২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিশু নিধনে স্বপ্ন নিধন

শিশু নিধনে স্বপ্ন নিধন। - ছবি : সংগৃহীত

শিশুরা নিষ্পাপ। আমাদের অনেক না পাওয়া আর হতাশাগুলো ভুলিয়ে দেয় এই চাঁদ মুখের অমলিন হাসি। সুতরাং এই শিশুরা যখন নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়, তখন এর চেয়ে কষ্ট আর থাকে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা শিশুদের উপর নির্যাতন করে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। প্রকৃতপক্ষে এমন নজির নেই বলেই অপরাধীরা এক ধরনের অভয় পায়। এ পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই এখনো বিচারাধীন। তা ছাড়া যে সব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৯৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ আসামি যেকোনো উপায়ে বেঁচে গেছে। ফলে যে হারে শিশু নিধন বাড়ছে, সেটা আমাদের জন্য অশনি সঙ্কেত। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সমাজেই শিশুর প্রতি সহিংসতার রয়েছে নানা উপাদান। শুধু আইন দিয়ে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। পচনশীল সমাজকে ভেঙে চুড়ে নতুন সমাজ গঠনে বদ্ধপরিকর হতে হবে। এক্ষেত্রে আদর্শবান তরুণদের নড়েচড়ে জেগে উঠতে হবে।

প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও হত্যার শিকার হচ্ছে ফুলের কুঁড়ির মতো নিষ্পাপ শিশু। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, বেকারত্ব, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক ও সম্পত্তির দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছে কারও না কারও নাড়িছেঁড়া অমূল্য ধন।

মুখে বলা হয়ে থাকে, ‘শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় না যতটা বলা হয়। শিশুহত্যা ক্রমবর্ধমান চলছে তো চলছেই। এর গতি রোধ এখন সময়ের দাবি। নইলে অচিরেই জাতি ঘোর অমানিশায় তলিয়ে যাবে। নাম নিশানা হারিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে জাতি। ইসলাম পূর্ব আরবের জাহেলি যুগের দিকে ধাবিত হতে চলেছে যেন। বাড়ছে জাহেলিয়াত (মূর্খতা) আর জেহেল (মূর্খ)।

তবে কি স্বপ্নের স্বাধীন দেশ ভয়ঙ্কর এক জনহীন প্রান্তর হতে চলছে? কেননা শিশুই যদি না থাকে, তবে বংশবৃদ্ধি রহিত হয়ে যাবে। জেনে বুঝে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে সর্বনাশ সাধন করছি নিজেরই- তাও কি চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়? উপর দিকে থুথু নিক্ষেপ করলে নিজেকেই নোংরা হতে হয়। এই বোধটুকুও আমাদের ধাক্কা মেরে চলে গেল! আসল কথা হচ্ছে, মানুষ যদি বিবেকহারা হয়, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থেকে সরে যায়, তাহলে সে পশুত্বের পর্যায়ে থাকারও যোগ্যতা রাখে না। কোনো পশু কখনো স্বগোত্রীয়কে হনন করে না যা মানুষ করে চলছে অহরহ।

স্বগোত্রীয়দের হনন করা মানুষগুলোকে যদি সমাজের নিরাপত্তার জন্য বনে জঙ্গলে বসবাসের ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে মানবজাতি আপাতত একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পেলে পেতেও পারে। পাশাপাশি মানবজাতির বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে বহু গুণে। এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি। হিংস্র মানুষের কাছে মানুষই এখানে নিরাপদ নয়, সেখানে পশুদের নিরাপত্তার প্রশ্নই আসে না। আবার প্রকৃতি প্রদত্ত পোকা মাকড় থেকে শুরু করে লতা গুল্ম, খড় বিচালি এবং সামান্য দুর্বাঘাস পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুকে। আর এই নরখাদকগুলো পাহাড়, পর্বত এবং পশুকুল গিলে সাবাড় করে ফেলবে। বরং সাবাড় করার আগেই এদের গতিবিধি দেখে পশুরাই পালাবে ভয়ে। সুতরাং প্রকৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিহীন হয়ে অথর্ব হয়ে যাবে নির্ঘাত। সুস্থ মানুষের যেমন শরীরের প্রতিটি সুস্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকা জরুরি, তেমনি সুস্থ জাতির জন্য প্রকৃতির সকল সম্পদের নিরাপত্তার ফয়সালাও অত্যাবশ্যক।

আসল কথা হলো, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ সুতরাং মানুষের বসবাস হোক সমাজে, আর পশুদের জঙ্গলে। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে গেলেই মহা বিপর্যয়। ‘মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব’- কেন? বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান, সৃষ্টিশীলতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কারণেই মানুষ মূলত সৃষ্ট জগতের যাবতীয় সৃষ্টি থেকে আলাদা।
পরিবার হলো একক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে সুশিক্ষাপ্রাপ্ত না হলে এরা হয়ে যায় সমাজের আপদ, আতঙ্ক, ত্রাস ও হুমকি। এখানে অত্যাবশ্যকীয় হলো, ধর্মীয় অনুশাসন। ধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে আজকাল এমন হয়েছে যে, মাঝে মধ্যে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘মানুষ থেকে সাবধান!’

তবে এটাও তো সত্য যে, আশার আলো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সমাজের মানুষ এখনো অধিকাংশই ভালো, সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছে। সুতরাং হতাশ না হয়ে যদি সুশীলসমাজ সংঘবদ্ধ হয়ে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে সঠিক দিকনির্দেশনায় এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে, সেই সাথে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে যুব সমাজকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে সামনের দিনগুলো সুন্দরের চেয়েও সুন্দর হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সমস্যা যেখানে আছে, সমাধান তার ঠিক পেছনেই আছে, ঘুরে দাঁড়ালেই তা দেখতে পাওয়া যায়। ‘সদিচ্ছায় সব হয়’- এই কথাটি অন্তরে ধারণ, লালন এবং প্রয়োগ করতে হবে।

আরো একটি সহজ হিসেব বলছি। এদেশে আঠারো কোটি লোকের বাস। এর মধ্য থেকে যদি বৃদ্ধ, অসুস্থ, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী, মানসিক রোগী, শিশু, অপরাধ জগতের বাসিন্দা- এদের বাদ দেয়া যায়, তাহলে সম্ভবত কম-বেশি নয় কোটি হতে পারে (আনুমানিক হিসাবে)। তাহলে সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক এই নয় কোটি মানুষের নিশ্চয়ই নয় কোটি সুস্থ মাথা সহ সুস্থ আছে আঠারো কোটি হাত, পা, চোখ ও কান। এরা যদি সক্রিয় হয়, তাহলে শুধু শিশুহত্যা কেন, সকল অনাকাক্সিক্ষত অঘটন দৌড়ে পালাবে। এভাবে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটবে। শিশুরা আমাদের স্বপ্ন। শিশুই যদি না বাঁচে, স্বপ্নেরা আবাস খুঁজে পানে না। শিশুর সাথে হারিয়ে যাবে স্বপ্নগুলোও।
শেষ করছি কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত লাইন দু’টি দিয়ে
‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’


আরো সংবাদ



premium cement