১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চলছে ভ্রাতা-ভগ্নি-শ্যালকের শাসন

চলছে ভ্রাতা-ভগ্নি-শ্যালকের শাসন - নয়া দিগন্ত

দেশে টানা তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালে একদলীয় নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের নির্বাচন, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়ার পর তাকে নির্বাচনের মাঠে থাকতে দেয়া হয় নাই। মাত্র সাত আসন হাতে ধরিয়ে দিলো সরকার। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি এবং তার জোটসঙ্গী নির্বাচনে অংশ নেয় নাই। একদলীয় একটি নির্বাচন করা হলো, যে নির্বাচনটির নাম দেয়া হলো ডামি এবং ডেমি এবং জাতীয় পার্টির সাথে ভাগাভাগি করল সরকার। যে নির্বাচনে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারল না। তিনটি নির্বাচনেই মানুষ পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারল না। গণতান্ত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করা হলো। এখন একদলীয় সরকারই স্থানীয় সরকার তথা উপজেলা নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনটা হবে আওয়ামী লীগের পরিবারের নির্বাচন। পরিবারতন্ত্রের নির্বাচন। একটি পরিবারের যেমন চার ভাই থাকলে পিতা সম্পত্তির ভাগ করে; ঠিক তেমনই উপজেলা নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে ভাগাভাগির নির্বাচন। দুঃখের বিষয় একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও সুশীল বলে দাবিদার ব্যক্তিরা এ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেননি। তারা কথা বলেন না।

একটি উদাহরণ দিই। সাবেক একজন রাষ্ট্রপতি নিজে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এখন উনার ছেলে এমপি, ছোট বোন উপজেলা চেয়ারম্যান, ছোট ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ভাগ্নে শিক্ষা অধিদফতরের ডিজি ছিলেন, উনার পুত্রবধূ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। উনার ভাতিজা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। একটি পরিবারই আওয়ামী লীগের রাজত্ব করেছে, অন্যরা হলো প্রজা। সারা বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে স্বামী এমপি, স্ত্রী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, শ্যালক আওয়ামী লীগের নেতা। দেশ চলছে ভ্রাতা, ভগ্নি, শ্যালকের শাসনে। এ যেন পরিবারের রাজতন্ত্র। এ থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমরা ভোট দিতে চাই, আমরা চাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। পিতা মুসলিম লীগের নেতা ছিল, পুত্র আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান, পিতা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল, পুত্র আওয়ামী লীগ ইউনিয়নের সভাপতি। সেই মুসলিম লীগের নব্য আওয়ামী লীগাররা ইটনা উপজেলা জয়সিদ্ধি বাজারে মনু মিয়ার জায়গা জমি দখল করে রাজত্ব কায়েম করে। নব্য কুতুব মুন্সি তার ছেলে মাইনুদ্দিন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়াই এদের কাজ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করাই এদের লক্ষ্য। আমার বাড়ির এক অংশে বেআইনিভাবে জোরপূর্বক কিছু জায়গা দখল করে রাখছে। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

আমরা ঐতিহ্যগর্বে গর্বিত। আমরা স্বাধীনতা এনেছি, ভাষা-সংগ্রাম করেছি, আমাদের স্বার্থবিরোধী শিক্ষা কমিশন বানচাল করেছি, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ জীবনের ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশকে, জাতিকে স্বাধীন করেছি, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক হয়েছি, স্বৈরাচারী জঙ্গি শাসককে বিতাড়িত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও চালু করেছি। আমাদের মধ্যে এখন বিদ্বান-বুদ্ধিমান, জ্ঞানী-গুণী, স্থপতি-ভাস্কর-চিত্র-কবি-ডাক্তার-উকিল-বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হয়েছে। কাজেই আমাদের গৌরবের-গর্বের অন্ত নেই। ফলে আমরা অতীতের ঐতিহ্যের স্মৃতি রোমন্থনে নিপুণ ও অভ্যস্ত হয়েছি। আজো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ও রক্তদানের আর মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানের কথা স্মরণ করি, আর প্রতিদিনই ইতিবৃত্তরূপে, নাটকরূপে, স্মৃতিকথারূপে, গল্প-কবিতা-গানরূপে আর উপন্যাস আকারে আমরা অনেক অনেক বড়-ছোট-মাঝারি বই লিখেছি, ছেপেছি, পড়েছি, গুণে-মানে মাপে মাত্রায় যে স্তরেরই হোক না কেন! আমাদের নতুন চেতনার, নতুন চিন্তার, নতুন সৃষ্টির নমুনা মেলে না সহজে কারো মধ্যে।

কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না ক্ষুধা-তৃষ্ণা যেমন রোজ বারবার মেটাতে হয়, তেমনি ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক, শৈল্পিক, সাংস্কৃতিক, সরকারি ও রাষ্ট্রিক জীবনে প্রতিদিন নব নব উদ্যমে, নব নব উদ্যোগে, নব নব আয়োজনে, নতুন নতুন চিন্তা প্রয়োগে, মন-মগজ-মনন-মনীষার নিয়মিত অনুশীলনে দেশ-জাতি-রাষ্ট্র-মানুষ প্রভৃতির সামগ্রিক, সামূহিক ও সামষ্টিক উন্নয়ন-উৎকর্ষ সাধন করতে হয়। পিতৃধনের ক্ষয় আছে, বৃদ্ধি নেই, পুরাতন জৌলুস হারায়, নতুনে থাকে উপযোগ, প্রয়োজন পূরণের শক্তি, চাহিদা মেটানোর যোগ্যতা, আর থাকে মনোহারী চাকচিক্য।

আমাদের চারদিককার শিক্ষিত শহুরে লোকদের দেখে মনে হচ্ছে, আমরা মানসক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি, আমরা এখন কেবল সন্তান নিজের জন্যই বাঁচাকে জীবনের পরম ও চরম তত্ত্ব বলে মেনে নিয়েছি। দেশ ও মানুষের মঙ্গল করার চিন্তা এখন সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে।

সাধারণভাবে শিক্ষিতরা হচ্ছে ‘ইন্টেলিজেনশিয়া’ আর মনীষীরা হচ্ছেন ‘ইন্টেলেকচুয়াল’। বাঙলায় ইন্টেলিজেনশিয়াদের বলা হয় ‘বুদ্ধিজীবী’। শব্দটা পরিভাষা হিসেবে স্বীকৃত, গৃহীত ও সর্বজন ব্যবহৃত বটে, তবে যেহেতু জীব-উদ্ভিদ সবাই বুদ্ধি দিয়েই আত্মরক্ষা ও আত্মবিস্তার করে, সেহেতু বুদ্ধিজীবী তাৎপর্যরিক্ত পরিভাষা। বরং মানসিক বা মগজি শ্রমজীবী হিসেবে এদের মগজি বা মস্তিষ্কজীবী বলে অভিহিত করলে কিছুটা অর্থজ্ঞাপক হতো। ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী সবাই বিশেষ করে যারা কাগুজে বিবৃতিতে সই করে, মেঠো বক্তৃতায় অংশ নেয় কিংবা মিলনায়তনে প্রেক্ষাগৃহে সেমিনারে সভায় ভাষণ দেয় এবং বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে মিছিলে শামিল হয়। তারাই আমাদের চকচকা মধ্যবিত্ত। সুশীলসমাজ।

পুরোনো নীতি-নিয়ম, রীতি-রেওয়াজ, প্রথা-পদ্ধতি, বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা- আচার আচরণ বর্জনের সাহস রাখেন। এমনি জ্ঞান-প্রজ্ঞা, যুক্তি-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, শক্তি-সাহস, উদ্যম-উদ্যোগ অঙ্গীকারে প্রাণিত ব্যক্তিদেরই অবদানে আজকের বিশ্বের সংস্কৃতি-সভ্যতার, চেতনার-চিন্তার, প্রগতির প্রাগ্রসরতা এসেছে।

কিন্তু আমার দেশের বুদ্ধিজীবীরা নানা ভাগে বিভক্ত। নিজকে নিয়ে ব্যস্ত। সামরিক শাসক এরশাদের সময়ের কথা, সেসময়ে প্রতিদিন ধরপাকড় চলেছে, প্রতি মাসে গুলি চলেছে প্রতি বছরেই জনগণের রুদ্ররোষ উথলে উথলে উঠেছে। এসবের মধ্যে দেশের বুদ্ধিজীবীরা কোনো জাতীয় সম্ভাবনা আঁচ করতে পারেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দুই যুগ, এক যুগ, ছয় যুগ, দুই বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোনো বইতে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তার ছিটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পায় নাই।

বাংলাদেশের জনগণই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। এর সাথে আছে রাজনৈতিক নেতাদের কথা। এসব বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। আমাদের সমাজ একটি পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সমাজের খোল-নলচে দুই-ই বদলে নতুন সমাজ সৃজন করার জোরালো দাবি সমাজের মর্মমূল থেকেই তীব্রবেগে স্ফুরিত হয়েছে। এ সৃজন প্রক্রিয়াতে বেগ এবং পূর্ণাঙ্গতা দান করতে হলে, রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে ওঠা।

আমাদের দেশের জনসাধারণ ভুল করেননি এবং খুব কমই বিভ্রান্ত হয়েছেন। যখনই কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থের এবং বাস্তব জীবনধারার বিপক্ষে গেছে তারা কোমর বেঁধে পৌরুষের সাথে প্রতিবাদ করেছেন। জনগণের চিন্তাধারায় অগ্রসরমানতা এবং পরিচ্ছন্নতা দেয়ার মতো কোনো সাংস্কৃতিক প্রয়াস হয়নি বললেই চলে। এখানে একটা কথা বলে দেয়া প্রয়োজন, ভাষার প্রশ্নে আমাদের দেশের কোনো পণ্ডিত বাংলাভাষার সপক্ষে মতামত রেখেছিলেন, কিন্তু তা এত ক্ষীণ, অস্পষ্ট এবং সংশয়াচ্ছন্ন যে, জনগণের মধ্যে তার খুব সামান্যই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সুতরাং যা ঘটবার ঘটে গেল। ছাত্র-তরুণেরা প্রাণ দিলো দেশে আগুন জ্বলে উঠল। আর কবি-সাহিত্যিকেরা শোকসভায় সভাপতির আসন দখল করলেন প্রবন্ধে-কবিতায় এক কলসি করে অশ্রু বিসর্জন করলেন।

ঊনিশ শ’ বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের পরপর এ দেশের সংস্কৃতির একটা পটপরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছিল। এ সময়ে আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কতিপয় স্পর্ধিত তরুণের আবির্ভাব লক্ষ্য করি। তাদের দেখবার চোখ, চিন্তা করার ভঙ্গি, বিচার করার পদ্ধতি পাকিস্তানি-বাদী বুদ্ধিজীবী ও শিল্প-সাহিত্যের মুরব্বিদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মের জং ধরা খোলস প্রাণশক্তির তোড়ে ফাটিয়ে ফেলার যে স্পর্ধিত স্পৃহা তাদের মধ্যে দেখা গেছে তা প্রশংসা করার মতো। আজকের দিনে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, তাদেরকে পরিণত চিন্তার অধিকারী এবং স্থিতধী হিসেবে দেখতে পাওয়াটা খুবই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু বাস্তবের সঙ্ঘাতে জাতির সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশের যেসব কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সমালোচকের নাম তখন হামেশা শোনা যেতো তাদের শতকরা আশি ভাগই মার্কিনি প্রচারের অনুবাদ করেছেন। এটা খুবই দুঃখের কথা যে, আমাদের সংস্কৃতির যারা শ্রদ্ধেয় লোক বলে খ্যাত মার্কিনি অর্থের বিনিময়ে মানসিক দাসত্ব করেছেন এবং তা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও গণ-সংগ্রামের বিপক্ষে গেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা ও দূরদর্শিতার অভাবের দরুন ধীরে ধীরে সংস্কৃতি এবং রাজনীতি একে-অপরের পরিপূরক না হয়ে দুটি আলাদা জলঅচল কুঠুরিতে পরিণত হলো। রাজনীতি হলো মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখলের অস্ত্র আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের, কবি-সাহিত্যিকদের বিলাসের, চিত্তবিনোদনের উপায় হয়ে দেখা দিয়েছে।

এ সময়ে জঙ্গিলাট আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলেন। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রী শ্রেণি সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন আমলা এবং টাউট শ্রেণি। আইয়ুবের সিংহাসন ধরে ঝুলে থাকা এ শ্রেণিগুলোর পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদেরও একটা শ্রেণি একনায়ক নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে নিলেন। আইয়ুব খানের রাজত্বে একটা রাজনীতি উত্থানপতন জয়-পরাজয়ে সংস্কৃতির যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আদপেই সে বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল মনে। একটি সমাজের সর্বাঙ্গীণ গতির নাম রাজনীতি এবং সংস্কৃতি রাজনীতির রস-রক্ত, এ বোধে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা লোকমান্য নেতার মন শিক্ষিত হয়েছে, তেমন কোনো দল বা ব্যক্তিত্বের নাম আজো জানা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিবিমুখতা, কর্মীদের চেতনাহীনতা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে দুটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করল। ফরাসি লেখক আলফাস দোঁদের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ফরাসিরা যুদ্ধে মার খেয়েছে, গল্পের নায়ক খুবই আশাহত হয়ে পড়েছে, আরেকজন তাকে উপদেশ দিচ্ছে ফরাসি সাহিত্য পড়ার। তার মানে ফরাসি সাহিত্যের মধ্যে এমন কিছু প্রাণদায়িনী উপকরণ রয়েছে, যার প্রভাবে নায়ক যুদ্ধে পরাজয়ের হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারবে। পুরোপুরি না হোক, আংশিকভাবেও যদি আমাদের জাতি এ মনোভঙ্গি আয়ত্ত করতে না পারে, তাহলে বলতে হয় আমাদের বর্বর-দশা এখনো কাটেনি।

ভাষা আন্দোলনের পরে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হতো পোকায় কাটা প্রাচীন কাব্য অনুগত ছাত্রদের ফিসফিস করে পড়ানোর মধ্যে, অবসরভোগী চাকুরেদের অলস বিশ্রম্ভালাপে, মেদবহুল বাংলার অধ্যাপকের রেডিও টকের বাগবিস্তারে এবং রবীন্দ্রবিলাসী মহিলাদের পূর্ণিমাবাসর রচনায়। কখনো কখনো দুয়েকটি ব্যতিক্রমী পত্রপত্রিকা চোখে পড়ত। গোটা দেশের বিচারে তা আর কত।

রাজনীতি আর সংস্কৃতি আলাদা হয়ে পড়লেও বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি এমনভাবে প্রাণ স্পন্দনহীন হয়ে থাকার কথা ছিল না। যেটুকু প্রাণের লক্ষণ ছিল মার্কিন ডলার একেবারে থেঁতলে দিয়ে গেল। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বাংলাদেশের অধ্যাপক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকদের চড়া দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেল। যে লেখক একটা গল্পের বই কিংবা উপন্যাস প্রকাশ করে বছরে দু’ শ’ টাকা আয় করার ভরসা করতে পারতেন না, সেই একই লেখক মার্কিন বইয়ের সের মাপা অনুবাদ করে মাসে আড়াই হাজার কামাতে লাগলেন।
অতএব, আমাদের কেবল প্রকাশ্যে গোপনে অর্থসম্পদ অর্জন করে গাড়িবাড়ির মালিক হয়ে আহার নিদ্রায়, বিলাসে-ব্যসনে, ভোগে-উপভোগে ব্যক্তিক বা পারিবারিক জীবন যাপনে তুষ্টপুষ্ট থাকলে চলবে না। দেশ-রাষ্ট্র-জাতি মানুষের কথা ভাবতে হবে। তারা যেন দীনহীন, সুখহীন, নিশিদিন পরাধীন না থাকে সেই চেষ্টায় আমাদের থাকতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট, ’৯০-এর সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সাবেক ছাত্রনেতা


আরো সংবাদ



premium cement