১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আরাভ খানদের ‘জন্ম’ দেয় কারা

আরাভ খান। - ছবি : সংগৃহীত

গত ক’দিন মিডিয়া তোলপাড় করা আরাভ খান ইস্যু সংবাদের বাজারে আর থাকবে ক’দিন? প্রশ্নটা এ কারণে যে, এর আগে এনু-রূপন দুই ভাইয়ের কিচ্ছাও হারিয়ে গেছে সেই কবে। এখন সবকিছু মনে করিয়ে দিলেও স্মরণে আনা যায় না। ফরিদপুরের বহুল আলোচিত দুই ভাই রুবেল-বরকতের অবিশ্বাস্য অঙ্কের বিপুল অর্থের মালিক হওয়া ও বিদেশে পাচারের কথাও মানুষকে দিব্যি ভুলিয়ে দেয়া গেছে। তাই প্রশ্ন, আরাভ খানের আরব্য রজনীর কাহিনীর চেয়েও পিলে চমকানো সিনেম্যাটিক স্টাইলে খুন, নাম পাল্টে বিদেশে চম্পট, দুবাইতে স্বর্ণের বিশাল শোরুমের রাজকীয় ঘটনা ক’দিন মনে থাকবে? পরবর্তী কোন ঘটনা অপেক্ষা করছে এসব ভুলিয়ে দিতে?

অল্পকথার মাঝে উচিত কথার বোমা ফাটিয়েছেন হিরো আলম। তার মতে, পুলিশের এখন উচিত সাকিব ও সে ব্যক্তি যারা আরাভ খানের শোরুম উদ্বোধনে দুবাই গিয়েছিলেন তাদের একটা মেডেল দেয়া। যুক্তিবিদ্যার তত্ত¡ বলেছেন, তারা সেখানে গেছেন বলে আরাভের সন্ধান পাওয়া গেছে। নইলে দেশবাসীর অজানা থেকে যেত, আমাদের একজন আরাভ খান আছেন। কারা কিভাবে আরাভ খানদের জন্ম দেন, তাও কি জানা যেত? হিরো আলমের প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। ক্রিকেট নক্ষত্র সাকিব-হিরো আলমদের উছিলায় অন্তত একজন আরাভ খান দৃশ্যপটে এলেন। ফেলে দেয়ার মতো নয় হিরো আলমের যুক্তি।

একই সময়ে চিত্রনায়িকা মাহিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুলের বিরুদ্ধে ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ তুলে ফেসবুকে লাইভ করেছেন। এর পর ওমরাহ করে দেশে ফিরলে বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করতে দেরি হয়নি। সোজা আদালত, সেখান থেকে কারাগারে। আবার কয়েক ঘণ্টা পরে জামিনে মুক্তি। ছবির কাহিনী নয়, একবারে বাস্তব। পুলিশ ও আইনের কী যজ্ঞ দেখল মানুষ? পুলিশ হত্যার আসামি নিয়ে এর শতভাগের একভাগ হলেও কী জন্ম হতো একজন আরাভ খানের? মাহির ক্ষেত্রে পুলিশের যে উদ্যম তাতে আরাভ খানের ঘটনায় ফল কেমন হতে পারত? গোপালগঞ্জের মাছ বেপারি বা ফেরিওলার ছেলে সর্বোচ্চ স্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা, পাঠ নেয়া আরাভ খানদের এখানে তাদের মা-বাবারা জন্ম দেন না। তাদের জনক সরকারি- বেসরকারি বড় বড় হোমরা-চোমরা।

ফরিদপুরের বহুল আলোচিত দুই ভাই রুবেল-বরকতের বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হওয়া ও কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা নিয়েও কিছু দিন হইচই চলেছে। পরে মানুষ ভুলে গেছে অন্য আরেক ঘটনার তোড়ে। মানুষ জানতে পারল না, কী করে সম্ভব হলো ক্ষমতাসীন তৃণমূলের সংগঠনের দুই ভাইয়ের ধনকুবের হওয়ার কাহিনী? এসব জানানোর ব্যবস্থা না করে বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তিকে দৌড়ের ওপর রাখা হয় কিছু দিন। প্রভাবশালী এক পরিবারের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পরে নানা দুর্নীতি ও একটি মামলা করে সিআইডি। এতে ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একটি অংশ আনন্দ মিছিল করে। আরেক গ্রুপ কষ্ট পায়। ততক্ষণে ঘটনা ভুলে গেছে মানুষ। পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগের দুই নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার ক্ষেত্রেও প্রায় একই অব্সথা হয়েছে। দুই ‘ক্যাসিনো ব্রাদার’ এনু ও রুপন কিভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেন, অবৈধ অর্থ কাকে কাকে উপঢৌকন দিয়েছেন, কিভাবে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতেন কিছুই জানানো হলো না। অথচ জিজ্ঞাসাবাদে তারা ২২টি বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ও অন্যসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বড় অংশ ক্যাসিনোর টাকায় কিনেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

এনু ও রুপন ২০১৮ সালে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের পদ পাওয়ার পরপর এলাকায় তাদের আধিপত্য বেড়ে যায়। তাদের কাছে ভিড়েন এলাকার অনেক প্রভাবশালী। তারা একটা বাহিনীও গড়ে তোলেন।
এনু ও রুপনদের বাড়িতে এবং তাদের দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে এনু-রুপনের লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাসায় অভিযান চালিয়ে ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা, পাঁচ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআরের কাগজ এবং এক কেজি সোনা জব্দ করে র‌্যাব। এখন তো আরাভ খানের আগের সব ঘটনা মামুলি বা সামান্য হওয়ার উপক্রম। মরু আরবের শেখদের বালুতে ফোটা এ বিরল প্রজাতির বাঙালি ক্যাকটাসের আরাভ খান দুবাইতে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামে একটা গয়নার দোকান খুলেছেন। ৪৫ কোটি টাকা খরচ করে ‘মাত্র’ ৬০ কেজির সোনায় বানানো বাজপাখি দোকানের কোনায় লোগো হিসেবে বসানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ঘোষণা-ইন্টারপোলের সহায়তায় দুবাই থেকে ধরে আনা হবে আরাভ খানকে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।’ বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুসও বড় কড়া।

জানিয়েছেন, ছাড় নেই সাকিবেরও। দুবাইতে পলাতক আসামি আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন ঘটনায় সাকিবের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে বিসিবি। এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর সুযোগ আছে কিনা, বিসিবির সাথে সাকিবের চুক্তি খতিয়ে দেখা হবে। ধর্ষণ, অসদাচরণসহ নানা গুরুতর অভিযোগ আনার প্রতিবাদে গুলশান থানায় মামলা করতে গেলে শাকিব খানকে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। থানা থেকে অগ্রাহ্য হয়ে তিনি গেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা অফিসে। দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের করা মামলায় আলোচিত চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সকালে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়া, বিকালে জামিনে মুক্ত হওয়া, সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। সবই ঘটেছে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যথারীতি বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাকে ধরেছে।’ পরের বাক্যে বলেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মাহির অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।

ওমরাহ সেরে সৌদি থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পরপর মাহিকে পাকড়াও করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। দ্রæত আদালতে হাজির, ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন, কারাগারে পাঠানোর হুকুম। রাত ৮টার আগে নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুর জেলা কারাগারে। মূল ফটকে নিতে না নিতে কারামুক্তি। ভি-চিহ্ন মাহির। ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষীদের ফুল ছিঁটানোর বিনা স্ক্রিপ্টের সিকোয়েন্স। মাহির ‘অপরাধ,’ ফেসবুক লাইভে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুলের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলা। গাজীপুরের ভাওয়াল কলেজ এলাকায় মাহি ও তার স্বামীর গাড়ির শোরুমের জায়গায় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে। ঘুষ নিয়ে এতে সহায়তা দিয়েছে পুলিশ। এমনতর অভিযোগে পুলিশের মানহানি হয়েছে। মামলায় কড়া অ্যাকশন পুলিশের। আবার ম্যাজিকের মতো একই আদালত থেকে জামিনে মুক্তি। এর আগে, এই নায়িকা কিছু দিন শিরোনাম ছিলেন পদচ্যুত প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদের গালিগালাজের অডিও ফাঁসসহ ভিন্ন কিছু কারণে। নইলে কে জানত এ ঘটনা ?

আরাভ খানের কান টানলে মাথা চলে আসার মতো। জানাজানি হয়ে যায় জুয়েলারি দোকানটির মালিক আরাভ খানের ঘটনাও সিনেমাকে হার মানানো। এসবি ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাসহ বহু অপকর্মের, এই ভিলেনের গডফাদার বড় শক্তিধর। রবিউল, বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুটিয়া গ্রামে। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে এসবি ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকাণ্ডের পর আরাভ খান চম্পট দেয় ভারতে। সে তার নামে একজনকে আত্মসমর্পণ করিয়ে জেলেও পাঠায়। আর নিজে ভারতীয় নাগরিক পরিচয়ে পাসপোর্ট করে পাড়ি দেয় দুবাই। বেনজীরের স্ট্যাটাস এখন নজিরবিহীনভাবে আলোচনার বিষয়। যে যেভাবে পারছেন আলোচনা জমাচ্ছেন। যার যেমন বুঝ, তেমন বুঝে নিচ্ছেন। সব গণমাধ্যমে না এলেও যার যা বোঝার বুঝে নিচ্ছেন। বোঝারও তো মাত্রা আছে, সীমা আছে। পুলিশ বা বিভিন্ন বিভাগের প্রভাবশালীদের হাতের ছোঁয়া লাগলে কারো আরাভ খান হয়ে যেতে সময় লাগে না।

ক্রিকেটার সাকিব বা হিরো আলমরা দুবাই না গেলে হয়তো ঘটনা ঘটত না। একজন আরাভ খানকে চেনা হতো না। শাকিব বা সাকিব বড় বরকতি নাম। এর বাংলা অর্থ- উজ্জ্বল, দীপ্ত, প্রবহমান ইত্যাদি। তারা সবাই যার যার রাজ্যে উজ্জ্বল, সুপারস্টার। এই তারকাময়তায়ই এখন মাঠ-ঘাট-খাট কাঁপানো আরাভ খানরা একটু ব্যতিক্রম। পাড়া-মহল্লায়ও এদের জন্ম হচ্ছে বিশেষ বিশেষ কারো পরশে। ঘটনা চক্রে কাহিনী ধরা না পড়লে তারা অবলীলায় বেড়ে ওঠে। জাতির কর্ণধার হয়ে যেতেও সময় লাগছে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল