২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

প্যারাকোয়েট : আর কত প্রাণ অকালে ঝরে গেলে সচেতন হবো?

প্যারাকোয়েট : আর কত প্রাণ অকালে ঝরে গেলে আমরা সচেতন হবো? - ছবি : সংগ্রহ

স্টাডি-১
রাইসা, ১৭ বছর। বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলায়। স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশোনা না করে মোবাইল দেখছিল। তাই আব্বু বকা দেয়। আর তাতেই রাগ করে রাইসা ঘাস মারার বিষ খেয়ে ফেলে। মুমূর্ষ রাইসা এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। কত দিন বাঁচবে তা বলা যাচ্ছে না।

স্টাডি-২
সাইমা আক্তার। ১৮ বছরের তরুণী। বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলায়। এ বছরের ১৫ এপ্রিল মায়ের সাথে অভিমান করে ঘাস মারার বিষ খেয়ে ফেলেন । ওই দিন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। ১৭ এপ্রিল তাকে কিডনি ওয়ার্ডে ট্রান্সফার হয়। ২০ এপ্রিল না ফেরার দেশে পাড়ি দেয় উঠতি এ তরুণী।

স্টাডি-৩
২৮ বছরের নয়ন। পেশায় দিনমজুর। খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভালোই কাটছিল দাম্পত্য জীবন। কিন্তু তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে স্ত্রীর সাথে সামান্য ঝগড়ায় আত্মঘাতী পথ বেছে নেন তিনি। গত ১৩ মার্চ রাতেই ঘাস মারার বিষ খেয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন নয়ন। পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। ১৭ মার্চ সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এভাবে গত সাত মাসে অন্তত ২৩ জন তরুণ প্রাণ শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রলজি ওয়ার্ডে অকালে ঝরে গেছে। ওদের বেশিরভাগই ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের । এই বয়সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা জীবনের শেষ পরিণতি বরণ করে নিয়েছে।

এই ঘাস মারার বিষটা (প্যারাকোয়েট ) আমরা ক্ষেতে ব্যবহার করি ঘাস জ্বালিয়ে ফেলার জন্য। আর এটার অপব্যবহারই আমাদের কোমলমতি ছেলে-মেয়েরা অকালে মারা যাচ্ছে। এরা আমাদেরই সন্তান । ওরা না হয় একটু গেম বেশি খেলল, না হয় পড়াশোনাও বা একটু কম করল আর কী। কিন্তু তাদের অভিমানের কারণে, ঘাস মারার বিষ সহজে পাওয়ার কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

আগে ক্ষেতে পোকামাকড় মারার বিষ (ইনসেক্টিসাইট) খেয়ে ও মানুষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করত। বিশ্বাস করুন, যারা পোকামাকড় মারার বিষ খেয়ে আসত, তারা যদি কোনো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারত, তবে তাদের শতকরা ৯৯ ভাগ রোগী ভালো হয়ে যেত। কিন্তু এই ঘাস মারার বিষ খেয়ে যারাই ভর্তি হচ্ছে, এটা এতটাই বিষাক্ত যে ওদের কাউকেই বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।

এবার আসুন জেনে নিই শরীরে ঘাস মারার বিষের (প্যারাকোয়েট ) প্রভাব সম্পর্কে। প্রথমদিকে এর প্রতিক্রিয়া তেমন অনুভূত হয় না । শুধু জিহ্বায় কিছু ঘা আসে । এরপর আস্তে আস্তে অন্যান্য অঙ্গ বিকল হতে থাকে। প্রথমে কিডনি, তারপর লিভার তারপর ফুসফুস। একপর্যায়ে এসে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। শেষ মুহূর্তে লাইভ সাপোর্ট দেয়া লাগে। লাইভ সাপোর্ট দেয়ার পরও রোগীকে বাঁচানো যায় না। কারণ ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে ফাইব্রোসিস হয়ে যায়, যা আর কোনো চিকিৎসাই ভালো করা যায় না।

এখন আমাদের চিন্তা করা দরকার, আমরা কি ঘাস (প্যারাকোয়েট ) মারার বিষ ব্যবহার করব নাকি আমাদের সন্তানদের এভাবে অকালে মরে যেতে দেব?
আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাতে ঘাস মারার বিষ (প্যারাকোয়েট) ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিশ্বের আরো ৩১টি দেশে এটি নিষিদ্ধ।

আমরা সবাই সচেতন হয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যমে এই ঘাস মারার বিষ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারি । ঘাস মারার বিষ বেচাকেনা নিষিদ্ধ করলে আমাদের কিছু ক্ষতি হবে, কিছু ঘাস বেশি জন্মাবে এই আর কী। আমরা অন্তত আমাদের কোমলমতি সন্তানদের জীবন রক্ষা করতে পারবো।

আমরা আশা করব যথাযথ কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করবেন। এ ঘাস মারার বিষ (প্যারাকোয়েট) বেচাকেনা নিষিদ্ধ করবেন।


লেখক : এমবিবি স, এমডি (নেফ্রোলজি)
১৭ নম্বর ওয়ার্ড ( নেফ্রোলজি বিভাগ)
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল


আরো সংবাদ



premium cement