২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ধর্ম আগে না রাষ্ট্র

- ফাইল ছবি

পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রধান ধর্ম পাঁচটি। সেগুলো হলো : খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম ও ইহুদি ধর্ম আল্লাহ প্রদত্ত তথা আসমানি ধর্ম। এ তিন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম মানব আদম আ:। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম মানবসৃষ্ট। হিন্দু ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রথম মানব মহর্ষি মনু। এ ধর্মগুলোর বাইরে আরো যে সব ধর্ম আছে সব অধ্যয়ন করলে জানা যায় যে, পৃথিবীর প্রথম মানব ধার্মিক ছিলেন। প্রতিটি ধর্মের মৌলিক বক্তব্য ও বিশ্বাস ছিল একত্ববাদ ও মানবতাবাদ। স্ব স্ব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মের অনুসারীরা একত্ববাদী, একেশ্বরবাদী ও মানবতাবাদী। আগে মানুষের কাছে রাষ্ট্রের কোনো ধারণা ছিল না। রাষ্ট্রের আগেই পৃথিবীতে ধর্ম ও ধার্মিকের আবির্ভাব ঘটেছে। আর এটা বুঝতে বড় ধরনের কোনো প্রমাণ ও গবেষণার প্রয়োজন নেই। আসমানি ধর্ম হিসেবে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম আদম আ:কে প্রথম মানব ও নবী হিসেবে বিশ্বাস করে। তিনি প্রত্যাদিষ্ট হয়ে মানুষদের একত্ববাদ, সুনীতি, সুশাসন, সুশিক্ষা, সততা ইত্যাদি ধর্মীয় ও মানবিক আচরণ শিক্ষা দেন। আল্লাহ তায়ালা আদম আ:কে বিশ্বের সব বস্তুর নাম শিখিয়েছিলেন। এ শিক্ষাবলে তিনি পৃথিবীর সব বস্তুর নাম রেখেছিলেন। তার গৃহীত শিক্ষার অনুসরণ ও অনুশীলন সংক্ষিপ্ত ব্যপ্তিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে উল্লিখিত শিক্ষা ও দীক্ষার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ঘটেছিল। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সমাজে মানুষের মধ্যেই কিছু মানব শয়তানের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের দেখতে মানুষের মত হলেও তারা মনুষত্বে ছিল পশু। এসব পশু পিছন থেকে সত্যবাদী মানুষদের বিভ্রান্ত করতে তাদের পিছু নিয়েছিল। তারা সামগ্রিকভাবে না হলেও অনেককে বিপথগামী করতে সক্ষম হয়েছে। আর তাদের এ চেষ্টা এখন পর্যন্ত তারা অব্যাহত রেখেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের এ চেষ্টা সফল হয়েছে কিন্তু সব ক্ষেত্রে সফল হয়নি।

Email: dr.knzaman@gmail.com

খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক ছিলেন যিশু বা ঈসা আ:। তার জন্ম আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২ থেকে ৭ সালে। তিনি পৃথিবীতে আগমন করে জাগতিক মুক্তির পাশাপাশি পরকালীন মুক্তির পথনির্দেশনা দেন। তার প্রচারিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল : একত্ববাদ, ফেরেশতায় বিশ্বাস, আত্মিক পরিশুদ্ধতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা, ব্যভিচার নিষিদ্ধ করা, সহনশীলতা প্রদর্শন, সুদ পরিহার করে চলা, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা, ব্যক্তিত্ববোধ ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিশোধ না নেয়া, ধর্ম শিক্ষা দেয়া, ক্রোধ সংবরণ ও শোকরানার জন্য প্রভুর উপাসনা করা ইত্যাদি। ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন মুসা আ:। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ২০৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইহকালের পাশাপাশি পরকালের মুক্তিবিষয়ক পথনির্দেশনা পেশ করেন। তিনি মানুষকে জাগতিক সব পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকতে সতর্ক করেন। তার প্রচারিত ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে অন্যতম হলো : আদম আ: আদি পিতা, ইব্রাহিম আ: জাতির পিতা, মুসা আ: আল্লাহর প্রেরিত নবী, জেরুসালেম পবিত্র নগরী, সুদ নিষিদ্ধ, ব্যভিচার নিষিদ্ধ, জুলুম করা মহাপাপ, ছেলে সন্তানদের খতনা করানো, পরস্পরের সাক্ষাতে সালাম বলা, পশুর রক্ত ও শূকরের মাংস নিষিদ্ধ, আকিকার মাধ্যমে সন্তানের নাম রাখা, নতুন চন্দ্রের ভিত্তিতে মাস গণনা করা, দাড়ি রাখা, টুপি পরা আল্লাহর সাথে শরিক না করা ইত্যাদি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দুধর্ম একটি মানবসৃষ্ট ধর্ম। এ ধর্মমতে, হিন্দুরা একেশ্বরবাদী। তাদের সামাজিক আচরণে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। ব্যভিচার নিষিদ্ধ। অবৈধ উপার্জন নিষিদ্ধ। মদ্যপান নিষিদ্ধ। এ ছাড়া সততা, সহনশীলতা ও মানবতা এ ধর্মের অন্যতম প্রধান মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। বৌদ্ধধর্মও হিন্দুধর্মের মতো মানবসৃষ্ট।

উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ভারতের মগধ রাজ্যে (বর্তমান বিহার রাজ্যে) এ ধর্মের সূত্রপাত ঘটে। এর প্রবর্তক হচ্ছেন সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধ ধর্মের অমীয় বাণী পেশ করেছেন। তিনি ধর্মের বিধান মতে ব্যক্তি ও সমাজ নির্মাণের উপদেশ দিয়েছেন। তার মূল্যবান বাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : মানুষ মানুষের জন্য, যাদের পঞ্চেন্দ্রিয় আছে তাদের হত্যা করো না, বিবাহবহির্ভূত যৌনাচার করো না, পড়ে থাকা বস্তু তুলে নিও না, মিথ্যা বলো না, মদ-গাঁজা ইত্যাদি সেবন করো না, সব প্রাণীর প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ করো, হিংসা, রাগ, অহঙ্কার, মোহ পরিত্যাগ করো, মাতাপিতার সেবা করো, বৈধ আয় দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করো ইত্যাদি।

ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও একত্ববাদের প্রচার করেন। তিনি সমগ্র মানবতার সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে আগমন করেন। (সূরা আস ছাবা-২৮)। তিনি শিক্ষক হিসেবে এবং মানবজাতির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে প্রেরিত হন। (মুসনাদে আহমাদ)। ৬১০ সালে ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন। এরপর মাত্র ২৩ বছর তিনি জীবিত ছিলেন। এ ২৩ বছরে আরবের অসভ্য, অদম্য, বর্বর ও বিশৃঙ্খল জাতিকে সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন। একটি মাত্র আওয়াজের মাধ্যমে কোনো প্রকার জবরদস্তি ছাড়া একই পতাকার নিচে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আর সে আওয়াজটি ছিল, ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ তিনি অল্প দিনের ব্যবধানে আরব থেকে সকল প্রকার অনিয়ম ও দুঃশাসন দূর করেন। বহুল প্রচলিত দাসত্বপ্রথা উচ্ছেদ করেন। মাদক, জুয়া, ব্যাভিচার নিষিদ্ধ করেন। নারীর মর্যাদা ফিরিয়ে দেন। অন্য ধর্মের মানুষের সম্পদ ও রক্ত নিজের সম্পদ এবং রক্তের মতো পবিত্র ঘোষণা করেন। অন্য ধর্মের উপাসকদের সম্মান ঘোষণা করেন। যার যার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। সুদ পরিহার করেন। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুণ্ঠন ইত্যাদি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। নেতা নির্বাচনে পরামর্শের ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। আর নেতৃত্বের যোগ্যতা হিসেবে তাকওয়াকে প্রাধান্য দেন। দুই জাহানের নেতা হয়েও অতি সাধারণ জীবনযাপন করে তিনি পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিলেন।

প্রতিটি ধর্মের প্রবর্তকই তার জাতিগোষ্ঠীর ক্রান্তিকালে আধ্যাত্মিক অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকেই সত্য-ন্যায়ের পথপ্রদর্শক, সামাজিক নেতা ও শাসক হিসেবে প্রেরিত হন। ধর্মের প্রবর্তকগণ পৃথিবীতে আগমন করে সময়োপযোগী জ্ঞান, বাণী ও আদর্শচরিত্রের প্রচার ও প্রসার ঘটান। আর প্রচারিত জ্ঞান, বাণী, আদর্শ ও চরিত্রের মাধ্যমে সমাজ এবং দেশের নেতৃত্ত্ব প্রদান করেন। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ সময়ের শ্রেষ্ঠ ত্যাগী ও সাহসী নেতৃত্বের পরিচয় দেন। প্রত্যেকেই সফল মানবকর্মী ও প্রগতিশীল নেতা হিসেবে সমকালীন বিশে^ পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তারা অত্যন্ত সততা, যোগ্যতা ও বলিষ্ঠতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের জীবনী বিষয়ে গবেষণা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এককথায়, তারা সমকালীন যুগের কোনো না কোনো জাতির ও দেশের জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের মাঝে ছিল এক অসাধারণ ও অলৌকিক সম্মোহনী শক্তি, যার মাধ্যমে তারা একটি লোকালয়, সমাজ ও দেশে জনজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বর্তমান যুগের বিশ্লেষণ দেখা যায়, একালের রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা শুধু জাগতিক সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণের নিমিত্তে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। কিন্তু ধর্মপ্রবর্তকগণ ইহজগৎ ও পরজগৎ- দুই জগতের কল্যাণের জন্যই কাজ করেছিলেন। দুই জগতের সুখ, শান্তি ও মুক্তির নিমিত্তে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করেছেন। বর্তমান পৃথিবীর সর্ব উত্তরের নরওয়ে আর সর্ব দক্ষিণের চিলি-বিস্তৃত এ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেতা-নেত্রীর প্রত্যেকেই কোনো না কোনো আধুনিক মতবাদের প্রবক্তা ও অনুসারী। তারা প্রত্যেকেই এক একজন সমাজতন্ত্রী অথবা গণতন্ত্রী। তারা প্রত্যেকেই ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা অন্য যেকোনো তন্ত্রে-মন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু পৃথিবীর কোনো ধর্মপ্রবর্তকই সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, গণতন্ত্রী ছিলেন না। ছিলেন না ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা পুঁজিবাদে বিশ্বাসী কোনো নেতা। সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ-সুবিস্তৃত বিশাল এ পৃথিবীর গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীর সবাই এক একজন যুদ্ধবাজ ও দাঙ্গাবাজ নেতা হিসেবেই পরিচিত। ধর্মনিরপেক্ষ ও পুঁজিবাদী নেতৃবৃন্দকে মানুষ দেখতে পায় একজন সফল অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে। দেখতে পায় লাঠিয়াল, দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভী ও সীমাহীন সম্পদলোভী হিসেবে। তাদের তন্ত্র-মন্ত্রকে দেখতে পায় অনৈতিক ক্ষুধায় কাতর তাল-মাতাল মনুষ্যত্বহীন এক দানবীয় বিশ্ব নেতৃত্ব হিসেবে। আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শক্তিশালী নেতাকে মানুষ সন্ত্রাসী, আগ্রাসী ও দখলদার হিসেবেই চেনে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর কোনো ধর্ম প্রবর্তকই এমন চরিত্রের ছিলেন না। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন আরাম-আয়েশবিবর্জিত মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ত্যাগ ও কোরবানির দৃষ্টান্ত দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল তাদের নেতৃত্ব। তাদের ইতিহাস, নিজেদের সব সুখশান্তি জলাঞ্জলি দেয়ার ইতিহাস। তাদের ইতিহাস, অন্যের সুখের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার ইতিহাস। তাদের ইতিহাস, স্বার্থপূজারীদের রক্তচক্ষুর রোষানলে পড়ে কারাগারে অন্তরীণ হওয়ার ইতিহাস। ঘরত্যাগ, স্বজন ত্যাগ আর দেশত্যাগ হওয়া ছিল তাদের জীবনের নিত্য দিনের ঘটনা। আর এই মহিমান্বিত নেতৃত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল ভাস্কর ছিলেন মহানবী মুহাম্মদ সা:। তাঁর প্রচারিত একত্ববাদ আর মানবতাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল মরুময় আরব। তাঁর সীমাহীন ত্যাগ হৃদয়হীন আরবদের বশীভূত করেছিল। অতি অল্প দিনের ব্যবধানে তিনি আরবের বাধাহীন ও স্বাধীন এক বর্বর জাতিকে বশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রাচীন অন্ধকার, বিশৃঙ্খল, আর বর্বর সমাজে আগত মহানবী সা:-এর রুচিবোধ, জীবনবোধ, মানবতাবোধ, লোভহীনতা, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব, দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা, ধর্মের প্রতি অবিচল বিশ্বাস, এর অনুশীলন আর তা প্রচারের সুনিপুণ কৌশল দুনিয়ার সর্বত্রই নন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছিল। এখনো তিনি সারা দুনিয়ার গবেষকদের কাছে নন্দিত এক নেতৃত্ব হিসেবেই বিবেচিত।

আবহমানকাল থেকে দেখে আসছি, সমাজের বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক প্রয়োজনে ধর্মের পরম নির্দেশের অনুসন্ধান করে চলেছে। সামাজিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন যাপনের বাসনায় ধর্মীয় অনুশাসনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করছে। বিজ্ঞানের এই চরম ঔৎকর্ষের যুগেও মানুষ সুন্দর জীবনযাপনের জন্য ধর্মের দ্বারস্থ হচ্ছে। বিশেষ করে তারা ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। আধুনিক যুগ, বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগ। শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। সন্তানদের লেখাপড়া এখন বৈশি^ক ধাঁচে সুগঠিত। তথাপিও সমাজের অনেক উচ্চবিত্তরা সন্তানকে ভর্তি করতে অপেক্ষাকৃত ধার্মিকদের কোচিং সেন্টারকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। শিক্ষা দিতে সন্তানকে নিয়ে তারা ছুটে চলছে ধর্মের আবহে সিক্ত কোনো এক আধুনিক প্রতিষ্ঠানে। যে প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যের কারিগর হলো আধুনিক শিক্ষিত একদল যুবক। অথচ তাদের সকলেই ধর্মীয় নির্দেশের কাছে সমর্পিত। এসব লোক বিশ্বাস করে যে, ধর্মীয় নির্দেশ অমান্য করলে ব্যক্তি, পারিবার এবং সমাজজীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে এবং পরকালীন জীবনে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আর এ কারণেই একবিংশ শতাব্দীর এ যুগেও মানুষ তাই ফিরে খুঁজে সেই মহানবীর সা: কালজয়ী আদর্শ! ধর্মে বিশ্বাসী আস্তিকরা ধর্মকে তাদের জীবনধারণের একমাত্র চরম ও পরম নির্দেশনা হিসেবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। অন্য দিকে ধর্মবিহীন আস্তিক ও কিছু ধর্মহীন নাস্তিক তাদের এই আদর্শকে ব্যক্তি, পারিবার, সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে অস্বীকার করে। উল্লেখিত আলেচনা এটাই প্রমাণ করে যে, মানবসভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে ধর্ম ও এর চর্চার মাধ্যমে। যার কারিগর ছিলেন একজন ধার্মিক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তির মাঝে প্রকাশিত সম্মোহিত শক্তির কাছে মানুষ সমবেত হয়েছিল। সমবেত জনগোষ্ঠী কর্তৃক সেই সম্মোহিত শক্তির বিস্তার লাভ ঘটেছিল। আর এ সম্মোহিত শক্তির উপাদান ছিল একত্ববাদ, মানবতাবাদ, সততা, নৈতিকতা ইত্যাদিতে ভরপুর। আমরা জানি, বিস্তৃত জনগণের জনসমষ্টিই হলো সমাজ। আর সমাজের ব্যাপক বিস্তৃত রূপই হলো রাষ্ট্র। এটা যে ভাষায় যারা যেভাবেই প্রকাশ করুক, সেটা ছিল ধর্ম ও ধার্মিক থেকে উৎসরিত। আধুনিক পৃথিবীতে রাষ্ট্রের যতগুলো মতবাদ আছে তার মধ্যে ঐশ^রিক মতবাদ অন্যতম। আর এটি স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত ও নির্দেশিত। সুতরাং বলাই যায়, পৃথিবীতে আগেই ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মের পরম নির্দেশের আলোকে মানব সমাজ সুগঠিত হয়েছে। পরে এটি বিস্তার লাভ করেছে। অতঃপর রাষ্ট্রের পত্তন ঘটেছে। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের ২৭টি রাষ্ট্রের প্রায় সবই ধর্মীয় আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। শতভাগ ধর্মীয় আইন তারা পালন করছে না। তথাপিও সার্বিক বিবেচনায় তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বেশ সুসংহত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এসব পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়ে বেশি টেকসই বলেও মনে হচ্ছে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের লোকদেরকে জুলুম করার অধিকার দেয়নি। কিন্তু কিছু মানুষরূপী অমানুষ ধর্মের নির্দেশনা অমান্য করে তাদের ওপর জুলুম করে বসে। এরা মূলত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে অপর ধর্মের লোকদের ওপর কখনো কখনো বর্বর ও নিষ্ঠুর আচরণ করে। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, ধার্মিক, ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ী কখনো এক নয়। ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী স্বীয় স্বার্থ হাসিলে ধর্মকে ব্যবহার করে। এ দুই শ্রেণীর লোকদের রুখতে হবে। এ দায়িত্ব প্রধানত ধার্মিকদের। শান্তি ও নিরাপত্তার বিশ্ব গড়তে ধার্মিকদের অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে। ধর্মের পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement