১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

২০২৪-এর নির্বাচন : স্বৈরশাসনের হাতছানি

২০২৪-এর নির্বাচন : স্বৈরশাসনের হাতছানি - ফাইল ছবি

২০২৪ সাল পৃথিবীর বহু দেশের জন্য একটি নির্বাচনী বছর। বাংলাদেশের নির্বাচন দিয়ে এই নির্বাচনী মহড়া শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের নির্বাচন শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে রাশিয়ার নির্বাচনও। এর পর ভারত এবং এই বছরের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫০ কোটির বেশি মানুষ ভোটের মাধ্যমে বেছে নেবেন নিজেদের পছন্দের নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান, শাসনব্যবস্থা। যদিও ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও রাশিয়ার নির্বাচনের ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। এই তিন দেশের নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। এখানে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করেছে নির্বাচনের ফলাফল এবং ভোটের উপস্থিতি দেখানোর কাজ।

বাংলাদেশের নির্বাচন ছিল একটি একপেশে, একদলীয় নামকাওয়াস্তে নির্বাচন। এখানে সরকারি দলের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কে জিতবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। বিরোধী দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি; বরং তাদেরকে জেলে বন্দী রেখে, জুলুম নির্যাতন করে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে রেখেছে। তবে জনগণ সরকারের পাতানো ডামি নির্বাচনে ভোট না দিয়ে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা সরকারকে জানান দিয়েছে, এই নির্বাচনে বৈধতার সঙ্কট রয়েছে। একই জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগি চুক্তি এবং আওয়ামী লীগের নিজস্ব দলের মধ্য থেকেই দলীয় প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার নাটককে জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের ভাষায় একই রকম চিত্র ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় কম সহিংসতা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ‘গুণগত মান’ ক্ষুণ্ন হয়েছে। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড পূরণে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি নির্বাচন কমিশনও এই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় ভোটাররা পুরোপুরিভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সুযোগ পাননি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থী ও তাদের দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে ভোটারদের সত্যিকার অর্থে পছন্দের প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ ছিলও না। এ ছাড়া ভোটের দিন বিভিন্ন জায়গায় ব্যালট বাক্স ভর্তি ও জালিয়াতির চেষ্টা হয়েছে।’

আওয়ামী লীগ বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে এবং নির্বাচনের সময় এবং আগে-পরে গণমাধ্যম এবং সুশীলসমাজের কণ্ঠরোধ করে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে একপেশে বিজয় অর্জন করার কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছে, তাতে গণতন্ত্রের আলো নিভে গিয়ে একটি অগণতন্ত্রের অশুভ সঙ্কেত ব্যতীত অন্য কিছু নয়। অবশ্য বিগত ১৫ বছর ধরে এই দেশে শাসকশ্রেণীর যে আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে গণতন্ত্রের চিহ্ন মাত্রও পরিলক্ষিত হয়নি। কাজেই এবারের নির্বাচনও গণতান্ত্রিকভাবে হবে না তা রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, ভোটাররা আগে থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিল।

আমরা যদি পাকিস্তানের নির্বাচনের দিকে লক্ষ করি- দেখতে পাই, সেখানে দেশটির সেনাবাহিনীর রাজি-খুশির উপর কোন দল ক্ষমতায় বসবে তা নির্ভর করেছে। সেখানে শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে চটিয়ে কেউ বেশিদিন ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে পারেনি। যেমন- ২০১৮ সালে ইমরান খানের দল বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার গোপন খুঁটি ছিল সেনাবাহিনী। আবার সেনাবাহিনীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলায় সাজা দিয়ে ইমরান খানকে জেলে বন্দী রাখা হয়েছে এবং তার দল পিটিআইকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সেই দেশের জনগণ কিন্তু নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে সেভাবে সমর্থন না দিয়ে কারাবন্দী ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিয়ে ব্যাপকভাবে বিজয়ী করেছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে নওয়াজের পিএমএল-এন, বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জোট গঠন করে সরকার গঠন করেছে। সেখানে শক্তিশালী জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলের সমর্থিত বিজয়ী স্বতন্ত্ররা সরকার গঠন করতে পারেনি। ফলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ত্রুটি রেখে সেখানেও সেনাবাহিনী তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো সেই দেশের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ১৯৯৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা ভøাদিমির পুতিন। কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, কখনো রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি ২৪ বছর ধরে রাশিয়া শাসন করে চলেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি লেবাসি গণতন্ত্রের নামে একনায়কোচিতভাবে রাষ্ট্র শাসন করে যাচ্ছেন। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ২০২৪ সালের সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুতিন তার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকে পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় পুতিনবিরোধী হিসেবে পরিচিত অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যু হয়েছে। যদিও পুতিনবিরোধীরা এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু না বলে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করেছে। শক্তিশালী বিরোধী দলের নেতাদের উপর কঠোর নির্যাতন করে নির্বাচনকে প্রতিযোগিতার রূপ দিতে বাংলাদেশের মতোই নিজের পছন্দ মতো তিনটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মাঠে রেখে নির্বাচনে প্রায় ৮৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ভূমিধস জয় পেয়েছেন ভøাদিমির পুতিন। সহজ কথা, পুতিন আগামী ছয় বছরের জন্য গণতন্ত্রের মোড়কে তার স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে নিলেন।

আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভোটারের দেশ ভারত। সেখানে প্রায় ৯৭ কোটি নিবন্ধিত ভোটার রয়েছে। সাত ধাপে অনুষ্ঠিত এই ভোটে জনগণ কতটা স্বস্তিতে ভোট দিতে পারবে তা সময় হলে বলা যাবে। কারণ, নরেন্দ্র মোদি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উপর যেমন অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছেন তা স্বৈরাচারী শাসনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বিশেষ করে মুসলমানদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন যেভাবে চলছে তা কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের আচরণ হতে পারে না। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। বিশেষ করে মুসলমানদের উপর আক্রোশমূলক আচরণ কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। হিটলারের ইহুদি নিধনের মতোই ভারতে মোদি কর্তৃক মুসলমান নিধন চলছে। এত কিছুর পরও আগামী নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসবে বলেই অনেকের ধারণা। যদিও কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধী দলগুলো বিজেপিকে মোকাবেলায় জোটবদ্ধ লড়াইয়ের কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে যদি মোদি আবারো সরকার গঠন করে তাহলে ভারতীয় ধর্মীয় গণতন্ত্রের উপর নিষ্ঠুুর আঘাত অপেক্ষা করছে। ভারতীয় গণতন্ত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকার পরও বলা হয়ে থাকে, ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু ভারত গণতান্ত্রিক দেশের তকমা নিয়েও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের গণতন্ত্র নস্যাৎ করে একটি স্বেচ্ছাচারী সরকার প্রতিষ্ঠায় তারা বারবার ভূমিকা রাখছে। যা কোনো অবস্থাতেই একটি গণতান্ত্রিক দেশের আচরণ হতে পারে না।

২০২৪ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মার্কিন এই নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এটি প্রায় নিশ্চিত। সারা দুনিয়ার মানুষের চোখ এই নির্বাচনের দিকে থাকবে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় মার্কিন গণতন্ত্রের বুকে কলঙ্কের ছাপ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি যদি আবারো নির্বাচনে জয়ী হন তাহলে মার্কিন গণতন্ত্র কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা মুশকিল।

আলোচনার শেষ দিকে এসে বলতে চাই, পৃথিবীর নানা প্রান্তে নির্বাচন হচ্ছে, তবে গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের হাতছানি বৃদ্ধি পচ্ছে। মানুষ চিন্তিত এ কারণে যে, যদি আজকের গণতান্ত্রিক দেশগুলো ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারী শাসকদের দখলে চলে যায় তাহলে পৃথিবীময় অশান্তির আগুনে থাবার বিস্তার ঘটবে। যুদ্ধ-বিগ্রহ-অশান্তির দাবানলে পুড়তে থাকবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। মানুষ হারাবে তার সব ধরনের স্বাধীনতা ও অধিকার। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অন্তরালে স্বৈরতন্ত্রের হাতছানির বৃদ্ধি পৃথিবীকে কখনোই সুখী করতে পারবে না। তবে এটিও সত্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ও পূর্বশত হচ্ছে একটি অবাধ স্বচ্ছ নির্বাচন। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন ধরনের।

সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ার কিছু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে। কিছু সর্বজনীন নীতি এবং নির্দেশিকার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রটোকল, ঘোষণা, চুক্তি এবং নানা ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির আলোকে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে- ‘সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি তৈরি হবে জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে। নির্ধারিত সময় পরপর এবং প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হবে।’ কাজেই একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন জরুরি, কারণ এর মাধ্যমে সরকারগুলো বৈধ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাতে মানবাধিকার রক্ষা হয়।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement