১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তিপদক ঘোষণা

বিশ্ব শান্তির সপক্ষে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক পান বঙ্গবন্ধু - ছবি : সংগৃহীত

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ক্রমেই হিংস্র হয়ে উঠছে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পৃথিবীর মানুষ আজ একটি নতুন মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রত্যাশা করলেও সে আশা কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। এই মুহূর্তে শান্তির বাণী আরো বেশি করে উচ্চারণ করা দরকার। একবিংশ শতকের এই চরম ঔৎকর্ষের কালেও জুলিও কুরি শান্তি পদকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি পরিষদের সদস্য। সে হিসেবে আগামী দিনে আমাদের গবেষণাধর্মী কার্যক্রম জোরদার করে ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তিপদক’কে প্রাতিষ্ঠানিকতায় উন্নীত করা সম্ভব।

১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। শোষিত ও বঞ্চিত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও-কুরি’ পুরস্কার প্রদান ছিল তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে অসামান্য ঘটনা। পরের বছর ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও-কুরি’ পদক তুলে দেন ওই পরিষদের সেক্রেটারি-জেনারেল রমেশ চন্দ্র। সে সময় এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুই দিনের এক সম্মেলনের আয়োজন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্বশান্তি পরিষদের নেতারা এই সভায় মিলিত হন। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়াও আপসো, পিএলও, এএমসি সোয়াপো ইত্যাদি সংস্থার অনেক প্রতিনিধি উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানে ভারতের ৩৫ জন প্রতিনিধির নেতা কৃষ্ণমেনন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা জন রিড উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই এশীয় শান্তি সম্মেলনের ঘোষণায় উপমহাদেশে শান্তি ও প্রগতির শক্তিগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত করে।

বঙ্গবন্ধুর ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার ওই সংগ্রামকে ইতিহাসে চির অম্লান করে রাখার লক্ষ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে। তাকে পদক প্রদানের পেছনে কাজ করেছে বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম করেছেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। শিশুদের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। বাংলা ভাষা ও বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস পরিশ্রম করেছেন। দেশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের জন্য তিনি স্মরণীয়। জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তি ছিল তার জন্য এক বিরল ও ঐতিহাসিক সম্মান। এই পদক অর্জনের বিষয়কে শুধু তালিকাভুক্ত একটি পদক হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আমাদের কর্তব্য এই পদকের তাৎপর্যগত দিক বিবেচনায় নেয়া। সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা। এই কার্যক্রমকে গবেষণা কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করে তা সুদৃঢ়করণ ও প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার জন্য আমাদের সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

জুলিও কুরি শান্তি পদকের মর্যাদা ও সম্মান খণ্ডিতভাবে দেখার অবকাশ নেই। এ পদকের গৌরব ও অহঙ্কার আমাদের হৃদয়ে লালন করতে হবে। এই গৌরব ও অহঙ্কারের শক্তিতে শক্তিমান হওয়ার মাধ্যমেই আগামী দুই হাজার একচল্লিশ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে এবং এমন আশা করাও ভুল হবে না যে, নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে জুলিও কুরি পদক অর্জনের মতো অনেক নতুন মুখের সৃষ্টি হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শপুষ্ট ও অনুসারীদের মধ্য থেকে এ প্রত্যাশা পূরণে আগামী প্রজন্মকে স্বপ্নমুখী হতে হবে এবং স্বপ্ন পূরণের জন্য ঐকান্তিকভাবে কর্মপ্রয়াস চালাতে হবে। তা হলে বঙ্গবন্ধুর আত্মা সুখ পাবে। এতে লোকান্তরিত মুজিব অনেক বেশি সম্মানিত হবেন। ক্রমে ক্রমে তা এক অবিনশ্বর শক্তির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থায়ী শান্তির নিবাসে পরিণত হবে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক অর্জন বিশ্ব শান্তিতে অগ্রণী ভূমিকায় এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক যা আগামী প্রজন্মকে বিশ্ব শান্তিতে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে সর্বদা প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।

১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিশ্বশান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করেন এবং বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ সেদিন থেকেই বাঙালি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব। অনুষ্ঠানে বিশ্ববন্ধু সম্মান পেয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’

‘জুলিও কুরি’ পদক বিশ্বের শান্তির জন্য নিবেদিত। বিশ্বের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিই এ পুরস্কার পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, চিলির সার্ভে আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবল নেরুদা, মার্টিন লুথার কিংসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই তার উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত ২৩ মে ২০২৩ বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলো। আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই অর্জন আন্তরিকতার সঙ্গে স্মরণ করি।

আমরা বর্তমানে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব দেশকে ভালোবাসা। আর দেশকে ভালোবাসতে হলে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম সে ভাবধারায় লালিত-পালিত ও পরিপুষ্ট হতে হবে। আগামী প্রজন্মকে সে লক্ষ্যে তৈরি হবার জন্য বিশেষ মনোযোগী হতে হবে।

বাংলাদেশের জুলিও কুরি শান্তি অভিধায় আখ্যায়িত বঙ্গবন্ধু সংসদ নামীয় এই গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানটি আত্মপ্রকাশের পর জাতীয়ভাবে ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শান্তিপদক প্রবর্তন করে। পদক প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে এ সংগঠনটি প্রতি বছর জাতির দেশপ্রেমিক গুণীজনদেরকে শান্তি ও মানবতায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু শান্তি পদক প্রদান করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি সংসদ ‘আমাদের জুলিও কুরি বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক একটি পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এ অভিমত পোষণ করছি যে, জাতীয়ভাবে এ পদক প্রবর্তনের মাধ্যমে একটি চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে। এ সংগঠন যদি নিরলস ও নিঃস্বার্থভাবে মানবতার জন্য কাজ করে যায়, তাহলে জাতীয়ভাবে সেবা সংহতির বন্ধন অটুট হবে। হাঁটি হাঁটি পা পা করা এ সংগঠনটির দিগন্ত একদিন প্রসারিত হবে। সম্ভাবনা ও মহিমার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হবে বাংলাদেশ। সম্মানিত হবে এ দেশ, দেশের সাধারণ গরিব-দুঃখী মানুষ। দূর হবে অনাচার, শাসন, শোষণ, নির্যাতন। প্রতিষ্ঠা পাবে মূল্যবোধ আর মানবতা। মানুষ হবে মানুষের জন্য। সভ্যতার ভিত্তিভ‚মিতে মজবুত সমাজ বিনির্মাণ লাভ করবে। মানুষের মধ্যে মুক্তচিন্তা ও শুভবুদ্ধির উদয় হবে। প্রগতির বাণীতে শুদ্ধাচার লালন করে মাতৃভ‚মিতে ফলাবে নির্ভেজাল ফল ও ফসল। আজকের এ বঙ্গবন্ধুর শান্তি পদক থেকে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তি পদক প্রবর্তিত হলে বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব অমরত্ব লাভ করবে এবং বিশ্বসভায় বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিশেষে বলতে পারি যে, আজকের বিশ্ব শান্তি পরিষদ এবং সচেতন বিশ্ব মানবসমাজকে সোচ্চার হতে হবে যেন বিশ্ব শান্তি পদক নামে আরেকটি শান্তি পদকের ঘোষণা আসে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি পদক নামের আরেকটি পদক তালিকায় পুরস্কারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে বিশ্ব মানবতাকে সমুন্নত করার সময় এসেছে। ইতিহাস যদি শাশ্বত ও চিরকালের হয়ে থাকে তাহলে বিশ্বশান্তি পরিষদ নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর নামে বিশ্বশান্তি পদকের প্রবর্তন করে শান্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর সমর্পিত জীবনকে চিরকালের মানুষের জন্য একটি স্বীকৃত ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করে যাবেন। বিশ্বশান্তি পরিষদের কাছে আজ আমাদের এ আহ্বান।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
অপহৃত চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ার রামেক আইসিইউতে, গ্রেফতার ২ বাংলাদেশের নতুন স্পিন কোচ পাকিস্তানের সাবেক তারকা ক্রিকেটার মান্দায় বিদ্যুৎপৃষ্টে দর্জি ব্যবসায়ীর মৃত্যু সমর্থকদের মাতামাতি করতে মানা করলেন শান্ত বান্দরবানের কেউক্রাডং পাহাড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান : আটক ৮, অস্ত্র উদ্ধার স্বাধীনতা সূচকে ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম নাটোর পৌরসভা কার্যালয়ের ভিতরে দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত কাঁঠালিয়ায় মাঠে ছাগল আনতে গিয়ে বজ্রপাতে কিশোরে মৃত্যু সালমান খানের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেফতার ২ আরো দুই সদস্য বাড়িয়ে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন রাবির নতুন জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে

সকল