২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ : সন্তান থাকবে কার কাছে?

মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ : সন্তান থাকবে কার কাছে? - ছবি : সংগৃহীত

অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে দু’জন মানুষ একসাথে পথচলা শুরু করে যদিও তা সবসময় মসৃণ হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দু’জনের সম্পর্ক এমন হয়ে দাঁড়ায় যাতে বিচ্ছেদই হয় একমাত্র ‘সমাধান’। সিথি ও সুজনের (ছদ্মনাম) দাম্পত্য জীবনে এটিই ঘটেছিল।

তাদের দাম্পত্যজীবনে কোলজুড়ে এসেছিল একটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তান। কিন্তু বিচ্ছেদের পর এদের আইনগত অবস্থান কী হবে, তারা কার কাছে থাকবে, কে বহন করবে তাদের ভরণপোষণ- এ নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন।


মুসলিম আইন অনুযায়ী, বাবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক, আর মা হচ্ছেন- সন্তানের জিম্মাদার। বিচ্ছেদ হলেও মা তার সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারান না। ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পর্যন্ত মা তাদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের মঙ্গলের জন্য যদি সন্তানকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরো প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা তাকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন থাকতে পারে। তবে মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখার ক্ষমতা হারাতে হতে পারে।

‘ইমামবন্দী বনাম মুসাদ্দির’ মামলায় বলা হয়েছে, ‘মুসলিম আইনে সন্তানের শরীরের ব্যাপারে লিঙ্গভেদে কিছু বয়স পর্যন্ত মা তত্ত্বাবধানের অধিকারিণী; মা স্বাভাবিক অভিভাবক নন। একমাত্র বাবাই বা যদি তিনি মৃত হন তার নির্বাহক আইনগত বা বৈধ অভিভাবক।’ তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে মা এ অধিকার হারাবেন [হেদায়া ১৩৮, বেইলি ৪৩৫] সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বাবার। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হলে অবশ্য মায়ের দ্বিতীয় স্বামী সন্তানের রক্ত সম্পর্কীয় নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে একজন না হলে মা তার তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা হারাবেন [২২ ডিএলআর ৬০৮]।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৬ ডিএলআর- এ জোহরা বেগম বনাম মাইমুনা খাতুন মামলায় আদালত বলেছেন, নিষিদ্ধ স্তরের বাইরে মায়ের বিয়ে হলেই মায়ের কাছ থেকে হেফাজতের অধিকার চলে যাবে না। মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই।

যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা পাবে- সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন। আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডিএলআরের মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

নাবালকের কল্যাণের বিষয়ই হচ্ছে মূল কথা। নাবালকের কল্যাণ কিভাবে নিহিত আছে, সেটিই বিবেচনা করবেন আদালত। কোনো বাবা নিজের আচরণের কারণে সন্তানের তত্ত্বাবধানের অধিকার হারাতে পারেন। কোনো বাবা সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অপারগ হলে সে ক্ষেত্রে বাবাকে মায়ের কাছ থেকে সন্তানের অধিকার সমর্পণ করা ঠিক নয়। আবার মা যদি তার নাবালক সন্তান স্বামীর আর্থিক সাহায্য ছাড়াই নিজ খরচে লালন-পালন করে থাকেন, তবে সে সন্তানকে আদালত বাবার তত্ত্বাবধানে দিতে অস্বীকার করতে পারেন [১৭ ডিএলআর ১৩৪]। যদি কোনো নাবালকের কেউ না থাকে, আদালত নিজ বিবেচনায় অভিভাবক নিয়োগ করে থাকেন।

মায়ের অগোচরে যদি বাবা জোরপূর্বক সন্তানকে নিজের হেফাজতে গ্রহণ করেন, সে ক্ষেত্রে বাবার বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা পর্যন্ত দায়ের করা যাবে। ‘৪৬ ডিএলআর-এর আয়েশা খানম বনাম মেজর সাব্বির আহমেদ’ মামলার মাধ্যমে এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন অনেক সময়। এ জন্য প্রয়োজন হলে সন্তানকে আলাদা করে বিচারক নিজের কাছে নিয়ে তার মতামত জেনে নিতে পারেন। আবার মা-বাবা পর্যায়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ারও সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর ৫ ধারা মতে, সন্তানের কাস্টডির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একচ্ছত্র এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের। আর কাস্টডি প্রদানের ক্ষেত্রে আদালত কী কী বিবেচনা করবেন, সেগুলো গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০-এর ১৭ ধারায় বিস্তারিত বলা রয়েছে। ওই ধারার বিধান মতে, নাবালক-নাবালিকা যে ধর্মীয় অনুশাসনের অধীন, সেই অনুশাসনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং তার সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে আদালত অভিভাবক নিয়োগ করবেন। নাবালক-নাবালিকার কল্যাণ কী হবে, তা নির্ধারণ করা হবে নাবালক-নাবালিকার বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, প্রস্তাবিত অভিভাবকের চরিত্র, সামর্থ্য এবং নাবালকের সাথে নৈকট্য ও আত্মীয়তার সম্পর্ক, মৃত মা-বাবার কোনো ইচ্ছা (যদি থাকে) এবং প্রস্তাবিত অভিভাবক নাবালক-নাবালিকার সম্পত্তির বিষয়ে সম্পর্কযুক্ত কি না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে। এ বিষয়ে নাবালক-নাবালিকার কোনো বুদ্ধিদীপ্ত মতামত থাকলে আদালত সেই মতামতকে প্রাধান্য দেবেন।

মা কখন সন্তানের জিম্মাদারি হারান-
০১. নীতিহীন জীবনযাপন করলে, ০২. যদি এমন কারো সাথে তার বিয়ে হয়, যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়, ০৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে এবং দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে, ০৪. বিয়ে বহাল থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে, ০৫. যদি তিনি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করেন, ০৬. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেয়া হয়।

সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব কার- বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছেও থাকে, তবে সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরোপুরি বাবার। অর্থাৎ মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা মা-বাবা আলাদা বসবাস করলে বাবাকেই সন্তানদের ভরণপোষণ করে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে মা আলাদা থেকেও- বিয়েবিচ্ছেদ হোক বা না হোক, সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা করে ভরণপোষণের অধিকার আদায় করতে পারেন।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা


আরো সংবাদ



premium cement