১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আন্দোলনের জন্য দরকার কৌশল না সংখ্যাধিক্য

আন্দোলনের জন্য দরকার কৌশল না সংখ্যাধিক্য - নয়া দিগন্ত

অত্যন্ত সুদক্ষ ও কৌশলী যোদ্ধা, লেখক ও সমরনায়ক সানজু তার গ্রন্থ ‘আর্ট অব ওয়্যার’-এ যুদ্ধজয়ের জন্য যে বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন তা হলো, ‘যুদ্ধ সৈন্যসামন্তের মধ্যে লড়াই করা ছাড়াও অনেক বেশি কিছু। নৈতিকতা, পাণ্ডিত্য এবং পরিবেশ পরিস্থিতির বিভিন্ন উপাদান শারীরিক যুদ্ধের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ আমরা এর প্রায়োগিক বাস্তবতা দেখতে পাই- মোগলদের কিশোর সম্রাট আকবর ও তার বিশ্বস্ত অভিভাবক বৈরাম খাঁ ও সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য হিমুর মধ্যে সংগঠিত পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের ঘটনায়।

১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর তার ছেলে হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার ১৩ বছর বয়সী ছেলে আকবর। সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণের সময় মোগল সাম্রাজ্য ছোট হয়ে কেবল কাবুল, কান্দাহার ও পাঞ্জাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পানিপথের প্রথম যুদ্ধের মাত্র ৩০ বছর পর অস্তিত্ব রক্ষার অগ্নিপরীক্ষায় পড়ে মোগলরা। সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার প্রতিজ্ঞায় মোগলদের কিশোর সম্রাট আকবর ও তার বিশ্বস্ত অভিভাবক বৈরাম খাঁ তখন অবিচল। কিন্তু তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে বিরাট শক্তিশালী প্রতিপক্ষ সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য হিমুর শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হবে। এই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ নামক স্থানে। এই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে প্রায় অস্তমিত মোগল সূর্যের নবোদয় ঘটে।

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল সম্রাট আকবর ও বৈরাম খাঁর অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাহিনীর সাথে সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য হিমুর হস্তীবাহিনীসহ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল পদাধিক বাহিনীর। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাহিনী হওয়ায় বৈরাম খাঁ কৌশলের আশ্রয় নিলেন। তার কৌশল ছিল যেকোনো উপায়ে প্রতিপক্ষের প্রধান সেনাপতি হিমুকে কুপোকাত করা। যদি হিমুকে কুপোকাত করা যায় তাহলে তার বিশাল বাহিনী ভয়ে দুর্বল হয়ে যাবে। যেই লক্ষ্য সেই কাজ। মোগল বাহিনী তিন ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করতে থাকে। যুদ্ধের প্রথম দিকে মোগল বাহিনী হিমুর বাহিনীকে দুই দিক থেকে অগ্রসর হয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু হিমুর বাহিনী মোগলদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। একপর্যায়ে হিমুর বাহিনীর আক্রমণে মোগলরা বিধ্বস্ত হয়ে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তখন বৈরাম খাঁ তিরন্দাজ বাহিনীকে নির্দেশ দেন যেকোনো উপায়ে হিমুকে তিরবিদ্ধ করতে। হিমুর সর্বাঙ্গ বর্ম দ্বারা আবৃত থাকায় শুধু চোখে তিরবিদ্ধ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি বেশ দূরে থাকায় কাজটি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বৈরাম খাঁ কৌশলে হিমু ও তার হস্তীবাহিনীকে সামনে এগিয়ে আসতে বাধ্য করেন। তখন মোগল বাহিনী হিমুকে উদ্দেশ করে ক্রমাগত তির নিক্ষেপ করতে থাকে। একটি তীর হিমুর চোখে বিদ্ধ হলে তিনি হাতির পিঠ থেকে নিচে পড়ে যান। হিমুর এ অবস্থা দেখে তার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তখন কেউ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এগিয়ে না আসায় হিমুর বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে হিমুর বাহিনী আকবরের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে জয়ের মধ্য দিয়ে দিল্লির মসনদে বসলেন মোগল সম্রাট আকবর। আর এরপরই শুরু হয় মহামতি আকবরের নেতৃত্বে ভারতজুড়ে মোগল শাসন।

ইসলামের পতাকা সারা দুনিয়াতে উড্ডীন করার সুবর্ণ সুযোগ হয়েছিল মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। মুতার যুদ্ধ হলো অষ্টম হিজরির জমাদিউল আউয়াল অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত জর্দানের মুতা নামক স্থানে মুসলিম এবং রোমানদের মধ্যে সংঘটিত একটি অন্যতম যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলিমরা কৌশলগত জয়লাভ করে। এ যুদ্ধে ১২ জন মুসলিম শহীদ হয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবদ্দশায় মুসলিমরা যেসব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এ যুদ্ধ তাদের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ছিল। এই যুদ্ধের ফলেই মুসলমানদের জন্যে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো জয়ের পথ খুলে যায়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম রোমান সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিস্ময়কর ছিল এ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরপর তিনজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তারা তিনজনই শহীদ হয়েছিলেন। তিন সেনাপতির বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং জীবন দানের মাধ্যমে এই যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হয়েছিল।

আজকের আলোচনায় উপর্যুপরি দু’টি ঘটনা উল্লেখ করার মূল কারণ হলো যেকোনো যুদ্ধ বা আন্দোলনে জয়ী হওয়ার জন্য শুধু সংখ্যাধিক্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন কৌশল এবং সেই কৌশলের সঠিক বাস্তবায়ন। মাত্র তিন হাজার লোকের পক্ষে দুই লাখ লোকের সাথে যুদ্ধ করে কোনো অবস্থাতেই জয়ী হওয়ার কথা নয়; তবে কৌশলের কাছে এই বিরাটসংখ্যক বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। একইভাবে হিমুর বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করার পেছনেও বৈরাম খাঁর কৌশল কাজ করেছিল। নেতৃত্বের মধ্যে আবেগ নয়; বরং বুদ্ধিমত্তার বাছবিচার থাকতে হয়। কারণ যুদ্ধ ও রাজনীতি কৌশলের খেলা। এখানে যারা নেতৃত্ব দেবেন তাদের মধ্যে আদর্শের প্রতি কমিটমেন্ট রেখে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর তাৎক্ষণিক কৌশল নির্ধারণ করার সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে।

এখন আর রাজ্যজয়ের বিষয় নেই। এখনকার রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ বাস্তবায়ন। এখন সারা দুনিয়াতে সরকার পতনের আন্দোলন করতে দেখা যায়। কিন্তু কেবল সরকার পতন রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল হতে পারে না এবং এ কাজটি সহজও নয়। সরকার পতনের আন্দোলন করতে হলে রাষ্ট্রের অনেক শক্তিকে মোকাবেলা করতে হয়। কারণ যারাই ক্ষমতাবান হন, তারাই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়ত্তে নেয়ার চেষ্টা করেন। জনগণকে সম্পৃক্ত করা ছাড়া এই মহীরূহ শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। আমরা যদি ষাটের দশকের দিকে তাকাই, দেখতে পাব তখনকার আন্দোলনগুলো সফল হতো কারণ ওই সময় আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসও এর বাস্তব উদাহরণ। নব্বই দশক পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনসমর্থন ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ওই সময় জনগণকে সম্পৃক্ত করার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন ছিল, তেমনি কৌশলও ছিল। এখনকার আন্দোলনগুলোতে এই জনসমর্থন কেন কমে আসছে, জনপ্রিয়তা কেন হারাচ্ছে, নাকি যে ইস্যুতে আন্দোলনের ডাক দেয়া হয় সেসব ইস্যুতে সাধারণ মানুষের কথা থাকে না, নাকি রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা? বিষয়গুলো রাজনৈতিক নেতাদের ভেবে দেখা দরকার। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার দাবি আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। আন্দোলনের কাছে স্বৈরশাসন মাথানত করতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের মুখে অনেক দাবি আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে এই বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সফলতার দৃষ্টান্ত খুব একটা দেখা যায় না। কারণ মেধাবী নেতৃত্বের সঙ্কটে রাজনীতিতে কৌশলের সঙ্কট বিদ্যমান।

পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো- গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে হলে আন্দোলন উজ্জীবিত রাখতে হবে। তাই মেধাভিত্তিক রাজনীতির চর্চা যেমন জরুরি তেমনি সামাজিক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক আন্দোলনেরও কৌশলে পরিবর্তন জরুরি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনে রাখা দরকার, শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সংখ্যাধিক্য থাকলেই সফলতা আসবে না; বরং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ সাধারণ জনগণ যখন দাবি নিয়ে রাজপথে বিচরণ করবে তখন সরকার যেমন স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করতে ভয় পাবে তেমনি দাবি মেনে নিতেও বাধ্য থাকবে। আন্দোলনের মাঠে দীর্ঘ সময় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতির আধিক্য থাকা সত্ত্বেও আন্দোলন সফল করা সম্ভব হয়নি। কারণ এসব আন্দোলনে কৌশলের অভাব ছিল। মোট কথা, গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে, দেশকে স্বৈরতান্ত্রিক বলয় থেকে বের করে আনতে হলে রাজনীতিতে কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার মতো ইস্যু তৈরি করে জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারলেই সাফল্য আসবে নতুবা গণতন্ত্রহীনতার যে পথ তৈরি হয়েছে তার শেষ মাথা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement