১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দুই ব্যাংক এক হতে দোষ নেই তবে...

দুই ব্যাংক এক হতে দোষ নেই তবে... - ফাইল ছবি

দু’টি প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়া বা ‘মার্জার’ নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিশে^ নামীদামি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হরহামেশাই এ ধরনের ‘অ্যাকুইজিশন’ ‘অ্যালায়েন্স’ কিংবা ‘মার্জার’ ঘটে থাকে। আমাদের দেশে আন্তঃপ্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়ার নজির বেশি না থাকলেও হালে সবল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংকের একত্রীকরণ নিয়ে এক নতুন বাস্তবতার সূত্রপাত ঘটেছে। ব্যাপক কৌতূহল ও আলোচনার সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। অবশ্য ২০১৬ সালেই বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ‘ফোরাম’ দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সচ্ছল ও সবল ব্যাংকগুলোর সাথে একত্রিত হওয়ার পরামর্শ দেয়।

এই একত্রীকরণের প্রশ্নটি আসছে কেন? তাহলে কি দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল? এগুলো যে রাজনৈতিক আনুকূল্যে গড়ে উঠেছিল, সে কথা তো বলাই বাহুল্য। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত নানা অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের কারণে যে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছিল, সে কথা স্বীকার করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোর একত্রীকরণের প্রয়োজনে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও তিনি ব্যাংক পরিচালকদের সহায়তা চেয়েছিলেন। ২০১৯ সালে এসে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর দুর্বল হয়ে পড়ার কথা কবুল করেন। পরবর্তীকালে নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ভালোভাবে চলতে পারছে না। ওই পর্যায়ে এ দুর্বল ব্যাকগুলোর সাথে সবল ব্যাংকগুলোর ‘মার্জ’ করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই লক্ষ্যে নতুন আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হবে বলেও জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ পরপর দু’জন অর্থমন্ত্রীর এই উপলব্ধি ও ঘোষণা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কার্যব্যবস্থা নিতে নিতে চারটি বছর কেটে গেছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবেও কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে।

তবে, এখানে ব্যাংক ‘একত্রীকরণ’ কিংবা ‘একীকরণ’ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে, এমনকি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও, বাস্তবতা অনুধাবনের ক্ষেত্রে তারতম্য লক্ষ করা যাচ্ছে। সাধারণত ‘একত্রীকরণ’ (মার্জার) বলতে ব্যবসায়ী কৌশল এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অধিক শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনকে বোঝানো হয়। দু’টি প্রতিষ্ঠানের একক মালিকানা ও ব্যবস্থাপনাধীনে ব্যয় সঙ্কোচন, নতুন বাজার দখল, বাড়তি মুনাফা অর্জন প্রভৃতি অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে চুক্তির মাধ্যমে একীভবন বা একত্রীকরণকে বোঝায়। দু’টি পৃথক প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত রূপান্তরের মাধ্যমে এভাবে ‘একত্রীকরণের’ নজির সারা পৃথিবীতেই রয়েছে। অন্য বিবেচনায় যখন একটি পক্ষ অপর পক্ষের তাবৎ বা বেশির ভাগ শেয়ার ক্রয় করে নেয়, তাকে বলে অধিগ্রহণ (অ্যাকুইজিশন)। সে ক্ষেত্রে অধিগ্রহণকৃত ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা তাদের মালিকানা প্রত্যাহারও করতে পারেন; অথবা ক্রেতা পক্ষের ব্যবস্থাপনার মধ্যে অবস্থানও করতে পারেন।
অন্যান্য দেশে যেভাবে ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একীভবন বা অধিগ্রহণ ঘটে, সেগুলোর প্রেক্ষাপট একেক জায়গায় একেক প্রকারের। বিশ্বে এ পর্যন্ত যে ৩৪টি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘একীভবনের’ ঘটনা ঘটেছে সেখানে বাধ্যতামূলক কিংবা স্বেচ্ছাধীন বিবেচনা উভয়ই রয়েছে। পদ্ধতি যাই হোক না কেন, একত্রীভবনের মূল লক্ষ্য হলো বিভিন্ন সবল ও দুর্বল ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রীকরণের মাধ্যমে গোটা ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুধাবন করতে পেরেছে যে, সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাস বা পুনর্গঠনের মূল উদ্দেশ্য দুর্বল ব্যাকগুলোকে পুনরুদ্ধার করা নয়; বরং তাদের কাছে সাধারণ আমানতকারীদের যে অর্থসম্পদ আমানত আকারে গচ্ছিত আছে কিংবা শেয়ারবাজারে তাদের মালিকানার যে বিন্যাস সাধারণ স্টক ক্রেতাদের দায়বদ্ধতা আছে, তার সুরক্ষা দেয়া। সর্বোপরি, আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করা। এখানে সবল বা সচ্ছল ব্যাংকগুলোর উপর দুর্বল ব্যাংকগুলোর সাথে ‘একীভবনকে’ জোর জবরদস্তি বা তদবির না করে বরং অধিগ্রাহক এবং অধিগ্রহীতার সদিচ্ছা এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও শাদি-সম্বন্ধের পছন্দের উপর ছেড়ে দেয়াটাই হবে সুবিবেচনাপ্রসূত। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি খাটানোর ফল বিষময় হতে বাধ্য। গত ২০-২২ বছর ধরে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারকার্যে একাধিক কমিটি ও প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে এসব কমিশনের সুপারিশও আংশিক বা খণ্ডিতভাবে গ্রহণ করা হয়। তবে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের নেতিবাচক মনোভাব বা মতলবের কারণে সংস্কারের কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যায়নি। ফলে অপূর্ণ সংস্কার বিদ্যমান এবং চলে আসা অসুখের উপসর্গ হয়ে আর্থিক খাতের স্বাস্থ্যহানিরই কারণ হয়েছে। দেখা যাক, শেষ নাগাদ এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ জোরালোভাবে বাস্তবায়িত হয় কি না?
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে যে চারটি প্রধান চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হলো ‘আর্থিক খাতের ঝুঁকি’। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সমন্বিত সংস্কার কর্মসূচি না নেয়া হলে তা আর্থিক খাতের চলমান ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে দু’টি ব্যাংকের একীভবন প্রসঙ্গে আরো সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ বা সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে (একত্রীকরণের) এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার।’

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আর সময় ক্ষেপণের সুযোগ না দিয়ে এখনই কঠোরভাবে তাদের পরিসম্পদের মূল্যায়ন জানা প্রয়োজন। ব্যাংকের দুর্বলতা এবং লোকসানের জন্য বিদ্যমান পরিচালকরা দায়মুক্তি পাবেন কিনা, এটিও একটি বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি যে নীতিমালা জারি করেছে তাতে বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত হবে তাদের পরিচালকরা পাঁচ বছর পর আবার একীভূত হওয়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ফিরতে পারবেন। এটি করা হলে তো দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েই গেল। তাহলে স্বচ্ছতার স্বার্থে জবাবদিহির কী ব্যবস্থা নেয়া হলো? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পাঁচ বছর চেয়ারে বসার প্রবিধান ব্যাংকগুলোতে এক ধরনের আন্তঃপরিষদ বৈষম্য সৃষ্টি করতে বাধ্য। নতুন নীতিমালায় তিন বছরের জন্য খারাপ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এতে তো ভালো ব্যাংকগুলোর কর্মী-কর্মকর্তা অবশ্যই অসন্তুষ্ট হবেন এবং কর্মপরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার বড় ধরনের ঝুঁকি থেকেই যাবে। সংস্কার করতে গিয়ে তাই অহেতুক জটিলতা ডেকে আনার কোনো মানে হয় না।


আরো সংবাদ



premium cement