২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বন্ধ মিডিয়া খুলে দিন

বন্ধ মিডিয়া খুলে দিন। - ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা এক চিঠিতে বলেছেন, ২০২১ সালে র‌্যাবের বিরুদ্ধে দেয়া নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভঙ্গ করার সরকারি কাজকে ধীর করার জন্য যথেষ্ট কাজ করেনি। তারা দাবি করছেন, এই সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো বেশি হারে অস্বীকার করছে, নাগরিকদের নির্যাতন করছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা করছে, বিরোধীদের গুম করছে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের লাঞ্ছিত করছে। সরকারকে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনতে আরো ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশন বন্ধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছেন ওই চিঠিতে।

সামাজিকমাধ্যমে খবরটি বেশ কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করলেও মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে আসেনি। অথচ এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত নাজুক একটি খবর। এর সাথে পুরো জাতির ভাগ্য জড়িত। মূল ধারার মিডিয়ায় এ নিয়ে আবার টকশো হয়ে গেছে। তার প্রতিপাদ্য ‘সামাজিকমাধ্যমে একটি ভুয়া খবর ঘুরছে’। বরাবরের মতো এ জন্য বিরোধীদের প্রপাগান্ডাকে দায়ী করা হয়েছে। বিএনপি কিভাবে ভুয়া খবরের উৎপাদন করে ও তা ছড়িয়ে দেয় তা নিয়ে মুখরোচক আলোচনা ছিল তাতে। বিগত এক যুগে দেশের বড় বড় নেতিবাচক সংবাদ এই স্টাইলেই আমরা জেনেছি। সাধারণত প্রথমে সেটা সামাজিকমাধ্যমে এসেছে, তারপর আসল খবরটি না দিয়ে মূল ধারার সংবাদমাধ্যম ওই খবর নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা করেছে। আলজাজিরার ‘প্রাইমিনিস্টারস ম্যান’ নামে তথ্যচিত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দুর্নীতি সারা বিশ্বের সামনে উন্মোচন হলো। দেখা গেল দেশের মিডিয়ায় সে খবর নেই। আলজাজিরা যে, বাংলাদেশ নিয়ে এক ভয়াবহ খবর দিয়েছে দেশের মিডিয়ায় তারও উল্লেখ নেই। শেষ পর্যন্ত সরকারের প্রেস নোটের বরাতে দেশের মিডিয়া সেটি প্রকাশ করে। সেখানে মূল খবর উল্লেখ না করে সরকারের ভাষ্যে তা নিয়ে সমালোচনা প্রকাশ করা হয়।

মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না এ নিয়ে এক শ্রেণীর সাংবাদিকের মধ্যে কোনো অস্বস্তি নেই। কিন্তু একদল মিডিয়া রয়েছে তারা সরকারের চাটুকারিতায় ব্যস্ত। এতে করে সরকারের কোনো লাভ হয়নি। যেমন কংগ্রেসম্যানদের চিঠির অভিযোগুলো দেখেন। এসব অভিযোগের জন্য তারা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ফ্রিডম হাউজ, জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন এনজিওর প্রমাণ ও নথি হাজির করেছে। ওইসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে থেকে এসব খবর সংগ্রহ করেছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকারের অব্যাহত পদক্ষেপ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর দেশীয় মিডিয়াও জানে। চাটুকারিতা না করে সময় মতো খবরের মর্যাদা দিয়ে ওইসব প্রকাশ করলে সরকার সাবধান ও সংশোধন হতে পারত। এখন এটি কয়েক গুণ বেশি বেগে বেরিয়ে আসছে। সাথে পুরো বিশ্ববাসী জানছে আমরা মুখে গণতন্ত্র বললেও আচার-আচারণে ফ্যাসিস্ট। সরকারের জন্য সংশোধন হওয়া এখন দুরূহ। সময় মতো এসব প্রকাশ না করে শেষ পর্যন্ত একশ্রেণীর মিডিয়া সরকারের ক্ষতি করেছে। অবশ্য এখনো তাদের সেই উপলব্ধি নেই।

কংগ্রেসম্যানদের চিঠিটি নিয়ে উল্টো প্রপাগান্ডায় লিপ্ত হওয়ায় বর্তমান সংসদ থেকে পদত্যাগ করা একজন নারী সংসদ মিডিয়ার সমালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠা একটি টিভি চ্যানেল ও সরকারি দলের এক সদস্যের মালিকানাধীন একটি চ্যানেলের নাম বিকৃত করেন তিনি। একজন সুশিক্ষিত মার্জিত চৌকস নারী হিসেবে তিনি সমাজে পরিচিত। জাতীয় গণমাধ্যমের নামের বিকৃতি করে উপহাস বিদ্রুপ করা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। কতটা বিরক্ত হলে একজন প্রাজ্ঞ নারী এটি করতে পারেন! আমাদের সংবাদমাধ্যম যে জনস্বার্থ থেকে দূরে সরে গেছে সেটা সামাজিকমাধ্যমের তুমুল জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে। সেই তুলনায় মূল ধারার সংবাদমাধ্যম এখন ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে গেছে বলতে হবে। এই সরকারের আমলে ব্যাঙের ছাতার মতো টিভি চ্যানেল হয়েছে কিন্তু জনমানুষের সুখ-দুঃখ তাদের প্রতিপাদ্য নয়।

সামাজিকমাধ্যমে কয়েক ডজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়েছে এর প্রতিক্রিয়ায়। তারাই হয়ে উঠছে খবরের প্রধান উৎস। এমনকি বেশির ভাগ খবর তারাই প্রথমে দেন। এসব ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করে। তাদের ভাষায় সামাজিকমাধ্যমে তুখোড় জনপ্রিয় ব্যক্তিরা প্রপাগান্ডা করেন, ভুয়া খবর ছড়ান ও অস্থিরতা তৈরি করেন। সাইবার সন্ত্রাসী বলে তাদের বিরুদ্ধে খবরও ছাপিয়ে দেয়া হয়। বাস্তবে দেখা যায় তাদের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। সংবাদের উৎস হিসেবেও তারা মানুষের কাছে এসব মিডিয়ার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও আপন। বেশ কিছু ইউটিউবার রয়েছে তাদের সাবস্ক্রাইবার কিছু টিভি চ্যানেলের কয়েকগুণ। একজন ব্যক্তির ফলোয়ার যেখানে কয়েক মিলিয়ন সেখানে একেকটি টিভি চ্যানেলেরও কয়েক লাখ সাবস্ক্রাইবার নেই।

বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে এগুলোর বাস্তবতা না থাকলে সরকারকে চাপে ফেলানো যেত না। জাতিসঙ্ঘে আমাদের দেশ থেকে শান্তি মিশন বাতিল করার মতো পিটিশন দাখিল হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসত না। মিডিয়া ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে, অপরাধ করার যে দুষ্টচক্রের মধ্যে সরকার পড়ে গেছে তা হতো না। এ ক্ষেত্রে কিছু স্বাধীন মিডিয়া এই সরকারের স্বার্থেই থাকতে পারত। আমরা বরং দেখেছি যারা সত্যিকার অর্থে সরকারের অন্যায় অনিয়ম দুর্নীতি জাতির সামনে তুলে ধরতে পারত তাদের খেদিয়ে দিয়েছে এই সরকার।

২০১৩ সালের মে মাসে হঠাৎ করে এক রাতে সরকার দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়। চ্যানেল দুটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। শুধু একটি প্রশাসনিক আদেশে এটি করা হয়। তখনকার তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তদন্ত হচ্ছে। এরপর এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে কি না আর জানা যায়নি। তবে বিগত দশ বছরে এগুলো খোলার অনুমতি পাওয়া যায়নি। তার আগে বন্ধ করে দেয়া চ্যানেল ওয়ানও আর খোলা হয়নি।

এই সরকারের একেবারে শুরুর দিকে বন্ধ করে দেয়া হয় দৈনিক আমার দেশ। একদিন দেখা গেল এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এর সাবেক প্রকাশক। মূলত নানা কারণে সরকার পত্রিকাটি পছন্দ করছিলেন না। ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে সারা দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিল মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান লেখনির মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। আজ একজন লোকও পাওয়া যাবে না যে, গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থন করবে। এমনকি এর প্রধান উদ্যোক্তাদের কেউ আর এর পক্ষে নৈতিক সমর্থন জোগায় না। তাদের কাউকে এখন দৃশ্যপটে দেখাও যায় না, তারা অনেকটা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। বিভেদ সৃষ্টিকারী ও শত্রুদের পক্ষের শক্তি হিসেবে জাতির সামনে তারা আজ চিহ্নিত। ওই মঞ্চের সমর্থন করার জন্য অনেকে এখন অনুতপ্ত। অনুশোচনা থেকে নিজেরা এ জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন জাতির কাছে। ‘আমার দেশই’ প্রথম সঠিকভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছিল বিচার চাওয়ার বদলে মানুষের ফাঁসি চাওয়াটা অন্যায়। পত্রিকাটির পক্ষ থেকে প্রথম বলা হয়েছিল ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে’। ওই মঞ্চের অনেকেই এখন সরকারকে ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য অভিযুক্ত করেন।

মাহমুদুর রহমানকে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। কয়েকবার জেল খেটেছেন। সরকারের বাহিনী প্রকাশ্যে তার ওপর হামলা করেছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলো এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে খুব সামান্য প্রতিবাদ করেছে। বিরোধী দলও এই ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিবাদ করেনি। পরবর্তীতে বিরোধীরা যতটা কোণঠাসা হয়েছে তখন তারা ততটা কোণঠাসা ছিল না। তারা চাইলে এর জোরালো প্রতিবাদ করতে পারত। কেবল মাত্র মাহমুদুর রহমানের পরিচয়কে গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে, তার রাজনৈতিক দর্শনের কারণে। মূল ধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিক নেতারা তাকে পছন্দ করেননি; সম্ভবত একই কারণে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারাও তখন প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতা কোণঠাসা হয়ে যাওয়ায়, এখানে শুধু চাটুকারিতা সাংবাদিকতার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নাগরিক নির্যাতনের খবর হয় না। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনের হাত ধরে সেটা বিদেশে অভিযোগ আকারে আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসছে। এই চাপ এখন সামলানো যাচ্ছে না।

মিডিয়াকে বাক্সে বন্দী করাটা যদিও প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের জন্য সুখকর। বাস্তবে দেখা গেল তাদের জন্য এটি স্বস্তিদায়ক হয়নি, বরং বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে। দড়িকে অনেক বেশি টাইট দেয়া হলে সেটা ছিঁড়ে যায়। এ দেশে ঠিক সেই মুহূর্ত এখন আগত হয়েছে। পরিস্থিতি এখন এতটাই গড়িয়েছে সরকারের শীর্ষ নেতারা বিএনপির সাথে আলোচনার প্রস্তাব রাখছেন। নির্বাচন এখনও খানিকটা দূরে আছে। এর আগে বন্ধ মিডিয়া খুলে দেয়ার প্রয়োজন। বিরোধীদের মতপ্রকাশের জায়গা হবে, যা এখন একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে আছে। এই অবস্থায় আশা করা যায় বিএনপি, দৈনিক দিনকালসহ বন্ধ প্রত্যেকটি মিডিয়া খুলে দেয়ার দাবি জানাবে।


আরো সংবাদ



premium cement