চেয়ে থানায় কেউ সাধারণ ডায়েরিও করেনি।

এমনকি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোন পরিবার সংবাদমাধ্যমের কাছে আনুষ্ঠানিক কিছু বলেনি।

তাছাড়া বিবিসির সংবাদদাতা সরেজমিন অনেকের সাথে কথা বলে হত্যাকাণ্ড কিংবা ধর্ষণের কোন অভিযোগ পাননি।

এমনকি পরবর্তীতেও হত্যাকাণ্ড কিংবা ধর্ষণের বিষয়ে কেউ কোন অভিযোগ তোলেনি।

ঘটনার সময় বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, কর্মী এবং সমর্থকরা এসব পোষ্ট ছড়ানোর ক্ষেত্রে এক ধরণের ভূমিকা রেখেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড এবং ধর্ষণের গুজব ছড়ানো হয়েছে।

সমাজের অনেক পরিচিত ব্যক্তিরাও এসব গুজবের অংশীদার হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement