১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

হিমালয়ের রহস্যময় প্রাণী ইয়েতি!

হিমালয়ের রহস্যময় প্রাণী ইয়েতি! - ছবি : সংগৃহীত

অজানা রহস্যের কুয়াশা সভ্যতার শুরু থেকেই ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের মনে। কত রকমের কিংবদন্তি! বারমুডা ট্র্য়ায়াঙ্গেল হোক বা লকনেস মনস্টার, কিংবা মার্কিন মুলুকের মথম্যান… তালিকা করতে বসলে হাজারো নাম আসবে। কিন্তু সেই তালিকায় একটা নাম হয়তো থাকবেই- ইয়েতি!

আসলে মানুষের মনের মধ্যে বরাবরই রয়েছে রোমাঞ্চের প্রতি অদম্য আকর্ষণ। ‘ক্রিপ্টোজুলজি’ নামের একটা বিষয় রয়েছে, সেখানে নানা বিচিত্র প্রাণীদের সম্পর্কে চর্চা করা হয়। সেখানে বিগফুট, লকনেস মনস্টার, চুপাক্যাব্রা, জার্সি ডেভিল নানা প্রাণীর দেখা মেলে। এবং অবশ্যই ইয়েতিও সেখানে রয়েছে। তবে সে না হয় মনের কোণে থাকা মিথের রোমাঞ্চ। বাস্তবে ব্যাপারটা কী? ইয়েতি আছে না নেই? যদি না থাকে, তাহলে এত বছর ধরে কেন টিকে রয়েছে সেই মিথ? কোথা থেকে তা জন্ম নিলো?

ইয়েতি থাক বা না থাক, তার একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আলেকজান্ডার নিজেও ইয়েতির কথা জানতেন। সেটা ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। জানা যায়, ইয়েতির কথা জানতে পেরে তিনি নাকি রহস্যময় প্রাণীটিকে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত তিনি আদৌ তা দেখেছিলেন, তেমন কোনো প্রমাণ অবশ্য নেই।

ড্যানিশ লেখক এইচ সিগারের মতে, হিমালয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে ইয়েতির প্রতি বিশ্বাস বহু যুগের।

১৮৩২ সালে জেমস প্রিন্সেপের লেখা ‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে, লম্বা কালো চুলের দীর্ঘাকায় দ্বিপদী প্রাণীর কথা। পরবর্তী সময়ও পর্বত অভিযাত্রীরা অনেক উঁচুতে বরফে ঘেরা প্রতিকূল পরিবেশে চকিতের জন্য দীর্ঘদেহী মানুষের মতো প্রাণী দেখেছেন। দ্রুত সেটি মিলিয়ে গেছে শীতল অন্ধকারে।

১৯৫১ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী এরিক শিপটন দাবি করেন, তিনি এভারেস্টে ওঠার বিকল্প পথ অনুসন্ধান করার সময় বরফে দীর্ঘ পায়ের ছাপ দেখেছেন। কেবল দাবি করাই নয়, তিনি ছবিও তুলে আনেন। দেখা যায়, ওই ছাপ ১৩ ইঞ্চি লম্বা! বলতে গেলে সেই ঘটনাটিই সারা পৃথিবী ইয়েতির কথা ছড়িয়ে দিলো। কেননা সেই প্রথম ক্যামেরাবন্দি হলো ইয়েতির পায়ের ছাপ! সেই শুরু। এর দু’বছর পর তেনজিং নোরগে ও স্যার এডমন্ড হিলারি দাবি করেন, তারাও এভারেস্টে ওঠার সময় বড় পায়ের ছাপ দেখেছেন।

যদিও হিলারি পরে বলেছিলেন, ইয়েতি বলে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার তেনজিং তারা আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ইয়েতি আসলে বিরাট বাঁদর। তিনি না দেখলেও তার বাবা দু’বার এমন দীর্ঘ প্রাণী দেখেছেন।

দ্বিতীয় আত্মজীবনীতে অবশ্য অন্য কথা লেখেন তেনজিং। জানিয়ে দেন, ইয়েতির অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান তিনি।

কিন্তু এমন দোলাচলের মধ্যেই ওই পাঁচের দশক থেকেই ইয়েতির কথা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বহু দেশ থেকে অ্যাডভেঞ্চারিস্ট মানুষরা ছুটে যান হিমালয়ে, ইয়েতি দেখতে। নেপাল সরকার ইস্যু করতে থাকে ইয়েতি হান্টিং লাইসেন্স! যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ইয়েতির ছবি তোলা যেতে পারে বা তাকে বন্দিও করা যাবে। কিন্তু আত্মরক্ষার প্রয়োজন না পড়লে তাকে হত্যা করা যাবে না। আর যত ছবি তোলা হবে এবং কোনো ইয়েতির দেহ অথবা জ্যান্ত ধরতে পারলে তাকে নেপাল সরকারে কাছেই জমা দিতে হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, ইয়েতির সন্ধান মিললে সেই সব প্রমাণ আগে প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। নিজেরা সংবাদমাধ্যমকে ডেকে বললে হবে না।

এখানে একটা কথা বলাই যায়। একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, স্কটল্যান্ড লকনেস মনস্টারকে (পানির ভেতর থেকে মাথা তোলা দীর্ঘদেহী প্রাণী যাকে দেখতে অনেকটাই ডাইনোসরের মতো) ঘিরে তৈরি হওয়া ট্যুরিজম থেকে বছরে ৬০ মিলিয়ন ডলার রোজগার করে। নেপাল কত উপার্জন করে, তেমন কোনো হিসাব মেলেনি। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বছরে একটা রোজগার তাদের নিশ্চিতভাবেই হয়।

কিন্তু ইয়েতি আজও কেবলই রহস্যে ঢাকা মিথের ভেতরে মুখ লুকিয়ে বসে রয়েছে।

তবু গত সাত দশকে ইয়েতি ফিরে ফিরে এসেছে যেন! ক’দিন আগে কয়েকজন বাঙালি অভিযাত্রী ক্যাম্প ওয়ান থেকে ক্যাম্প টুতে যাওয়ার সময় বরফের ওপরে বড় বড় পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। সাড়ে সাত ইঞ্চি লম্বা ও সাড়ে ছয় ইঞ্চি চওড়া সেই পায়ের ছাপের ছবিও তুলে এনেছেন তারা। এরপর থেকে ফেরে বাঙালির আড্ডায় আরো একবার নতুন করে উঁকি দিতে শুরু করেছে ইয়েতি।

আসলে নারায়ণ গাঙ্গুলির টেনিদা যারা পড়েছে তাদের কাছে ইয়েতির এক অন্য আকর্ষণ রয়েছে। টেনিদা বলেন, ‘…আসল ইয়েতি। তাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে যাসনি… মারা পড়ে যাবি। আর তাকে কখনো দেখতেও চাসনি। না দেখলেই বরং ভালো থাকবি।’

আবার টিনটিনের একটা গোটা কমিক্সই রয়েছে ইয়েতি নিয়ে। সেই কমিক্স কত কৈশোরকে যে রোমাঞ্চের কুয়াশামাখা পথের সন্ধান দিয়েছে…!

তবে ইয়েতি নিয়ে কিন্তু ‘সিরিয়াস’ গবেষণাও হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জিনতত্ত্বের অধ্যাপক ব্রায়ান সাইকস হিমালয়ের তুষারে উদ্ধার হওয়া চুল বা লোম নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করেছেন। তার দাবি, তুষারমানব নয়। ওটা নিছকই কোনো মেরুভালুকের। তবে তারা বহু হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। কিন্তু পৃথিবীর ‘ফ্রিজে’ অক্ষত রয়েছে আজও। আর তাকে নিয়েই তৈরি হয়ে গিয়েছে রহস্যঘন মিথ!

যদিও পরে অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, মোটেই কোনো আদিম পৃথিবীর প্রাণীর নয়, ওই লোম আজকের পৃথিবীর সাধারণ মেরুভালুকের। তবে যাই হোক, লোমগুলো যে ভালুকের তাতে তারা নিঃসন্দেহ। লেঙ্গুর থেকে তিব্বতি নীল ভালুক… আরো নানা মত রয়েছে।

তবে প্রকৃতপক্ষে ইয়েতি থাকুক বা না থাকুক, তাকে ঘিরে অনুসন্ধান চলেছে আজও। আর সন্ধান মিলুক না মিলুক, মনের গভীরে যাদের বাস তাদের চর্মচক্ষে না দেখলেও যে চলে সে কথা তো বলা অনর্থক।
সূত্র : সংবাদপ্রতিদিন


আরো সংবাদ



premium cement