২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

চলে যাওয়া পিতৃব্যের ছায়া

শাহ আবদুল হান্নান। - ফাইল ছবি

বড় চাচা শাহ আবদুল হান্নান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আকাশের মতো সুবিশাল ছিলেন, তাকে ধারণ করা অল্প কথার লেখনীতে দুরূহ। শুধু ব্যক্তিত্ব নয়, তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন, চিন্তা, অধ্যয়ন ও লেখনী তাকে সে ব্যাপ্তি দিয়েছে।

পিতৃব্য হিসেবে আমি তাকে ‘বড়চাচ্চু’ ডাকতাম। লোকজনের সামনে তাকে ‘চাচা’ ডাকতাম। ‘হান্নান চাচা’ নামে তাকে অনেকেই ডাকতেন। সরকারের বড় কর্তা হিসেবে দীর্ঘ কর্মজীবনে তাকে ‘হান্নান স্যার’ হিসেবেই লোকে বেশি চিনতেন ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণের পর থেকে ২ জুন ২০২১ সালে ইন্তেকাল পর্যন্ত ২২-২৩ বছর ধরে তিনি ধীরে ধীরে জনমানুষের কাছে ‘স্যার’ থেকে ‘চাচা’য় নিজের উত্তরণ ঘটান। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ও সমাজের উঁচু শ্রেণীর অংশ তিনি ছিলেন ঠিকই। কিন্তু সে উঁচু-নিচু তলার ব্যবস্থাকে মেনে না নিয়ে তিনি যে নিজেকে শ্রেণিচ্যুত করতে পেরেছিলেন, তার অনেক প্রকাশের মধ্যে একটি ‘চাচায়’ উত্তরণ।

শাহ আবদুল হান্নান ভিন্ন জীবনবোধের মানুষ ছিলেন। জীবন ও জীবনের উদ্দেশ্যকে তিনি সংসারী মানুষের তুলনায় ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। সৃষ্টিকর্তা ও নিজ ধর্মের ওপর অনড় বিশ্বাস রাখতেন। ওই পথ যে, মানুষের জন্য কল্যাণের, সে বিষয়ে তার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। তাই নিজের ধর্মের বোধ ও বিশ্বাসকে পৃথিবীর কল্যাণে মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়া এবং সে নীতির অনুগামী কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক স্বপ্নিল সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সংগ্রামের সমভাগী ও সহচররাই তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলেন। আত্মীয়-পরিজন, নিজ পরিবার, এমনকি কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে তার নিজের থেকেও বেশি।

সরকারি দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণের আগে থেকেই তিনি নিজ গৃহে তরুণদের জন্য কুরআনের তাফসিরের পাঠ দেয়া শুরু করেন। পাঠচক্রগুলো মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র এবং ছাত্রীদের নিয়ে হলেও সেখানে নানা শ্রেণী পেশার তারুণ্যের উপস্থিতিও লক্ষ করা যেত। অবসর গ্রহণের পর এই কাজটিকেই মূল কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই পাঠদান তার পেশা ছিল না, এর বিনিময়ে কিছুই গ্রহণ করতেন না তিনি। কিন্তু বহু বছর ধরে অক্লান্তভাবে কাজটি করে গেছেন। একসময় নিজের বাসার পাঠচক্রের বাইরেও নানা স্থানে ছেলেদের ও মেয়েদের আলাদা আলাদা ছোট-বড় গ্রুপে পাঠদান শুরু করেন। কালক্রমে তার এই পাঠচক্রগুলোর সংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। সিকি শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলা সে পাঠচক্রগুলোতে কুরআন থেকে শুরু করে তার পাঠদানের বিস্তার হাদিস, ফিকহ, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে নারীবাদ, এমনকি বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে চলমান নানা বিষয়ের আলোচনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছেন। শিক্ষা, গণযোগাযোগ, সমাজসেবা, গবেষণা থেকে শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপদেষ্টা বা সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। কর্মজীবনের সব জায়গায় সততা, কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিকতার জন্য সুবিদিত হয়েছেন। খুব উঁচু মাপের সাংগঠনিক দক্ষতার মানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই, তা না হলে এসব প্রতিষ্ঠানকে সফলভাবে দিকনির্দেশনা দেয়া সহজ নয়। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে থেকেও তিনি নিজের বিনেপয়সার কুরআন শিক্ষক পরিচয়কে সমুন্নত করেছিলেন।

ধর্ম পালন ও প্রচারের আগ্রহ নিয়ে সুদীর্ঘ জীবনে নানা কর্মে যুক্ত হয়েছেন। পরিণত বয়সে এই মতে উপনীত হয়েছিলেন যে, ইসলামের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ করার ক্ষেত্রে সমাজের জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন করাই প্রাথমিক ও মৌলিক প্রয়োজন। সে হিসেবে তরুণদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার কাজ হাতে তুলে নেন। তার ছাত্রদের কাছে তিনি ‘চাচা’ ছিলেন। তাদের মুখে ‘স্যার’ ডাক তিনি পছন্দ করতেন না। ঔপনিবেশিক কালের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে অতিক্রম করে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে ভালোবাসায় মোড়া এক অনুপম রূপ দিয়েছিলেন। তিনি আমার পিতৃব্য ছিলেন, আমি তার ভ্রাতুষ্পুত্র। সে কারণে অনাত্মীয় যে ছাত্ররা তাকে চাচা ডাকতেন, তাদের তুলনায় আমি তার কাছের ছিলাম বা বেশি স্নেহের ছিলাম, তা বলা সত্যের অপলাপ হবে।

বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের ইসলামী বিষয়ে আলোকিত করতে তিনি একটি পাঠ্যতালিকা প্রস্তুত করেন। ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন ‘অধিকতর প্রয়োজনীয়’ সে তালিকার বইগুলো পড়ে শেষ করতে, যাতে তারা ইসলাম ও সমসাময়িক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার যোগ্য হতে পারে। তিনি লেখালেখি ও ইসলামের দাওয়াত দেয়ার বিষয়েও উৎসাহ দিতেন।

কেউ কেউ পরবর্তীতে শাহ আবদুল হান্নানের কাজকে বেগবান করার ক্ষেত্রে ছাত্র হিসেবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুরুকে ছাড়িয়ে গেছেন। আবার অনেকেই একজন ক্ষমতাবান মানুষের সাহচর্যে নানা বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় তার কাছে আসতেন। অনেকে শিক্ষক হিসেবে তার বদান্যতার নানা সুযোগ গ্রহণ করতেন। পরিবারের বাইরের মানুষের সামনে আমি অন্যদের মতোই তাকে চাচা ডাকার কারণে এই সুযোগসন্ধানীরা অনেকেই তার পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাকে আলাদা করতে পারতেন না। তাদের মুখোশের আড়ালের মুখ আমি চিনে ফেলেছিলাম। আমি নিজে এ বিষয়টি নিয়ে কখনো তাকে কিছু না বললেও অনেক দীর্ঘ সময় ধরে আমার ধারণা ছিল, তিনি এসব বুঝতে পারেন না। বহু বছর পরে এক দিন খাবার টেবিলে এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য থেকে আমি বুঝতে পারি তিনি ওই সব লোকের প্রকৃত রূপ জানতেন। কিছু বলতেন না। কারণ তিনি সবসময় আশা করতেন, এরা ইসলামের জ্ঞানে আলোকিত হবে, নিজেদের মানবিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে শিখবে। ছাত্রের প্রতি এ ভালোবাসা ও আশাবাদ শিক্ষক হিসেবে তাকে অনন্য মহিমায় স্থাপন করে।

তার সমপর্যায়ের অন্য বেশির ভাগ ব্যক্তির মতো প্রাচুর্যের জীবনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শাহ আবদুল হান্নান যা বিশ্বাস করতেন তার জন্য নিজের জীবনকে কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা ভেবে দরবেশের মতো দীনহীন তার জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এর কারণে কাছের মানুষদের নানা অসুবিধা হতো। তাদের অনুযোগও তিনি হাসিমুখে মেনে নিতেন। ধৈর্য ধরতেন, অন্যদেরও ধৈর্যের উপদেশ দিতেন। বিশ্বাস, সৎকর্ম, মানুষের কল্যাণ চিন্তা, ন্যায়পরায়ণতা, সততায় তার প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি নিয়ে তার মৃত্যুর পর নানা মানুষ নানা কথা লিখেছেন।

কবরে রেখে আসা কায়ার সাথে হারিয়ে যায় তার ছায়াও। কিন্তু এর পরও একটি ছায়া রয়েই যায়- মনের ওপর মনের ছায়া। মানুষের অন্তরে মানুষের স্মৃতির ছায়া। আমাদের আনন্দ-বেদনা, আলো-আঁধারির মর্ত্যলোক থেকে শাহ আবদুল হান্নান চলে গেছেন। কিন্তু তার ছায়া রয়ে গেছে মানুষের মনে, অসংখ্য মানুষের প্রাণে- যারা কর্ম ও শিক্ষাগ্রহণের সূত্রে নানা সময়ে তার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। তাদের অনেকে শাহ আবদুল হান্নানের মৃত্যুর পর পত্রিকার পাতায় বা সামাজিক মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন। তাদের লেখনীর কালিতে যে ছায়া তৈরি হয়েছে তার বিশালতা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। বড়ো দেহের মানুষের বড়ো ছায়া পড়ে, অথবা ছায়া লম্বা হয় যখন দূরদিগন্তের ওপার থেকে সূর্যের আলো ব্যক্তির গায়ে এসে পড়ে। চলে যাওয়া শাহ আবদুল হান্নানের মানুষ হিসেবে এর দুটোই ছিল- বড় মনের মানুষ ছিলেন, এক অপার্থিব আলোয় আলোকিত মানুষও ছিলেন, যে আলো তিনি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে গেছেন সবার মধ্যে।
আল্লাহ আমার বড়চাচ্চু শাহ আবদুল হান্নানকে তার অপার ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিন। বড়চাচ্চু নিজের জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। দেশ ও সমাজের নানা উত্থান-পতনের মুখে- সব নিকষ অন্ধকারের মুখে দাঁড়িয়েও বড়চাচ্চু আল্লাহর অনুগ্রহের আশা করতেন। তার সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থাকতেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বড়চাচ্চুর প্রভুও তার ওপরে সন্তুষ্ট হবেন। তাকে পরম মমতায়- পরম অনুগ্রহে গ্রহণ করবেন। তাকে স্থান দেবেন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সাথে।

পরিবারের অন্য অনেকের মতো আমিও আশা করি, বড়চাচ্চুর সাথে আমাদের আবারো দেখা হবে এক সোনার তোরণের মুখে, যে তোরণের ওপাশে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে পাশ দিয়ে ঝরনা বয়ে চলা বাগান, যেখানে কোনো ভয় নেই, দুঃখ নেই।


লেখক : শাহ আবদুল হান্নানের ভ্রাতুষ্পুত্র, প্রবাসে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণারত, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
‘পেশাগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে’ গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সকল