১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জাকাত দিন, মানবিক সমাজ গড়ুন

জাকাত দিন, মানবিক সমাজ গড়ুন - ফাইল ছবি

ইসলামে নামাজ রোজার মতোই জাকাত একটি ফরজ ইবাদত। জাকাত হচ্ছে অর্থের ইবাদত। জাকাত একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ- পবিত্রতা, প্রাচুর্যতা, ক্রমবৃদ্ধি ও প্রশংসা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায়- জাকাত মানে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিবের জন্য প্রদান করা। ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে জাকাত। যা আদায় করতে ধনী ব্যক্তিটি বাধ্য। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মাজিদে নামাজের সাথে সাথে জাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন মাজিদে মোট ৩২ বার জাকাত আদায়ের নির্দেশ আছে। আল্লাহ এককভাবে সাতবার আর নামাজের সাথে ২৫ বার, জাকাত আদায়ের তাগিদ দিয়েছেন। জাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের মূল হাতিয়ার। মানবকল্যাণই জাকাতের মূল লক্ষ্য।

মনে রাখতে হবে, জাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি বিধান। আর এটি হচ্ছে ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের অধিকার। এটি বঞ্চিতদের প্রতি ধনীদের কোনো করুণা বা অনুগ্রহ নয়। আবার এটি দানও নয়। এটি হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবদের এমনই একটি অধিকার, যেটি প্রতি বছর ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের দিতে বাধ্য এবং সেটি গরিবদের ঘরে পৌঁছে দেয়াটা ধনীদের দায়িত্ব। এভাবে জাকাত প্রদানকে আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন যাতে একদিকে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় বিধান পালন করবে, অপরদিকে জাকাতের অর্থ দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে সমাজ থেকে দরিদ্রতা ও সমস্যা দূর হবে। এভাবে জাকাত সিস্টেমের মাধ্যমে ইসলাম সর্বজনীন এবং কল্যাণমুখী অর্থনীতি চালু করেছে, যার মাধ্যমেই কেবল একটি আলোকিত ও মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।

জাকাত আদায় করলেই অর্জিত অর্থ বৈধ, হালাল ও পবিত্র হয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষের ওপর জাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। কখন জাকাত আদায় করতে হবে এবং জাকাতের পরিমাণ কত হবে তা ইসলাম সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। জাকাতের অর্থ কোন কোন খাতে ব্যয় করতে হবে, সেটিও নির্ধারিত।

জাকাতের অর্থে অভাবী মানুষের সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু মুসলিম জাতির দুর্ভাগ্য, অনেক মুসলমান ঠিকমতো জাকাত আদায় করে না। এমনকি যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে তাদেরও অনেকে ঠিকভাবে জাকাত দেন না। ঠিকভাবে জাকাত আদায় করলে এর পরিমাণ অনেক বেশি হতো।

আবার জাকাতের টাকা সঠিকভাবে সঠিক খাতে ব্যবহৃতও হয় না। ফলে জাকাতের উপকার থেকে সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সঠিকভাবে জাকাত আদায় করা ও জাকাতের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা জরুরি।

জাকাত আদায় না করলে বৈধ ও হালাল আয়ও আংশিকভাবে হারাম হয়ে যায়। আর হারাম আয়ে জীবন যাপন করলে ইবাদত কবুল হয় না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।’ (সূরা বাকারা-৪৩) ‘তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ।’ (সূরা মুজাম্মিল-২০) ‘তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো।’ (সূরা মুজাদালাহ-১৩) আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা জাকাত দেয় না, তারাই আখিরাতের অস্বীকারকারী কাফির।’ ( সূরা হা-মিম সাজদা-৭)


যাদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে, তারা সবাই সঠিক পরিমাণে জাকাত দিত এবং সেই জাকাতের অর্থ জাকাতের নির্দিষ্ট খাতসমূহে ব্যয় করত তাহলে মুসলিম সমাজে কোনো দরিদ্র, বঞ্চিত ও অসহায় মানুষ থাকত না।

অর্থের প্রতি মানুষের লোভ আদিকাল থেকেই চলে আসছে। মানুষেরা সহজে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অপরের কল্যাণে টাকাপয়সা খরচ করতে চায় না। তাই অনেকে সঠিকভাবে জাকাতের অর্থ আদায় করে না। অনেকে মনে করে জাকাতের টাকা দিলে সম্পদ কমে যাবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ঠিক উল্টো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, জাকাত দিলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়।

আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো, মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে জাকাত দিয়ে থাকো আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাই বৃদ্ধি পায় এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত হয়।’ (সূরা রুম-৩৯) একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন- একজন মানুষ সুদ খায় সম্পদ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে সুদের কারণে যে সুদ খায় তার সম্পদ বাড়ে না। কারণ সুদি সিস্টেমে গরিবের টাকা ধনীদের হাতে চলে আসে। ফলে যারা সুদ প্রদান করে তাদের হাতে টাকা থাকে না, তাদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ে। অন্যদিকে জাকাত আদায়ের ফলে ধনীর সম্পদ দরিদ্রদের হাতে যায়। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল হয়, সমাজে দরিদ্রের সংখ্যা কমে এবং সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্যও কমে। এভাবে জাকাত ব্যবস্থার কল্যাণে সমাজ উন্নত হয়।

জাকাতের অর্থ যেনতেন খাতে ব্যয় করা যাবে না। কারণ জাকাত প্রদানের আটটি খাত আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সদাকা হচ্ছে- ১. ফকির; ২. মিসকিন; ৩. ওইসব লোক যারা সদাকা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত; ৪. ওই সমস্ত কাফির, যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা প্রয়োজন; ৫. দাস আজাদ করা; ৬. ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা; ৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী এবং ৮. মুসাফিরদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্ধারিত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, তিনি প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তওবাহ-৬০) আবার কেউ তার আপন মা-বাবা, নানা-নানী, দাদা-দাদী ও তাদের মা-বাবাকে জাকাত দিতে পারবে না। একইভাবে নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী ও তাদের সন্তানকে জাকাত দেয়া যাবে না। আবার স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে জাকাত দিতে পারবে না। কারণ এসব রক্ত সম্পর্কের মানুষগুলোকে ভরণপোষণে সাহায্য করা হচ্ছে প্রতিটি মানুষের নৈতিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব। তাই এদের কল্যাণে জাকাতের টাকা ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু আপন ভাইবোন, ভাগনে-ভাগ্নি, ভাতিজা-ভাতিজি, চাচা-জেঠা-ফুফু-মামা-খালা, চাচাতো-জেঠাতো-ফুফাতো-মামাতো-খালাতো ভাইবোন এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয়কে জাকাত দেয়া যাবে। কোনো মানুষকে তার পারিশ্রমিক বা মজুরি হিসাবে জাকাত দেয়া যাবে না। অর্থাৎ জাকাতের টাকা দিয়ে মজুরি পরিশোধ করা যাবে না। তবে মজুরির বাইরে এদেরকে জাকাতের টাকা জাকাত হিসাবে দেয়া যাবে। সুতরাং জাকাতের আদায়কৃত অর্থ সঠিক খাতেই ব্যয় করতে হবে। একজন মুসলমানের ওপর যত টাকা জাকাত নির্ধারিত হয়েছে তাকে তার পুরোটাই দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আংশিকভাবে জাকাত প্রদানের কোনো সুযোগ নেই।

সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্ধারিত জাকাত আদায় করুন। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করুন এবং সমাজ থেকে দুঃখ দুর্দশা লাঘবে ভূমিকা রাখলেন। তাই আপনার জাকাতের অর্থ দিয়ে একটি ফান্ড গঠন করতে পারেন। সেই ফান্ড থেকে জাকাতের টাকা সমাজের অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজে ব্যয় করুন। প্রতিটি ধনাঢ্য পরিবারের কর্তারা জাকাতের টাকা দিয়ে একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিলে সমাজ খুব সহজেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে। একইভাবে দেশের প্রত্যেক ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপ যদি তাদের তত্ত্বাবধানে একটি জাকাত ফান্ড পরিচালিত করে এবং সেই জাকাত ফান্ডের টাকা দিয়ে সমাজের অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজের অনেক সমস্যা আপনাআপনিই দূর হয়ে যেতে পারে।

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবকল্যাণই ইসলামের মূলমন্ত্র। তাই ইসলাম তার যাবতীয় কর্মই মানবকল্যাণের সাথে সংযুক্ত করেছে। জাকাত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আল্লাহ জাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের স্থায়ী সিস্টেম চালু করেছেন। এর মাধ্যমে গরিবের প্রতি ধনীদের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছেন।

জাকাতের অর্থ সারা বছর ধরেই দিতে পারেন। তবে ঈদুল ফিতরের আগে বছরের সব জাকাত পরিশোধ করা উচিত। জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে এক ঈদুল ফিতর থেকে পরবর্তী ঈদুল ফিতর পর্যন্ত সময়কে জাকাতের অর্থবছর ধরতে পারেন। আপনার ওপর নির্ধারিত পরিমাণ জাকাতের টাকা থেকে অসহায় মানুষের কল্যাণে বছরজুড়েই অর্থ ব্যয় করুন এবং জাকাতের চূড়ান্ত হিসাব করে বাকি টাকা ঈদুল ফিতরের আগেই পরিশোধ করুন। তাহলে সব বঞ্চিত, অসহায় এবং গরিব মানুষের মুখে ঈদের হাসি ফুটবে এবং তাদের ঘর ঈদের খুশিতে আলোকিত হবে। এটিই মানব জীবনের সার্থকতা ও সৌন্দর্য। মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও কিন্তু জাকাতের সিস্টেমে গরিবদের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। কারণ এই অর্থ তো মানবকল্যাণেই ব্যয় হবে। আসুন, যথাযথভাবে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অভাব দূর করি আর একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলি।

লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক, আহবায়ক, জাকাত ফর হিউমানিটি
ই-মেল: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement