মেধাহীন রাজনীতির চর্চা একটি পরিকল্পিত প্রকল্প
- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২২
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত বহু প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের জন্ম হয়েছে এই বাংলায়। এক সময় শিক্ষিত, মার্জিত, দেশপ্রেমিক ও মেধাবী ব্যক্তিরা দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ছিলেন। কিন্তু এখন তাদের জায়গা দখল করেছেন নামধারী, মেধাহীন অনেক অসৎ ব্যক্তি।
নীতি আদর্শ বাস্তবায়নে মেধা ও প্রজ্ঞার খেলা রাজনীতি। অথচ রাজনীতি এখন আর মেধা-প্রজ্ঞার খেলার অবস্থানে নেই। স্থানচ্যুত হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষা-অশিক্ষার পার্থক্য নির্ণয় করা দুষ্টক। সামাজিক মর্যাদা-অমর্যাদার ভেদবিচার করা আরো কঠিন। পদলেহন, চাটুকারী, তৈলমর্দনের আধিখ্যে দলীয় রাজনীতি কলুষিত।
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম করতে হয়েছে। এসবের পর্বে পর্বে তৈরি হয়েছে বহু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা। যারা গুণে-মানে, সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বে ছিলেন অতুলনীয়। তাদের দেখে ও সংস্পর্শে এসে মানুষ অনুপ্রাণিত হতেন। রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করতেন না। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোতে এমন গুণাবলি ঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না।
গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের রাজনীতিতে বহু তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা হতো। বিভিন্ন মতামত, মতবাদ, দর্শন, চিন্তা তথা আইডিয়া ছিল রাজনীতি চর্চার কেন্দ্রে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে যুক্তি-তর্ক, আলোচনায় সময় কাটাতেন। রাজনীতি হয়ে উঠতো জ্ঞানভিত্তিক চর্চার কেন্দ্র। ওই সময়ের ছাত্ররাজনীতি ছিল মেধাভিত্তিক। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে মোটামুটি মেধাবীদের মূল্যায়িত হতে দেখা যায়। রাজনীতিকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার মানসিকতা তখন পর্যন্ত ছিল না। বড় মাপের অনেক নেতারও বাড়ি-গাড়ি ছিল না। মন্ত্রী-এমপিদের লোভ-লালসা মগডালে পৌঁছেনি। তখন যারা ছাত্ররাজনীতি করতেন তারা ভোগ-বিলাসী জীবনের কথা কল্পনাও করতেন না। ’৯০-পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ ঘটে ভোটের রাজনীতির মধ্য দিয়ে।
নব্বই-পরবর্তী ব্যবসায়ী শ্রেণী যখন গণহারে রাজনীতিতে ঢুকতে শুরু করে তখন থেকে রাজনীতি হাতছাড়া হতে থাকে রাজনীতিকদের কাছ থেকে। পরিকল্পিতভাবে ব্যবসায়িক শ্রেণী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করে অপেক্ষাকৃত মেধাহীন এবং চাটুকারদের রাজনীতির শীর্ষ স্তরে নিয়ে আসার প্রবণতা শুরু হয়। সবার জানা, ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; রাজনীতিকে পুঁজি করে অঢেল অর্থ কামানোর ধান্দায় মত্ত হয়ে ওঠেন তারা। ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং রাজনীতির মাঠে আধিপত্য বিস্তার করা তাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। মোদ্দা কথা, অর্থ এবং তথাকথিত ভোট রাজনীতির মূলধারা বিনষ্টের জন্য দায়ী। ফলে মেধাবীরা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছা নির্বাসিত হচ্ছেন। এ সুযোগে রাজনীতির মাঠ দখলে যাচ্ছে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে। এ অরাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করায় তাদের কাছে দেশপ্রেম গুরুত্ব পাচ্ছে না। জনগণের নেতা হওয়ার উদ্দেশ্যেও তারা রাজনীতি করেন বলে মনে হয় না। বরং টেন্ডারবাজি, তদবির আর প্রভাব খাটিয়ে আধিপত্য বিস্তার করে রাতারাতি আরো ধনী হওয়ার বাসনায় তাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। ছাত্ররাজনীতি হয়ে পড়ছে মেধাশূন্য। দিনের পর দিন রাজনীতির এ হাল দেখে জনগণের মাঝে এক ধরনের হতাশা ও শঙ্কা কাজ করছে আমাদের আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে। তার ওপর দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রহসন, ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে নেতাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ।
একটি বিষয় পরিষ্কার, মেধাহীন রাজনীতি রাষ্ট্রের উন্নয়নে প্রতিবন্ধক। দেশের প্রকৃত উন্নয়নে রাজনীতিতে মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তির বিকল্প নেই। তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের চিন্তার গুরুত্ব বোঝার মতো মেধা খুব একটা আছে এমন বলার অবকাশ আছে কি?
অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুধু উন্নয়নের মানদণ্ড নয়। বরং একটি সত্যিকারের রাষ্ট্র গড়তে হলে মেধাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। যারা তাদের মেধা আর প্রজ্ঞা দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশকে এগিয়ে নেবেন। শুধু এ নীতির বলেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে একটি আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র। কিন্তু সত্যি হলো- বর্তমানে দেশে যে রাজনীতি বহমান তা মেধাভিত্তিক রাজনীতির ধারা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। রাজনীতির মাঠে প্রাধান্য বিস্তার করেছে অযোগ্য, চাটুকারী এবং কালো টাকা। বর্তমানে যারা রাজনীতি করছেন তাদের অধিকাংশের মধ্যে রাজনীতি-বিষয়ক যে প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বুদ্ধি, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, মেধা, ধৈর্য, মনোবলসহ নানা গুণ থাকা দরকার, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
সারা দুনিয়ায় এটি প্রমাণিত সত্য, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করে দেশ, জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে অগ্রগতির সোপানে নেয়া সম্ভব নয়। তাই রাজনীতিতে আনতে হবে গুণগত পরিবর্তন। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মানুষের ধারণায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক উৎকর্ষতায় প্রয়োজন দূরদর্শিতা, শিষ্টাচার, মেধার মূল্যায়ন। রাজনীতিবিদদের থাকতে হবে উচ্চ নৈতিকতা।
রাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ড হওয়ায় রাজনীতিতে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্য, সুন্দরের মতো অনুষঙ্গ একান্তভাবে জরুরি। এক্ষেত্রে রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণা জন্মেছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকে ধান্দাবাজ। ব্যক্তিস্বার্থে অনেকে রাজনীতিতে আসছেন। রাজনীতি করছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ ধারণা সমাজে বদ্ধমূল। দেশের কল্যাণে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়নে যেভাবে হোক, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে আমাদের সবার সর্বনাশ নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য রাজনীতিতে মেধাবী লোকদের বিকল্প নেই। কারণ রাজনীতিবিদরা সমাজের নানা সমস্যা চিহ্নিত করবেন। সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধানে নেতৃত্ব দেবেন। জনগণকে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন। নাগরিকদের দেবেন দিকনির্দেশনা। আজকের বাস্তবতায় এটি প্রমাণিত সত্য, প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চা ছাড়া মেধাবী ও মননশীল ব্যক্তিদের রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে; তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকতে হবে। মেধাবীদের উপযুক্ত মূল্যায়নের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত করতে হবে। তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত দেশগঠনের চিন্তা জাগ্রত করতে হবে। এর অন্যথা হলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়বে, যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা