১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
গাজাযুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু - ছবি : সংগৃহীত

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে ইসরাইলকে চাপ দেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে অনীহা তার পরিণতি হবে মারাত্মক, আর তা কেবল ফিলিস্তিনিদের জন্য ভয়াবহ হবে না।

হামাস একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিয়েছে বলে ৫ মের ব্রেকিং নিউজটি সমগ্র গাজাজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ফিলিস্তিনের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে উল্লাস করতে। কিন্তু তাদের সে আনন্দ ছিল ক্ষণস্থায়ী, কারণ ওই দিন ইসরাইল রাফাহ শহরে মারাত্মক স্থলহামলা চালায়।

ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র কয়েক সপ্তাহ ধরে হামাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিল যে, তাদের অবস্থান যুদ্ধবিরতি আলোচনার অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করছে। এর পরে হামাস একটি যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়ার এ কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয় যা কার্যকরভাবে তার শত্রুদের ঘায়েল করেছে। বল এখন ইসরাইলের মাঠে এবং আরেকটু বাড়িয়ে ইসরাইলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের মাঠে।

হামাসের সম্মতির পরও যদি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পন্ন না হয়, তাহলে এটি উন্মোচিত হয়ে যাবে যে, ইসরাইল শান্তির প্রকৃত বিনষ্টকারী এবং যুক্তরাষ্ট্র এক অসৎ মধ্যস্থতাকারী।
ইতোমধ্যে এমন সব ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, ওই দু’টি দেশ গাজাযুদ্ধ নিয়ে প্রকৃতপক্ষে একটি খেলায় মেতেছে। তারা এখন বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের কাছে গাঁজাখুরি কথাবার্তা ফেরি করার চেষ্টা করছে যে, হামাসের কাছে যে চুক্তির খসড়া পেশ করা হয়েছে সে বিষয়ে ইসরাইল কিছু জানত না। সেই সাথে এটিও বিশ্ববাসীকে গেলানোর চেষ্টা করছে যে, যুক্তরাষ্ট্র রাফাহ শহরে ইসরাইলি অভিযানের বিরোধী।

ওই উভয় বক্তব্য বিশ্ববাসীর মনে বিস্ময় এবং বিভ্রান্তির উদ্রেক করা সত্ত্বেও, এটি একদিক থেকে ভালো এজন্য যে, এরপর কী ঘটবে বিশ্বের মানুষ আসলে সেটা জানত এবং ধারণাও করেছিল।

ইসরাইল দাবি করেছে, তারা চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করছে এ কারণে যে, এতে অন্তর্ভুক্ত নতুন বিধিমালার বিষয়ে তারা জানত না, অথচ এমন খবর বেরিয়েছে যে, সিআইএ প্রধান বিল বার্নস, যিনি আলোচনায় ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, ইসরাইলি পক্ষকে চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে ব্রিফ করেছেন এবং ইসরাইলের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘চিরঅটুট’ (ironclad) সমর্থন দেয়ার কথাও জানিয়েছেন, সুতরাং বাইডেনের প্রশাসন তার মিত্রদের স্বার্থের পক্ষে যাবে না এমন কোনো চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবে এমন সম্ভাবনা খুব সামান্য।

যুক্তরাষ্ট্র নিজে দাবি করেছে যে, তারা গাজায় ইসরাইলি স্থলহামলার কঠোর বিরোধী। কিন্তু তার পরও স্থলহামলা শুরু হওয়ার পর বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল হামলার নিন্দা করা নয় বরং হামলার বিষয়টিকে খর্ব করে দেখানোর চেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, যে অনুমিতভাবে এটি সেরকম সর্বাত্মক আক্রমণ নয় যেমনটা সবাই ধারণা করেছিল, এটি একটি ‘সীমিত’ অপারেশন ছিল। এভাবে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করে যে, ইসরাইলের পরিকল্পনা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে জানত।

এ প্রেক্ষাপটে, ইসরাইলের আরেকটি ‘সীমিত’ অপারেশনের কথা স্মরণ করা জরুরি যুক্তরাষ্ট্র যেটির বিরোধিতা করেছিল বলে কথিত আছে, যা কার্যত সেরকম ‘সীমিত’ থাকেনি। ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইলি আগ্রাসনের শুরুতে, তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিন দাবি করেছিলেন, উত্তর ইসরাইলে বোমাবর্ষণকারী ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবস্থান ‘নির্মূল’ করতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী লেবাননি ভূখণ্ডের মাত্র ৪০ কিলোমিটার (২৫ মাইল) পর্যন্ত প্রবেশ করবে।

কিন্তু বিস্ময়ের কোনো অবকাশ না রেখে, ইসরাইলি সৈন্যরা ৪০ কিলোমিটারে থামেনি; তারা পুরো ১১০ কিলোমিটার (৬৮ মাইল) দূরত্ব অতিক্রম করে রাজধানী বৈরুতে প্রবেশ করে এবং সেটি দখল করে নেয়। এ প্রতারণা ঢাকার চেষ্টায় ইসরাইলি সরকার দাবি করেছিল যে, ‘মাঠের পরিস্থিতি’র কারণে সর্বাত্মক আগ্রাসন চালানোর দরকার ছিল। আক্রমণের ন্যায্যতা প্রতিপন্নে এ এক দুর্বল যুক্তি যেটি তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার হেগও পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত ইসরাইলিরা লেবানন থেকে সরে আসেনি।

গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের চলমান এ যুদ্ধের সময়, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরাইলকে প্রকাশ্যে এমন কোনো সতর্কবার্তা দেয়া হয়নি যা ইসরাইল মেনে নিয়েছে। ফলে কার্যত এটি অস্পষ্ট যে, ইসরাইলের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এ ধরনের সতর্কতাগুলো আদৌ ইসরাইলি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে নাকি নিছক লোকদেখানো। এ অর্থে, লবণস্বরূপ নেয়া যেতে পারে খবরটি যে, রাফায় সর্বাত্মক আক্রমণ বন্ধের লক্ষ্যে বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলের জন্য অনুমোদিত অস্ত্রের একটি চালান আটকে রেখেছে।

কথিত এ ‘সীমিত’ অভিযানের প্রেক্ষাপটে, এটি উদ্বেগজনক যে যুক্তরাষ্ট্র মিসরের সাথে যুক্ত রাফাহ ক্রসিংয়ের ফিলিস্তিনি অংশ দখলে ইসরাইলি বাহিনীকে গোপনে অনুমোদন দিচ্ছে।
রাফায় ইসরাইলের ফিলিস্তিনি ক্রসিং পয়েন্ট দখল শুধু গাজায় আতঙ্কের সৃষ্টি করেনি, সেখানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ত্রাণসাহায্য সরবরাহ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হওয়ার কারণেও মানুষজন আতঙ্কিত। তবে কায়রোও এ বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কায়রো এ হামলার নিন্দা করেছে।

মিসর অতীতে বারবার সতর্ক করেছে যে, ফিলাডেলফি করিডোরের ফিলিস্তিনি অংশে ইসরাইলি সৈন্যদের উপস্থিতি হবে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি এবং ফিলাডেলফি প্রটোকলের লঙ্ঘন। ফিলাডেলফি প্রটোকল অনুযায়ী অঞ্চলটি হবে একটি অসামরিক অঞ্চল।
ইসরাইল এবং মিসরের মধ্যে ক্যাম্পডেভিড শান্তিচুক্তি হয়েছিল ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়। ওয়াশিংটন এ চুক্তির গ্যারান্টর বা জামিনদার। ২০০৫ সালে ইসরাইল গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পর ফিলাডেলফি প্রটোকল যোগ করে চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। তখন থেকে মিসর চুক্তির বিধান মেনে চলছে, কিন্তু এখন ইসরাইল সেটি আর মানছে না বলে মনে হচ্ছে।

বাইডেন প্রশাসন ভাবতে পারে যে, রাফায় ইসরাইলি আক্রমণকে ‘সীমিত’ হিসেবে উপস্থাপন করে তারা সফলভাবে সমালোচনা থামিয়ে দিতে পেরেছে, তবে মার্কিন-সমর্থিত চুক্তি লঙ্ঘন করে ক্রসিং দখল একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের স্বাক্ষর করা কোনো চুক্তি পায়ে মাড়িয়ে যেতে দেশ দু’টির বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।
ওয়াশিংটনের কাঁধে এ দায় চাপছে যে, গাজায় পরিচালিত নৃশংসতার আইনি পরিণতি থেকে ইসরাইলকে রক্ষা করতে ওয়াশিংটন তার পথ থেকে সরে যাচ্ছে এবং এভাবে আন্তর্জাতিক আইনের অবজ্ঞা করছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো ‘বাধ্যতামূলক নয়’ বলে অভিহিত করেছেন, গাজার পরিস্থিতিকে ‘দৃশ্যত’ গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নিন্দা করেছেন এবং ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন।

পরিস্থিতি এখন যেমন দাঁড়িয়েছে যে, বাইডেন নভেম্বরের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার দিকে যাচ্ছেন। রেখে যাচ্ছেন এমন এক ভয়ঙ্কর উত্তরাধিকার, যা গাজায় নির্বিচার গণহত্যার ঘটনা দেখেও দেখে না এবং আরো নৃশংসতা ও দায়মুক্তির পথ প্রশস্ত করতে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে।

গতিপথ পরিবর্তনে এখনো খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। হামাসের সাথে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে, গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করতে, অবরোধ তুলে নিতে এবং úূর্ণ মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার এবং পুনর্গঠন শুরুর অনুমতি দিতে বাইডেনকে অবশ্যই ইসরাইলের ওপর বাস্তব ও সিদ্ধান্তমূলক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

তরজমা : মুজতাহিদ ফারুকী
৮ মে আলজাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধ। দাউদ কুত্তব পুরস্কার পাওয়া ফিলিস্তিনি সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement