১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঐতিহাসিক সত্যের সন্ধানে

ঐতিহাসিক সত্যের সন্ধানে - ছবি : সংগৃহীত

এম আর আখতার মুকুলের ‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’ নামীয় বই প্রসঙ্গে গত ১২ মার্চে প্রকাশনার পরবর্তী :
ঙ) এর ২১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের কাছে জাতীয়তাবাদের আদর্শ হলো পরাজিত। কারা দায়ী সেটা বিতর্কিত এবং বিরাট ইতিহাস।’ অথচ লেখক তার ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইটির ৫১ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘মনে রাখবেন, আজকে আমরা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করছি, তাদের অনেকেই এই কলকাতা শহরেই বছর পঁচিশ আগে ‘হাত মেঁ বিড়ি মু মে পান লড়কে লেংগে পাকিস্তান’ করে গেছি। তাই কারা দায়ের বিতর্ক আর থাকে কৈ?

চ) ১৯৯ পৃষ্ঠায়, ‘ধর্মকে কোনো দিনই রাষ্ট্রীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায়নি এবং ধর্ম হচ্ছে মানব সমাজের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ব্যাপার। অন্য দিকে জাতি হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ জাগতিক বিষয়।... ইংরেজিতে ‘নেশন’ ও ‘রিলিজিয়ন’ বলে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দ আছে, যার বাংলা মানে দাঁড়ায় ‘জাতি’ ও ‘ধর্ম।’ প্রচলিত রীতি অনুসারে কোনো দেশের ভৌগোলিক নাম অনুসারেই সে দেশের অধিবাসীদের ‘জাতি’ ঠিক হয়।’ না, ধর্মকে রাষ্ট্রীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখার বিষয়ই নয়, তবে প্রশ্ন অনুসারীদের। স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্মের অনুশীলনসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ের পবিত্রতা রক্ষার নিশ্চয়তা, স্থান, কাল, সংখ্যালঘিষ্ঠতার দুর্বলতা, ইতিহাস ইত্যাদি কারণে বাধাগ্রস্ত ও নির্যাতিত হওয়ার অবস্থাগত আশঙ্কা নিবারণের সুযোগ ও সম্ভাবনায় আগাম ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। এই উপমহাদেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস ধর্মীয় সহনশীলতার সাক্ষ্য দেয় না। জাতি ও ধর্ম বলে দু’টি ভিন্ন শব্দ অন্য কোনো ভাষায় না থাকার কথা নয়। ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত খ৩, প১, পৃ-৭৮৫-তে উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের স্মরণীয় উক্তিটি হলো : ‘এ দেশের অধিকাংশ মুসলমানই বংশগত জাতিতে হিন্দু, ধর্মগত জাতিতে মুসলমান।’ তিনিও কী না বুঝে ধর্মগত জাতির এ স্বীকৃতি দিলেন?

জাতিত্বের প্রকার ভেদগুলো হলো : ১। উপমহাদেশের ভৌগোলিক সীমাগত মাত্র একটি জাতিই ‘ভারতীয়’; যাদেরকে এই সেদিনও বা এখনো আরবরা হিন্দি এবং ভ‚-ভাগকে হিন্দ বলে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলটির নামকরণের যথার্থতায়ও তার সমর্থনে ভারতীয় জাতিত্ব স্বীকার করি নাই। ২। বংশগত প্রধান জাতি দ্রাবিড় ও আর্যসহ কিছু উপজাতি। ৩। এরই ধর্মীয় বিভাজনে প্রধান সাতটি জাতি হয়- হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান এবং পারসি, যাদের আবার ভাষাগত বহুবিধ জাতি হলো : ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত হতে উৎপন্ন প্রায় ১৩টি এবং দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান চারটি হতে আরো ৯টি। অবস্থাগত কারণে আঞ্চলিকতার ন্যায় এগুলোরও প্রয়োজনে আধুনিক রাজনৈতিক অস্ত্রস্বরূপ ব্যবহার হয়ে থাকে। উপমহাদেশের সাথে আমাদের বৈপরীত্য হলো : ধর্মীয় জাতিত্বে আমরা বহিরাগত, সংখ্যালঘু এবং সত্তার সংবেদিত, আহার, আসন, বসন ও নামে অভারতীয়, স্বভাব ও আচার-আচরণে অস্ট্রিকদের ন্যায় অলস, কল্পনা, বিশ্বাস ও ভাবাবেগপ্রবণ, ভাষাগত জাতিত্বে কিছুটা সংমিশ্রিত। তবে দখলদারও মনে করা হয়। ড. অসিত কুমার তার পূর্বোল্লিখিত বই-এর ৬৯৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘ভারতের পার্শ্ববর্তী স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ বাংলা ভাষা লইয়াই জীবন মরণপণ করিয়া লড়িয়াছিল। এ রাষ্ট্রের বাঙলা ভাষা বাঙালীর মুখের ভাষা। তা হতে কিন্তু মুসলমানের কোনো পৃথক সত্তা নাই।’ ডা: কালিদাস বৈদ্যও তার ‘বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালে শেখ মুজিব’ নামক বইটির ২০৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘পূর্ববঙ্গ পেল তথাকথিত স্বাধীনতা। কিন্তু বাংলাদেশ নাম দিয়ে তারা পশ্চিম বাংলাকেও কাগজ-কলমে গ্রাস করল। আর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার অধিকারী হলো তারাই। অর্থাৎ বাংলা ভাষারও জবরদখল তারা নিল।’ ১০৯৫ হতে ১২৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৭৫ বছরব্যাপী খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের নামীয় খ্রিষ্টান রোমান সাম্রাজ্য তুর্কি মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত, যার শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। রোমান রাজা কনস্টান্টাইনের নামের কনস্টান্টিনোপলের নয়া নামকরণ হয় ইস্তাম্বুল এবং রোমানদের সর্বোৎকৃষ্ট স্থাপত্যের নিদর্শনে নির্মিত সেন্ট সোফিয়া গির্জাটিও তখন হয় মসজিদে রূপান্তরিত। বস্তুত রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান গির্জাগুলোর নানা দুর্নীতি, অনৈতিকতা, বাইবেলের অপব্যাখ্যায় ধর্মীয় স্বৈরাচারিতায়
জার্মানির মার্টিন লুথারের (১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রি) প্রতিবাদ ও সংস্কারে ১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টানদের মধ্যে জন্ম নেয় প্রতিবাদী নামে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়, যার স্রোতে ইউরোপ হয় রক্তাক্ত। শুরু হওয়া ধর্মতত্ত্ববিদদের নূতন ধ্যান-ধারণায় বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে উদ্ভব হয় ধর্মনিরপেক্ষতার (Secularism) নীতি। এ প্রসঙ্গে Encyclopaedia Micropaedia, V-IX, P-18 তে বলা হয়েছে, "These theologians maintain that the real meaning of the message of Jesus can be discovered and fulfilled in the every day affairs of reyular urban living." (এই ধর্মতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে, যিশু খ্রিষ্টের বাণীর প্রকৃত অর্থ ধর্মনিরপেক্ষভাবেই শহরের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পাওয়া ও পরিপূর্ণ করা যায়)।

ছ) পৃষ্ঠা ২০০, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘থিওরি’র নামকরণ হলো ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব।’ এথিওরিতে বলা হলো ‘হিন্দু’ একটি জাতি এবং ‘মুসলমান’ আর একটি পৃথক জাতি।...রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে বিষয়টা ভ্রমাত্মক। এটা কিছুতেই ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ নয়- এটা ছিল ‘দ্বিধর্ম তত্ত্ব’। এ বক্তব্যের খণ্ডনীয় ও জোরালো বক্তব্যটি ভারতের খ্যাতিমান সম্পাদক রাজমোহন গান্ধীর UNDERSTANDING THE MUSLIM MIND বইটির ১৫৪ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি মতে,‘We are a nation with our own distinctive culture and civilisation, language and literature, art and architecture, names and nomenclature, sense of value and proportion, legal laws and moral codes, customs and calender, history and traditions, aptitudes and ambitions,” উল্লেখ্য, এই দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারক ও বাহক ছিলেন মি. জিন্নাহ। তত্ত্ব মতে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে সমর্থন লাভে অ্যালান অকটোভিয়ান হিউম ও বদরউদ্দিন তায়েবজির লেখা চিঠির প্রতিউত্তরে ১৮৮৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্যার সৈয়দ আহম্মদ এই তত্ত্বের উল্লেখে সমর্থনে অনীহা প্রকাশ করেন। এই কারণের মূলেও হিন্দির সমর্থনে উর্দু ভাষাকে হিন্দুদের তীব্র বিরোধিতা।


আরো সংবাদ



premium cement