ব্যর্থ চীন সফর
- মশিউর রহমান তৌহিদ
- ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৬:১০
প্রধানমন্ত্রী যেভাবে চীন থেকে ফিরে এলেন তাতে উদ্বেগের অনেক বিষয় আছে। প্রথমত, এটি একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। সেই সাথে দেশের জন্য সম্মানজনক নয়। এ জন্য চীন দায়ী নয় অবশ্যই। দায়ী সরকারি টিমের ভুল হোমওয়ার্ক। দায়ী সরকারের উপদেষ্টারা। এক দিকে এরা যেমন অরাজনৈতিক তেমনি রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ। পররাষ্ট্রনীতি এবং এর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে এদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। আমেরিকা থেকে নিয়ে এসে এক অধ্যাপককে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বানানো হয়েছে। তার যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ ছিল এবং আজও রয়ে গিয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ ঠকছে। এবং ঠকেই যাচ্ছে।
চীন সফরের আগে থেকেই সরকার ঘোষণা দিয়েছিল; ভারত রাজনৈতিক বন্ধু এবং চীন অর্থনৈতিক বন্ধু। কিন্তু সফরের শুরুতেই চীন বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক বন্ধু হিসেবে থাকতে ইচ্ছুক নয়। ফলে চীন বাংলাদেশ সরকারকে তার রাজনৈতিক বন্ধু ভারতের দিকে ঠেলে দিয়েছে অর্থনৈতিক সহায়তা লাভের জন্য। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে চীন সফর তা কি এখন সরকারের রাজনৈতিক বন্ধু ভারত সাধন করতে পারবে? মানে মোদি সরকার একই সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধু হিসেবে হাসিনা সরকারকে সহজ শর্তে ৯ বিলিয়ন ডলার লোন দিতে পারবে? পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে হ্যাঁ। ভারত সরকার ইচ্ছে করলে চীন থেকে লোন বা অর্থনৈতিক সহায়তা পেতে হাসিনাকে সহায়তা করতে পারত। কিন্তু করেনি। কারণ বাংলাদেশ থেকে সে ধরনের প্রস্তাবনা আসেনি। হয়তো বাংলাদেশের কেউ ধারণা করেনি ওই বিষয়ে? যদিও এটি ছিল এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্ড। অবশ্যই হাসিনা সরকারের বহুল কথিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধুদের মধ্যকার ঝুলে থাকা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; যা বুঝতে সরকারি দলের এই টিমের সদস্যরা অযোগ্যতার, অদক্ষতার ও অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।
ধারণা হয়েছিল যে, হাসিনা এবার চীন জয় করে দেশে ফিরবেন। বাস্তবে সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হতাশার বার্তাই শোনা গেছে। ভাবছেন বিদেশী লোন ছাড়া দেশের করুণ অর্থনীতিকে তিনি কিভাবে সামাল দেবেন? যদিও এটি খুব সহজ বিষয়। বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ আদায় করা যায়। সেটা চীনের কাছে চাওয়া ৯ বিলিয়ন হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারবেন সহজেই। চীন সফরে যেভাবে আমরা অপমানিত হয়েছি এবং দেশকে ছোট করতে হয়েছে, তার জন্য দায়ী সরকারের সর্বত্র সীমাহীন দুর্নীতি লুটপাট ও অর্থ পাচার।
আপনাদের মনে আছে নিশ্চয় ২০১৪ সালের ভারতের নির্বাচনের সময়কার কথা। যেবার মোদি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন। নির্বাচনের আগে ভারতের সেই সময়ের কংগ্রেস সরকার অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল বাংলাদেশকে নিয়ে রাশিয়া, চীন, জাপানের সাথে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোট গঠন করবেন বলে। এ বিষয়ে হাসিনা সরকারের উৎসাহ ছিল দেখার মতো। সরকার এটিকে আমেরিকাবিরোধী জোট হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন।
আমেরিকা সে সময়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। এগুলো সরকারের পক্ষে মানা কোনো মতেই সম্ভব ছিল না। কারণ এগুলো মানলে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যায়। সেই সময়ের ভারতের নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই ভারতের কংগ্রেস সরকারের সাথে পরামর্শ করে জাপান সফর ঠিক করে রেখেছিলেন। বিষয়টি এমন যে, হাসিনার জাপান সফর দিয়েই ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোট গঠনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। কিন্তু ২০১৪ সালের ভারতের ওই নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। আর বিজেপির নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া, চীন, জাপানের সাথে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোট গঠনে ইচ্ছুক ছিলেন না। বরং তিনি আমেরিকা ও ইউরোপিয়ানদের সাথে মিলে চীনবিরোধী অবস্থান নিতে ইচ্ছুক ছিলেন।
ফলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তনে হাসিনার অবস্থান কী হবে সে বিষয়ে ব্রিফ করতে মোদি সর্ব প্রথমে তার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। এ দিকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনে জাপানও যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গিয়েছিল। ভারত, রাশিয়া, চীনের সাথে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোট গঠনে জাপানের উৎসাহ আগ্রহ তেমন ছিল না। কারণ রাশিয়া ও চীনের সাথে জাপানের সম্পর্ক অত মধুর ছিল না। আবার ওই জোটে না গিয়ে অন্য কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছিল না জাপান সরকার। ফলে ভারতের নতুন সরকারের নতুন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাপানও নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়েছিল।
ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন এটি ধরে নিয়ে ভারত সরকার চীনবিরোধী পরবর্তী গুটি সাজাতে যাচ্ছে। অনেকটা হাসিনার চীন সফরকালীন সময়ে ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাশিয়া সফর সেই বিশেষ দিকটি নির্দেশ করছে। চীনের ওপর রাশিয়ার বাণিজ্যিক ও সামরিক ব্যাপক নির্ভরশীলতাকে যথাসম্ভব কমিয়ে বাল্টিক, ইরান ও ইরানের বন্দর ব্যবহার করে ভারত রাশিয়ার বাণিজ্য সম্ভাবনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাস্তবায়িত করার দিকে হাঁটছে মোদি। ইসরাইলের পরামর্শে এবং পশ্চিমাদের অনুমোদন নিয়ে মোদি সরকার চাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ আপাত স্থগিত রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকারের নেতৃত্বে চীনবিরোধী অবস্থান; অর্থাৎ চীনকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ব্যাপক চাপে ফেলার চেষ্টা। তবে ভারত কতটুকু এ বিষয়ে সফল হবে তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক বন্ধু হিসেবে হাসিনার চীন সফরের সময় এটির একটি প্রভাব পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
চীন সফরে দৃশ্যত বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ভুলটি ছিল চীনের জন্য কোনো উপঢৌকন না নিয়ে চীন থেকে বড় ধরনের উপঢৌকন পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যা নিজেদের টালমাটাল অর্থনীতিকে সামাল দেয়ার জন্য খুব দরকার মনে করেছিলেন।
(কলামিস্ট, [email protected])
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা