২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রোজায় এনার্জির যথাযথ ব্যবহার

রোজায় এনার্জির যথাযথ ব্যবহার। - ছবি : সংগৃহীত

রোজায় এনার্জির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয়
বর্তমান বিজ্ঞান বলছে, সুস্থ থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনি শরীর কোষ পরিশুদ্ধ রাখার জন্য নিয়মিত ফাস্টিং বা রোজাও জরুরি। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা: একটি হাদিসে বলেছেন, ‘তোমরা রোজা রাখো যেন তোমরা সুস্থ থাকতে পারো।’ আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে তিনি বলছেন, ‘সব কিছুর জন্যই জাকাত বা শুদ্ধি প্রক্রিয়া রয়েছে। শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা।’

শরীরের সব শক্তি জোগায় এটিপি : আমাদের শরীরে বাইরে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কোনো ফুয়েলে তাপ দিয়ে আগুন জ্বলে উঠলে যে হঠাৎ তাপ ও আলোক শক্তিতে রূপান্তর দেখতে পাই, শরীরের ভেতরেও তেমনি ফুয়েল হিসেবে কেমিক্যাল এনার্জি গ্লুকোজ, ফ্যাটি এসিড এবং অ্যামাইনো এসিড জারিত বা অক্সিডাইজড হয়ে তাপ, মেকানিক্যাল এনার্জি ও অন্যান্য শক্তিতে রূপান্তর হয়। এনার্জি যে অণুতে থাকে এবং যেকোনো সময় আমরা কাজে লাগাতে পারি, যা দিয়ে আমরা সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করি, তার নাম হলো এটিপি বা অ্যাডিনোসাইন ট্রাইফসফেট। সুতরাং অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট (এটিপি), সব জীবন্ত বস্তুর কোষে পাওয়া শক্তি বহনকারী অণু। প্রত্যেক কোষের ভেতরে থাকা অস্থায়ী যৌগ এটিপি খাদ্য অণুর ভাঙন থেকে প্রাপ্ত রাসায়নিক শক্তি ক্যাপচার করে এবং অন্যান্য সেল্যুলার প্রক্রিয়াগুলোর জ্বালানির জন্য ছেড়ে দেয়। অন্য কথায়, এটিপি প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট অক্সিডেশন থেকে প্রাপ্ত এনার্জি জমা করে; আবার শরীরের গ্রোথ, সেল ডিভিশন, মাংসপেশির সঙ্কোচন-প্রসারণসহ নানাবিধ কাজের প্রয়োজনে ছেড়ে দিয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। একটি এটিপি অণুতে তিনটি উচ্চ মাত্রার ফসফেট বন্ড থাকে। প্রতিটি মোল ফসফেট বন্ডে সাত হাজার ৩০০ ক্যালরি জমা থাকে। তবে বাস্তব কারণে শেষের দু’টি ফসফেট বন্ডের প্রতিটি থেকেই কার্যত ১২ হাজার ক্যালরি এনার্জি ছেড়ে দেয় যখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাকি ক্যালরি তাপশক্তিতে রূপান্তর হয়। আরেক ধরনের যৌগ যা শুধু মাংসপেশিতে তাৎক্ষণিক এনার্জি সাপ্লাইয়ের জন্য থাকে তা হলো ফসফোক্রিয়েটিন যাতে এটিপির চেয়ে তিন থেকে সাতগুণ এনার্জি জমা থাকে। ১৮০ গ্রাম মোল গ্লুকোজ পুরোপুরি অক্সিডাইড বা জ্বালিয়ে ছয় লাখ ৮৬ হাজার ক্যালরি পেয়ে থাকি কিন্তু এর মধ্য থেকে মাত্র চার লাখ ৫৬ হাজার ক্যালরি এনার্জি (৬৬ শতাংশ) জমা হয় এটিপি ফর্মে। বাকি ৪৪ শতাংশ ক্যালরি এনার্জি সাথে সাথে অন্যান্য কাজ এবং তাপশক্তিতে রূপান্তর ঘটে।

এটিপির গঠন হলো একটি নিউক্লিওসাইড ট্রাইফসফেট, যা একটি নাইট্রোজেনাস বেস (অ্যাডেনাইন), একটি রাইবোজ সুগার এবং তিনটি ধারাবাহিকভাবে বন্ধনযুক্ত ফসফেট গ্রুপ নিয়ে গঠিত। আমাদের শরীর প্রতি সেকেন্ডে প্রতিনিয়ত ১০(৭)-১০(৮) পরিমাণ এটিপি তৈরি করে থাকে। এগুলো হলো, খাবার খাদ্য আমরা যা খেয়ে থাকি তার থেকে আসা আল্টিমেট শক্তি যার দ্বারা শারীরবৃত্তীয় সব কার্য সম্পন্ন করে থাকে।

অনুমান করা হয়, শরীরে প্রায় ১০০ গ্রাম এটিপি এবং প্রায় ১২০ গ্রাম ফসফোক্রিয়েটিন সঞ্চিত থাকে যার বেশির ভাগই পেশি কোষের মধ্যে থাকে।

অ্যাডেনোসাইন ট্রাইফসফেট (এটিপি) সেল্যুলার স্তরে ব্যবহার এবং সংরক্ষণের জন্য শক্তির উৎস। সুতরাং শরীরে শক্তি হিসেবে এটিপি অণুতে জমা থাকা কেমিক্যাল এনার্জি তাপশক্তিতে এবং আল্টিমেটলি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে আমাদের চলতে ফিরতে শক্তি জোগায়। শক্তি হিসেবে ব্যবহারের আগে এই এনার্জি ফসফেট বন্ড আকারে কেমিক্যাল এনার্জি হিসেবেই শরীরে জমা থাকে। এক মোল গ্লুকোজ বার্ন করে ৩৮ মোল এটিপি পাওয়া যায়। অবশ্য এই এটিপি তৈরির পরিমাণ ফ্যাটের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। একটি ২০ কার্বন শৃঙ্খলবিশিষ্ট ফ্যাটি এসিড বার্ন হলে এক হাজার ২০০ এটিপি তৈরি করে ফেলে। আর আট কার্বন বিশিষ্ট ফ্যাটি এসিড ভেঙে হয় ১০৮টি এটিপি অণু। এটিপির ২৭ শতাংশ খরচ হয় প্রোটিন তৈরিতে, ২৪ শতাংশ সোডিয়াম-পাসিয়াম পাম্পে, ৯ শতাংশ গ্লুকোনিওজেনেসিসে, ৬ শতাংশ ক্যালসিয়াম এটিপিএজে, ৫ শতাংশ মাংসপেশির মায়োসিনে এবং ৩ শতাংশ ইউরিয়াজেনেসিসে। রোজায় প্রতিদিন দীর্ঘ সময় উপবাসের কারণে উপরোক্ত জায়গাগুলোতে শক্তি সরবরাহের পাশাপাশি অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করতে জমা শক্তি ভেঙে অন্যান্য কাজ করার শক্তির চাহিদা পূরণ করে।

সাধারণ অবস্থায় শরীর মূলত গ্লুকোজ ভেঙে শক্তির জোগান দেয়। অতিরিক্ত শক্তি শরীরের বিভিন্ন অংশে ফ্যাট হিসেবে জমা হতে থাকে।

কার্বোহাইড্রেটের দু’টি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এটি এমন একটি খাবার যা রক্তে থাকাকালে ফ্যাট ব্যবহার হতে পারে না যার জন্য কার্বোহাইড্রেটকে ফ্যাট রক্ষক বলে। অপর বৈশিষ্ট্য হলো- এটি মূলত বার্ন হতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অক্সিজেন লাগলেও শরীরের চাহিদার প্রয়োজনে অক্সিজেন ছাড়াও এটিপি উৎপাদন করতে পারে। মানুষের বেঁচে থাকার এই ফুয়েল বা এনার্জি মূলত আসে তিনটি সোর্স থেকে, কার্বোহাইড্রেট উৎস থেকে আসা গ্লকোজ, ফ্যাটজাতীয় খাবার থেকে আসা ফ্যাটিএসিড এবং প্রোটিনজাতীয় খাবার থেকে আসা অ্যামাইনো এসিড। তবে প্রয়োজন না হলে প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে এনার্জি তৈরি করে না, কারণ প্রোটিনখাবার থেকে ১০০ কিলোক্যালরি এনার্জি পেতে ৩০ কিলোক্যালরি এমনিতেই খরচ হয়ে যায়। প্রোটিন জাতীয় খাবার মূলত মানুষের রোগ প্রতিরোধের জন্য কাজে লাগানো হয়।

শরীর প্রতিনিয়ত গ্লুকোজ থেকে তৎক্ষণাৎ শক্তি নেয় এবং গ্লুকোজকেই প্রাথমিক ফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করে। গ্লুকোজ রক্তে বা লিভারে থাকাবস্থায় শরীরের জমা ফ্যাট কখনো ব্যবহার হয় না। খাবার গ্রহণের আট ঘণ্টার মধ্যে ইনটেস্টাইন খাবারের পুষ্টি শোষণ করে তা রক্তে ছেড়ে দেয়। এরপরই আমাদের শরীর লিভার ও পেশিতে সঞ্চিত গ্লুকোজ ব্যবহার করতে থাকে। মানুষের শরীরে ফাস্টিংয়ে ব্যবহারের জন্য কিছু এনার্জি মজুদ থাকে আর এই মজুদ এনার্জি প্রধানত থাকে লিভারে ও মাসলে।

লিভারে তা লিভার গ্লুইকোজেন হিসেবে পরিচিত আর মাসলে তা মাসল গ্লাইকোজেন নামে পরিচিত। তবে লিভার গ্লাইকোজেন ব্যবহৃত হয় যত আগে, মাসল গ্লাইকোজেন তত পরে ব্যবহৃত হয়। তবে মানব শরীরের ফ্যাট হিসেবে জমা করে রাখার ক্ষমতা গ্লাইকোজেন হিসেবে জমা করার চাইতে ১৫০ গুণ বেশি। তেমনিভাবে প্রত্যেক গ্রাম জমা ফ্যাটে গ্লাইকোজেনের চেয়ে আড়াইগুণ বেশি এনার্জি জমা থাকে। অধিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট ভক্ষণ ফ্যাট ভাঙতে দেয় না এবং ফ্যাট জমা করে রাখাকে উৎসাহিত করে। উপরন্তু অতিরিক্ত গ্লুকোজ ফ্যাট হিসেবে জমা হতে থাকে। কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট পর্যাপ্ত থাকাবস্থায় প্রোটিন ভেঙে কখনো এনার্জি তৈরি হবে না। এ জন্যই কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটকে প্রোটিন রক্ষক বলে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অ্যামাইনো এসিডের ৬০ শতাংশ ভেঙে হলেও মানুষের শক্তির চাহিদা পূরণ করে।

শরীরে কোরি সাইকেলের আবির্ভাব-কায়িক পরিশ্রমী ও জিমন্যাস্টদের জন্য আশীর্বাদ :
মানব শরীরে আরো একটি বিশেষ ব্যবস্থা কার্যকর আছে যা সারাদিন খেটেখাওয়া মানুষ, অ্যাথলেটস ও লম্বা সময় ধরে রোজা থাকা মানুষদের কাজে লাগে। সেই ব্যবস্থাটি হলো বিপদের বন্ধু কোরি সাইকেলকে ব্যবহার করে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়া।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে লিভার গ্লাইকোজেনের পরিমাণ প্রায় ২০০ মিলিগ্রাম।
রক্তের গ্লুকোজ ফুরিয়ে গেলে লিভার গ্লাইকোজেন সরাসরি গ্লুকোজ হয়ে আমাদের রক্তে প্রবেশ করে এনার্জি প্রদান করে কিন্তু মাসল গ্লাইকোজেন সেটি পারে না। অনেক সময় ধরে কিংবা নিয়মিত ফাস্টিংয়ের কারণে মাসল গ্লাইকোজেন ভেঙে এর এন্ড প্রোডাক্ট যা ল্যাক্টেট নামে পরিচিত তা রক্তে চলে আসে। কোরি সাইকেলের মাধ্যমে লিভারে এসে গ্লুকোজে কনভার্ট হয়ে রক্তে যায় এবং আবার মাংসপেশিতে শক্তি জোগায়। শরীরের যখন অনেক বেশি তাৎক্ষণিক এনার্জি দরকার হয়, তখন মাসল গ্লাইকোজেন ভাঙতে থাকে। কিন্তু তা ভেঙে গ্লুকোজ না হয়ে ল্যাক্টেট পর্যন্ত হতে পারে কিন্তু তা ভাঙতে পারে না। কারণ মাসল গ্লাইকোজেন ভাঙার প্রয়োজনীয় এনজাইম ল্যাক্টেট ডিহাইড্রোজেজ মাসলে থাকে না, থাকে লিভারে। এ জন্য এই ল্যাক্টেট রক্তের মাধ্যমে লিভারে চলে আসে। পরবর্তীতে লিভারের হেপাটোসাইট কোষে থাকা ল্যাক্টেট ডিহাইড্রোজেনেজ এনজাইম দিয়ে ল্যাক্টেট ভেঙে পাইরোভেট ও পরে গ্লুকোজে রূপান্তর হয়ে আবার রক্তের মাধ্যমে মাংসপেশিতে চলে আসে এবং বিকল্প শক্তির জোগান দেয়। এটিই হলো কোরি সাইকেল। এ ঘটনা বেশি বেশি রোজা থাকলে ঘটে থাকে।

লিভারে ল্যাকটেটকে প্রথমে পাইরোভেট ও তার পর গ্লুকোজে রূপান্তর করে রক্তে গ্লুকোজ নিঃসরণ করে। এই গ্লুকোজ পেরিফেরাল টিস্যুর (পেশি, লোহিত রক্তকণিকার) শক্তি জোগায়। এভাবে মাসলে থাকা গ্লুকোজকে গ্লাইকোলাইসিসের মাধ্যমে প্রথমে পাইরোভেট, পরে ল্যাকটেটে রূপান্তর, রক্তে ল্যাকটেট প্রবেশ, রক্তের ল্যাকটেটকে লিভার কর্তৃক গ্রহণ করে আবার পাইরোভেট-গ্লুকোজে রূপান্তর করে রক্তে ছেড়ে দেয়ার সাইকেলকেই বিজ্ঞানী কোরির নামানুসারে কোরি সাইকেল বলা হয়। দীর্ঘ সময় কায়িক পরিশ্রম করে রোজা থাকলে মাংসপেশির তাৎক্ষণিক শক্তির দরকার হলে কোরি সাইকেল সক্রিয় হয়ে পড়ে। কোরি সাইকেল বেশি সক্রিয় থাকে যারা খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রম (শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ) এবং শরীর চর্চায় নিয়োজিত থাকে। এই বিকল্প ব্যবস্থা থাকার কারণে চাইলে রিকশাচালক, সাইকেলচালক, মিল-কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ও রেগুলার জিমনেশিয়ামে গমনকারীরাও রোজা থাকতে পারেন।

তবে কোরি সাইকেল চালাতে সাজনার চেয়ে যেন বাজনা বেশি। এক ল্যাকটেট অণু ভেঙে আমরা পাই মাত্র দু’টি এটিপি, আর এই দুই এটিপি পেতে লিভারকে খরচ করতে হয় ছয় এটিপি। তবুও মাংসপেশির শক্তির জোগান দিতে এই সাইকেলের সক্রিয়তার বিকল্প নেই। এ জন্যই যারা সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত ও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছেন তাদের জন্য কোরি সাইকেল কুলিয়ে উঠতে পারে না। সে ক্ষেত্রে রোজা রাখা যাবে না।
[বাকি অংশ আগামীকাল]

লেখক : প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, সিজেডএম কিডনি ডায়ালাইসিস অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার, শ্যামল বাংলা রিসোর্ট, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement