১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

ছাত্র আন্দোলন পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ

ছাত্র আন্দোলন পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ - ফাইল ছবি

মেধা একটি জাতির সামনে এগিয়ে চলার মূলমন্ত্র। মেধার চর্চাই জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে অবিবেচনাপ্রসূত কোটাব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে মেধা কাজে লাগানোর সুযোগ ব্যাহত করছিল। মেধাবীরা কোটার ফাঁদে পড়ে যখন বঞ্চিত হচ্ছিল; তখন সামর্থ্যবানরা উপায়ান্তর না দেখে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছিল। যাদের বিদেশে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তারা যোগ্যতা থাকার পরও কোটাব্যবস্থার কারণে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়ে গোমড়ে কাঁদছিল। অন্যদিকে কোটার জোরে অদক্ষ, অযোগ্যরা স্থান করে নিচ্ছিল দেশ পরিচালনার কাজে।

কোটায় দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বহু পুরনো। রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে অসৎ দুর্নীতিপরায়ণ এবং নানা অপকর্মে এদের জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। মেধার অভাবে দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। তাই ছাত্ররা ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে কোটাব্যবস্থা বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বাতিল আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এর জেরে ফের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।

এই আন্দোলন বিপুল জনসমর্থন পায়। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে কোটা সংস্কারের দাবির একটি সুরাহা হলেও এর আগেই ঘটে সব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। পুলিশ, র্যাব-বিজিবি দিয়ে ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে অবশেষে সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে। সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তাদেরকে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়।

সান্ধ্য আইন এখনো বলবৎ রয়েছে। এর মধ্যে চলছে গণগ্রেফতার। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে গ্রেফতার বাণিজ্যের।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ একাত্মতা জানায়। মেধার মূল্যায়ন চায় সবাই। যে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অসংখ্য মানুষ, কোটি কোটি যুবক বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত, সেখানে চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটাপ্রথা ছিল চরম বৈষম্যমূলক। তবে ক্ষমতাসীনরা জন-আকাক্সক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার আলোচনার পথে না হেঁটে বলপ্রয়োগের পথে হাঁটে। উসকিয়ে দেয়া হয় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী ন্যায্য দাবিতে আলোচনায় না গিয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য দিতে থাকেন। এতে ফুঁসে ওঠে দেশ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেরিয়ে আসেন পথে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ আপামর জনগণ ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়।

সরকার আন্দোলন দমাতে বলপ্রয়োগের নীতি বেছে নেয়। নামানো হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলি এবং সরকারদলীয় লোকজনের আক্রমণে, গুলিতে ঝরেছে বহু তাজাপ্রাণ। এর দায়ভার রাষ্ট্রের এবং সরকারের।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বিশেষ করে পুলিশ কত বেপরোয়া ছিল তার জ্বলন্ত প্রমাণ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে সরাসরি গুলি করার ঘটনা। তাকে কোনোরকম উসকানি বা হুমকি ছাড়াই উপর্যুপরি গুলি করে হত্যা করা হয়। কোনো সভ্য দেশে যা অপকল্পনীয়। এখন প্রশ্ন হলো, কেন কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন এই রূপে আবির্ভূত হলো? এর কারণ বহুবিধ। অনেক অবিচার, অনিয়ম, দুর্নীতির জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে জনগণের ওপর। অধিকার বঞ্চিত হতে হতে মানুষ দিশেহারা। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। দেনার দায়ে অনেকের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত। তবু সাধারণ মানুষ কথা বলতে পারছে না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হাজারো মামলা, হামলা, হয়রানি। বলতে গেলে দেশে আজ ন্যায়বিচার নির্বাসিত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন গুম হয়ে গেছে।

সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অনাচার, নিরাপত্তাহীনতা, জনগণের সম্পদ লোপাট, হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ আমজনতা প্রতিহত করতে পারছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে ছাত্র আন্দোলনে যেন নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আশা জেগে ওঠে সাধারণ মানুষের মনে। ফলে দ্রুতগতিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কোটা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

জনগণের ক্ষোভ একদিনে জন্ম নেয়নি। গত ১০ বছর ধরে দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নাগরিকরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। দিনের ভোট রাতে করার নমুনা দেখে সবাই অসহায় বোধ করেছে। এছাড়া ক্ষমতাসীনরা নানা অপকর্ম করলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নির্বাচনে ভোট দেয়া নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। আগে দেশে নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। আর এখন নির্বাচনের নামে অনুষ্ঠিত হয় প্রহসন। নির্বাচন মানে বিনিয়োগ, হাজার কোটি টাকার খেলা। ফলে সৎলোকের শাসন এখন কল্পনাবিলাস। এতে করে জনগণ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে।

সরকার উচ্চকণ্ঠে বলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট করছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। উল্টো দিকে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য নাগরিক অধিকার হলেও সৎ ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেশান। নানান চাপে, ঝুঁকিতে আছেন তারা। দেশ আজ দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দী। আমাদের মতো দেশের যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে কোটি কোটি মানুষের বাস। সেই দেশে সরকারের পরিচালন ব্যয় বাজেটের ৪০ শতাংশ। ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১৭ লাখ মানুষের জন্য এই ব্যয়। বাদবাকি সবার জন্য ৬০ শতাংশ বাজেট।

খেলাপি ঋণ, অনিয়ম এবং তারল্য সঙ্কটে ব্যাংক খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বেসিকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের দুর্নীতি, অনিয়মের সুরাহা এখনো হয়নি। গ্রাহক ব্যাংকে গচ্ছিত তার টাকা সময় মতো ফেরত পাচ্ছেন না । সরকারের বড় বড় প্রকল্পে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কোনো প্রকল্প শেষ হচ্ছে না। দীর্ঘসূত্রতায় নানা অনিয়ম এবং খরচের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো চাপে পড়ছে সরকার বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যাংক থেকে ধার নেয়ায়।

দেখা যাচ্ছে, উচ্চতর প্রশাসন থেকে দুর্নীতি এমনভাবে শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে যে, পরিণতিতে পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তাই কোটা আন্দোলনের উছিলায় দেশের জনগণ রাস্তায় সোচ্চার হয়েছিলেন।

সরকার ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। সরকারকে এ প্রাণহানির জবাব দিতে হবে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিপুল প্রাণহানির হিসাব দিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। দেশের ভেতরে সরকারের ওপর নাগরিকদের আস্থা তলানিতে। সে জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জাতিসঙ্ঘের অধীনে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

হাজারো আঘাতে জর্জরিত জাতি মেরুদণ্ড শক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়াক। উচ্চস্বরে আওয়াজ উঠুক এই দেশে কোনো অপশাসন চলতে পারে না। দেশটা ক্ষমতাসীনদের একার নয়, জনগণের। জনতার অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যাবে না। অনেক কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার যে সুফল, তা থেকে জনগণ বঞ্চিত থাকতে পারে না।

এত রক্ত স্বাধীনতার পর দেশের মানুষ দেখেননি। বাস্তবে রক্ত দিয়েই অধিকার আদায় করতে হয়। মাত্র ছয় দিনে ঝরে গেছে দুই শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ। তবু মরিয়া হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে আছে সরকার। অসৎ ক্ষমতালোভীদের সমূলে উপড়ে ফেলতে না পারলে জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হবে না।

অধিকার বঞ্চিত হওয়া মানে নিজকে অসম্মান করা। সবার বিবেক জাগ্রত হোক। অন্যায়কে অন্যায় বলতে শিখুক, কালোকে কালো বলুক। প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিক। তবেই আসবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।


আরো সংবাদ



premium cement