২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আমাদের এত উন্নয়ন গেল কোথায়?

আমাদের এত উন্নয়ন গেল কোথায়? - ছবি : সংগৃহীত

জয় হোক এই দেশের শাসকগোষ্ঠীর চোয়ালের! জয় হোক আমলা থেকে কামলা অর্থাৎ- দেশের সব শ্রেণীর লোকের! শাসকগোষ্ঠী, আমলা-কামলাদের চোয়ালের জোরে দেশ আজ কতই না উন্নত। সেই ১৯৭২ সালে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের দেয়া তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাবপ্রাপ্ত এই দেশকে চোয়াল দিয়ে সিঙ্গাপুর, কানাডা, আমেরিকা বানাতে কতইনা কষ্ট করেছেন শাসকগোষ্ঠী ও তাদের চেলাচামচারা। তবে এটি সত্য যে, গুণে-মানে, চাল-চলনে, খাওয়া-দাওয়ায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, আমেরিকার চেয়ে এই দেশের এমপি-মন্ত্রী, চেলাচামচা, পাইক-পেয়াদাদের কমতি কোথায়! কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই দেশের মন্ত্রী, আমলাদের চেয়েও এই দেশের মন্ত্রী, আমলাদের পাইক-পেয়াদা, থানার সিপাহি-দারোগার টাকা পয়সা অনেক বেশি। মন্ত্রী-এমপিদের সুখ বিলাসিতার তো কোনো হিসাবই নেই। সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন একেকজন। কেউবা করেছেন বিদেশের মাটিতে বেগমপাড়া। কেউ একবার এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন তো কোটিপতি বনে যেতে সময় লাগেনি। আলাদিনের চেরাগ পেয়ে বসেন সবাই। এদিক বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, জাপানের চেয়েও অনেক উন্নতি করেছে এই দেশ।

এমপি-মন্ত্রী ও সরকারের সুবিধাভোগী চেলাচামচাদের উন্নয়ন হলেও দেশের সার্বিক উন্নয়ন যে তলানিতে ঠেকেছে, সেই বেলুনই ফুটো হয়ে গেছে দোহায় অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘের লিস্ট ডেভেলপ কান্ট্রিজ (এলডিসি) সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে বিশ্বের স্বল্পোন্নত ৪৬টি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ৩৩টি আফ্রিকা মহাদেশের। ৯টি দেশ এশিয়া মহাদেশের ও বাকি চারটি ক্যারিবিয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। এশিয়া মহাদেশের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে আছে আফগানিস্তান, তারপরই আছে বাংলাদেশের নাম। এশিয়ার বাকি সাতটি দেশ হলো- ভুটান, কম্বোডিয়া, লাও পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক (লাওস), মিয়ানমার, নেপাল, পূর্ব তিমুর ও ইয়েমেন। দেউলিয়া দেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের নাম এই তালিকায় না থাকলেও আমাদের দেশের এমপি-মন্ত্রীদের চোয়ালের জোরে প্রতিষ্ঠিত কানাডা, সিঙ্গাপুরের চেয়েও উন্নত বাংলাদেশ কিন্তু এশিয়া মহাদেশে বহাল তবিয়তে দারিদ্র্যের দ্বিতীয় অবস্থানেই আছে।

এখন দেখা যাক, জাতিসঙ্ঘ কেন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রাখল? এর আগে আমাদের জানা দরকার স্বল্পোন্নত দেশের সংজ্ঞা। ‘স্বল্পোন্নত দেশে’ সাধারণভাবে ওই সব দেশকে বোঝায়, যেসব দেশের অর্থনীতি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অবকাঠামো ও জনসংখ্যাসংক্রান্ত যাবতীয় সূচক নিম্ন অবস্থান করছে। তবে জাতিসঙ্ঘের মানদণ্ড অনুযায়ী, যেসব দেশের মাথা পিছু আয় এক হাজার ১৮ ডলারের নিচে সেগুলোকে স্বল্পোন্নত দেশ বলা যায়। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনগণ পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত অভাবে ভোগে, স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার নিম্ন থাকে, ফলে শিক্ষিত জনসমষ্টির হারও থাকে কম। এ ছাড়া বেশির ভাগ অনুন্নত দেশ ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং পরিবেশগত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। জাতিসঙ্ঘের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে নিশ্চয়ই স্বল্পোন্নত দেশের বৈশিষ্ট্যগুলো বিরাজমান, তাই তারা বাংলাদেশকে দরিদ্রতম দেশের তালিকায় স্থান দিয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় ব্রিজ, রাজধানীজুড়ে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের অবকাঠামো গড়ে তোলার পরও বাংলাদেশ দারিদ্র্যের কাতারে পড়ে কিভাবে? এখানে আবার জাতিসঙ্ঘের কারসাজি নেই তো? দু’দিন পরে হয়তো মন্ত্রীরা জাতিসঙ্ঘকেও দেখে নেয়ার হুমকি দিতে পারেন। অথবা এর জন্য জামায়াত-বিএনপিকেও দায়ী করতে পারেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, রাষ্ট্রের উন্নয়ন এমপি, মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের উন্নয়ন দিয়ে বিবেচনা করা হয়। রাষ্ট্রের সমগ্র জনগণের প্রকৃত অবস্থা তাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যায়।

২০২১ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘সানেম’ রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ। দেশব্যাপী খানা পর্যায়ের জরিপের ভিত্তিতে তারা এই তথ্য পেয়েছে। বিবিএসের খানা জরিপ অনুসারে, ২০১৬ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর করোনার সময়ে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হচ্ছে দেশে দারিদ্র্যের সার্বিক চিত্র।

২০১৬ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায় তখন, বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকত, যা বর্তমানে আরো অধিক। এই তথ্য বলছে, দেশে মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের খাদ্য নিরাপত্তা আজও নিশ্চিত হয়নি। সরকার ও জাতিসঙ্ঘের ‘বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এক যৌথ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টিকর ও বিভিন্ন ধরনের খাবার পায় না। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন শিশুর সঠিক শারীরিক বিকাশ বা বৃদ্ধি হয় না এ দেশে।

এ ছাড়া গেল কয়েক বছরে তীব্র অপুষ্টির হার খুব উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। প্রতিবেদনের অন্যতম গবেষক, আয়ারল্যান্ডের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক বলেন, ‘অপুষ্টির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের জনগণের উৎপাদনশীলতা কমছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বেশি।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সঠিক পুষ্টির অভাবে স্থূলতা ও শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, জাতীয়ভাবে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। এই হার পূর্ব থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি সত্য। তবে সার্বিক অর্থে শিক্ষার হার বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। শিক্ষার মানের নিচুতার কারণে দেশে দক্ষ লোকের অভাব দেখা দিয়েছে। সেটি রাষ্ট্র পরিচালনায় হোক আর প্রশাসনেই হোক বা রাষ্ট্রের যেকোনো পর্যায়েই হোক। সঠিক শিক্ষানীতির অভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রের দৈন্যই রাষ্ট্রের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা যে, দেশের সব মানুষের জন্য একটি সুষম শিক্ষানীতি তৈরি করতে পারেনি। দেশে আইনের শাসন নেই। বিচারের বাণী কাঁদে নীরবে আর নিভৃতে। ধনীদের জন্য বিচার থাকলেও গরিবের জন্য বিচার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন আদালত কাদের কথায় ওঠে আর বসে? সামাজিক ন্যায়বিচার বলতে কোনো কিছু নেই। ধনী-গরিবের বৈষম্য এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখানে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরিবরা আরো গরিব হচ্ছে।

দেশে চোর-ডাকাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই চোর-ডাকাতরা পেটের দায়ে চুরি-ডাকাতি করে না। এই চোর-ডাকাতরা রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি-ডাকাতি করে দেশে-বিদেশে অতি আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করছে। দেশে আজ স্লোগান উঠেছে, ভোট চোর, ভোট ডাকাতদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ আগে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারলেও বর্তমানে একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ভোটের ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের ‘উন্নয়ন’! ভোটসহ সাংবিধানিক এমন কোনো অধিকার নেই যা একজন নাগরিক স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারছে। অর্থাৎ গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে রাষ্ট্র কাঠামোকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্রের মোড়কে আটকে ফেলানোটাও এই সরকারের বড় ধরনের উন্নয়ন!

আজকে দেশের গোটা সিস্টেমটাকে ভয়ের মধ্যে আটকে ফেলেছে। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষে এই কথা বলার সাহস নেই যে, সে ক্ষুধার্ত। যে ব্যক্তি সপ্তাহে একদিন গোশত খেত আজকে সেই ব্যক্তি মাসেও একবার গোশত খাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে না। গোশত তো দূরঅস্ত, ডিমও অনেকে খেতে পারছে না। সারা দিনের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে যেখানে তিন কেজি চাল কিনতে পারে না- ডিম, মাছ, গোশত সেই পরিবার কিভাবে খাবে? দরিদ্রকে অতি দরিদ্র বানিয়ে ফেলার এই কৌশলের বিনিময়ে সরকার কি বাহবা পেতে পারে না? দিনে দিনে জনগণ দরিদ্রের চরমসীমায় পৌঁছে গেলেও নীরব রয়েছে- এর অর্থ হলো, জনগণ ভয়ের মধ্যে আছে। সরকারও জনগণের নীরবতাকে তাদের পক্ষে সম্মতি হিসেবে প্রচার করে উন্নয়নের বাহবা নিচ্ছে। এই না হলে কী আর জনগণের সরকার! তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে- জনগণকে এমন ভয়ের মধ্যে রেখেছে যে, তারা ভয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানসহ মন্ত্রী-আমলাদের কোনো কথারই জবাব দিতে সাহস করে না। কোনো রাষ্ট্রের সরকার যখন কাউকে পরোয়া না করে স্বেচ্ছা কর্ম করে এবং বন্দুকের নল দিয়ে অন্যের প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে, সেই রাষ্ট্রে জনগণ উপবাস করলেও আওয়াজ তুলবে না, এটিই স্বাভাবিক।
তবে এভাবে একটি রাষ্ট্র কোনো একটি একপাক্ষিক শক্তির কাছে জিম্মি থাকতে পারে না। জনগণের উচিত নীরবতা ভেঙে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া। নতুবা এমন একটি সময় আসবে পুষ্টিহীনতার অভাবে হাড়ের সাথে গোশত খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকে গায়ে যতটুকু জোর আছে তাই দিয়েই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। সারা দুনিয়াতেই কর্তৃত্ববাদী সরকার দ্বারা লুণ্ঠিত অধিকার জনগণকেই আদায় করে নিতে হয়েছে। আজকে বাংলাদেশের জনগণের হারানো অধিকার তাদেরকেই আদায় করে নেয়ার সময় হয়েছে। এই দেশের জনগণের জন্য এটি অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

harun_980@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ

সকল