১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

একজন সাংবাদিকের চোখে গণতন্ত্র

একজন সাংবাদিকের চোখে গণতন্ত্র - নয়া দিগন্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফের নামের আগে মরহুম লিখবেন বা পরলোকগত লিখবে সেটি পত্রিকার লোকেরা ভালো বুঝবেন। প্রয়াত শিক্ষক বলতেন, গণতন্ত্রের চেয়ে বিভ্রান্তিকর শব্দ পৃথিবীর কোনো ভাষায় আর একটি নেই। তেমনি আমাদেরও বলতে হবে, গণতন্ত্রের অবিমিশ্র গুণাবলির মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার চেয়ে ভালো কোনো শাসনব্যবস্থাও নেই। সাংবাদিক মরহুম আহমেদ মাহমুদুল কবির তাপস বিএসএসের সাংবাদিক ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেছেন।

সম্প্রতি পাওয়া তার ডাইরিতে লেখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ও মন্তব্য সমসাময়িককালের জন্য প্রযোজ্য মনে হওয়ায় আমরা তা সবার সামনে তুলে ধরছি।

সাংবাদিক তাপস লিখেছেন, উইনস্টন চার্চিল যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তখন এক কার্টুনিস্ট প্রতিদিন ব্যঙ্গ করে পত্রিকার পাতায় তার ছবি একে সমলোচনা করতেন। হঠাৎ একদিন পত্রিকার পাতায় কার্টুন দেখা গেল না। চার্চিল খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ওই কার্টুনিস্ট অসুস্থ। প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এরপর তার বাসায় গিয়ে হাজির। তিনি কার্টুনিস্টকে বললেন, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও এবং তোমার কাজ শুরু করো। কারণ তোমার মাধ্যমে আমি জানতে পারি আমার সরকার কেমন চলছে।

চার্চিলের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন হিটলারের চরম আঘাতেও টিকে ছিল এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। যুদ্ধকালীন ব্রিটেনে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয় এবং সেখানে লেবার পার্টিসহ অন্যান্য পার্টিকে শরিক করা হয়। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে চার্চিলের দল হেরে যায়। তিনি তার জাতিকে চরম দুর্দিনে তার অমর ভাষণে জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন এই বলে ও যধাব হড়ঃযরহম ঃড় ড়ভভবৎ নঁঃ নষড়ড়ফ, ঃড়রষ, ঃবৎিং ধহফ ংবিধঃ. সেই চার্চিল পরাজয়কে নিশঙ্ক চিত্তে মেনে নিয়েছিলেন এবং বললেন, ‘এটিই গণতন্ত্র’। চার্চিলের পরে লেবার পার্টির ক্লিমেন্ট এটলি প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ভারতবিভক্তির বিরোধী ছিলেন। চার্চিল বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতবিভক্তির পক্ষে যে জোরালো বক্তব্য দেন ইতিহাসে তা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তার ওই ভাষণের পর মুসলিম লীগ নেতারা নতুন উদ্যোগে পাকিস্তান দাবির পক্ষে আওয়াজ তোলেন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো জোরালোভাবে পরিচালনা করেন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসেই ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। সেই বিভক্তির ফসল হিসেবে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। ১৯৫১ সালে চার্চিল আবারো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

সাংবাদিক তাপস লিখেছেন, বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ এক ফরমান জারি করেন যে, প্রতিটি মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা নিঃসঙ্কোচে ও নির্দ্বিধায় যেন তার শাসনের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি প্রতিটি মসজিদে গুপ্তচর পাঠাতেন। দূতরা ইমামদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে সুলতানের কাছে জমা দিতেন। সুলতান এসব লিপিবদ্ধ বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতেন। গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের আমলে চীনের সাথে বাংলার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং দু’টি দেশ উপহার বিনিময় করত। ওই সময়েই গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের এক আঞ্চলিক সেনাপতি বৃহৎ খুলনা-যশোহরের বহু এলাকা করায়ত্ত করেন। তিনিই বাগেরহাটের বহুল আলোচিত মরহুম খানজাহান আলী।

সাংবাদিক তাপস বলতেন, এই পৃথিবীতে একেক এলাকায় একেক ধরনের গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। একটি জাতির রাজনৈতিক মনোভাব, মূল্যবোধ, অনুভূতি, জ্ঞান, দক্ষতা বা দুর্বলতায় তার রাজনীতিতে নতুন ধরনের এক ঢ়ড়ষরঃরপধষ পঁষঃঁৎব-এর বিকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এসব দেশের ইষরংৎপং-কে গধঃধৎবফ ঢ়ড়ষরঃরপধষ পঁষঃঁৎব বলা যেতে পারে। ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের প্রায় সব ক’টি দেশে এই পদ্ধতি অনুসারের এবং এই দেশগুলোর জনগণ আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন। তাদের শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছে। শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা খুবই সীমিত এবং অভ্যাসগতভাবে সমগ্র জাতি, নাগরিক, সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বস্ত। তিনি বলতেন, পৃথিবীর এমন কয়েকটি দেশ আছে যেখানে রাজতন্ত্র নেই; কিন্তু ক্ষমতাসীন শাসক বহু বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। এই উদাহরণ হলো কিউবা, মিসর, ভেনিজুয়েলা, আলজেরিয়া এবং পূর্বের ইরাক ও লিবিয়া। জনগণের মধ্যে, এসব দেশে কোনো মেরুকরণ নেই। থাকলেও প্রকাশ পাবে না। এখানে সরকার বেসামরিক; কিন্তু তাদের ওপর সেনাবাহিনীর চাপ থাকে প্রবল। জনগণ সাধারণত নীরব থাকে অথবা রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সান্ত্বনা পায়।

আবার বেশ কয়েকটি দেশ আছে সেখানে একধরনের নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজ করছে বহুকাল ধরে। এ দেশগুলোতে অসংগঠিত জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রেও দুর্বল। তারা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই বিভক্ত। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেÑ চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, কিউবা অন্তর্ভুক্ত। বাংলা অঞ্চলে গত শতাব্দীর বিশের দশকের মাঝামাঝি সীমিত আকারে ব্রিটিশরাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করে। ভোটের মাধ্যমে নাগরিকদের মতামত প্রদর্শনের এই প্রথা তাদের সৃষ্টি হলেও ভারতবর্ষে সেই প্রাচীন যুগে রাজা-মহারাজাদের আমলে পঞ্চায়েত প্রথার মতো স্থানীয় সরকারপদ্ধতি চালু ছিল। বাংলায় মাৎস্যন্যায়ের যুগের গোপালকে নির্বাচিত করেছিল বিশিষ্ট জনগণ ও অমাত্যগণ। তাদের ভোটের পদ্ধতি আধুনিক যুগের মতো না হলেও তখন যে জনমত কোনো-না-কোনোভাবে এবং কখনো, কখনো রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিফলিত হয়নি এমনটি বলা যাবে না। আধুনিক গণতন্ত্রের জনক ইংল্যান্ডে এ কথা সত্য হলেও আরব দেশে মদিনার সনদ ও খলিফা নির্বাচনপদ্ধতি ইংল্যান্ডের ভোট প্রথা প্রচলনের বহু আগেই সংগঠিত হয়েছে। ইংরেজরাও বাংলায় লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি চালু করে ১৯৩৫ সালে। তার আগে ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা বোর্ড, মিউনিসিপ্যালিটি ও কলকাতা করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে এবং এ দেশের জনগণ এসব নির্বাচনেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৩৭, ১৯৪৬, ১৯৫৪, ১৯৭০ সালের নির্বাচনগুলো বাংলাদেশে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। এর কোনোটি যদি দিনের ভোট রাতে, আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো, সিল মারো ভাই সিল মারো- এমন কিসিমের নির্বাচন হতো, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রলম্বিত হতো। সাংবাদিক তাপস বলতেন, নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের বড় উৎসব। সেই নির্বাচন এ দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। বর্তমান বিশ্ব গণতন্ত্রের জয়গানে মুখর। আজো পৃথিবীতে গণতন্ত্র সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা হিসেবে সুবিবেচিত। গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও চিন্তাভাবনার ব্যাপক প্রভাবে বর্তমান জগতে অন্যান্য শাসনব্যবস্থার ধারণা হীনমান। তবে একে সফল করে তোলা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায়, গণতন্ত্র ছাড়া অপর কোনো সরকারব্যবস্থা তার নিজের জনগণের কাছে তত বেশি দাবি করে না, তেমনি গণতন্ত্র ছাড়া অপর শাসনব্যবস্থা তার নাগরিককে অত বেশি দানও করে না। গণতন্ত্রের দুর্বলতা এই যে, গণতন্ত্র মানবিক এই ব্যবস্থাকে যদি মানুষ তার আদর্শের গভীরে প্রবল বিশ্বাস ও কঠিন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে সাফল্য লাভ না করার কোনো কারণ নেই।

সাংবাদিক তাপস আজ জীবিত নেই। গত ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেছেন। রাজনীতিবিদ নওগাঁর আলমগীর কবিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। তার বাবা যখন সরকারে দায়িত্বে ছিলেন কেউ তাকে কোনোদিন সচিবালয়ে দেখেনি। তার ভেতর রাজনীতির, শিক্ষার ও অর্থের কোনো দম্ভ ছিল না। তিনি আর কোনো দিন কোনো ছলনায় এ পথ মাড়াবেন না। কাউকে কোনো প্রশ্নও করবেন না। কোনো কিছু জানতেও চাইবেন না। একদা তৎকালীন রাজশাহী জেলার জনগণের মনে স্বাধিকার ও সচেতনতা বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে যারা সচেষ্ট ছিলেন তাদের সাথে যুক্ত হয়ে আছে তার পরিবারের নাম। সেই পরিবারের সাথে যুক্ত হয়ে গেল আরেকটি নাম। সে নাম সাংবাদিক আহমেদ মাহমুদুল কবির তাপস। আমাদের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ গাইবে সে নামের জয়গান।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক

 


আরো সংবাদ



premium cement