১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়

-

আজ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, গ্রন্থাগার অধিদফতর, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি, বেলিড-সহ বিভিন্ন গ্রন্থাগার সংস্থা, গ্রন্থাগার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালগুলোর গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিনটি পালন করছে। বিজ্ঞ বিশিষ্টজনরা দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন।

দেশের সব স্তরের মানুষকে বিশেষ করে ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদেরকে অধিকতর গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা, জাতিগঠনে গ্রন্থাগারের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা, দেশে বিদ্যমান গ্রন্থাগারগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ওপর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ও সাময়িকীর তথ্যাদি প্রদান, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা ও মতবিনিময়, মননশীল সমাজ গঠনে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা, পাঠসামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিতরণ ও পাঠক তৈরির মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এবং গ্রন্থাগারকর্মী ও পেশাজীবী, লেখক, প্রকাশক, পাঠক বিশেষ করে বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় ৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি উদযাপন করে থাকে।

প্রতি বছর দিবসটির একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। এবারকার (২০২৩) প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘স্মার্ট গ্রন্থাগার স্মার্ট বাংলাদেশ’। এই স্লোগানটি বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের আলোকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

গত ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চারটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি।

সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে। তার ভাষায়, স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থ হচ্ছে- দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা’ সব কিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে।

ই-এডুকেশন, ই-হেলথসহ সব কিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা তা করতে সক্ষম হবো এবং সেটি মাথায় রেখেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

এখানে উল্লেখ্য, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রদত্ত শেখ হাসিনার শর্ত চতুষ্টয় বিশ্বখ্যাত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনকে সামনে রেখেই প্রণীত বলে প্রতীয়মান হয়। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত যে স্মার্ট এডুকেশন এবং স্মার্ট লাইব্রেরি সে কথা বলাই বাহুল্য।

সংশ্লিষ্ট সবাই বিশ্বাস করেন, এই দিবস পালনের মাধ্যমে সব স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক সবাই বই পড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবনমানের উন্নতি ঘটাবেন। বলা দরকার, গ্রন্থাগার ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার এই কাজ আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা অনুযায়ী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের এজেন্ডা মাথায় রেখে অগ্রসর হই তাহলে স্মার্ট গ্রন্থাগার স্থাপনের আর কোনো বিকল্প নেই।

সরকারিভাবে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণার ফলে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার শিক্ষা বিভাগ, বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত গ্রন্থাগারসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি কার্যকর ও ফলপ্রসূ সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরূপ সমন্বয়ের ফলে দেশের গ্রন্থাগারগুলোর ব্যবহার, গ্রন্থাগার ও তথ্যসেবার মান এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।


দিবসটি ঘিরে সারা দেশের সব গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারবিষয়ক সংগঠন নানামুখী কর্মকাণ্ডে মুখর থাকে। তাতে সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গ্রন্থাগার বিষয়ে আগ্রহ ও সচেতনটা সৃষ্টি হয়েছে এবং পাঠকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার প্রতিদিনকার নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় ‘লাইব্রেরি আওয়ার’ চালু করেছে। বিষয়ভিত্তিক ক্লাসের মতো প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীরা পালাক্রমে গ্রন্থাগারে গিয়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা পড়াশোনা করবে। ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণার ফলে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে গ্রন্থাগার সংক্রান্ত কার্যাদি অধিকতর বেগবান হচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করেন।

একটি জাতির মেধা ও মনন, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারক ও লালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে জন্য বলা হয় গ্রন্থাগার হলো সমাজ উন্নয়নের বাহন। আমাদের দেশের সরকারপ্রধানরাও গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিভিন্ন সময় গ্রন্থাগারমুখী ব্যাপক উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ঐতিহাসিকভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে উড্ডীন হওয়ার পর বিভিন্ন সরকার কর্তৃক দেশের গ্রন্থাগার উন্নয়নের লক্ষ্যে দৃশ্যমান একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণের উদাহরণ বিদ্যমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেরেবাংলা নগরে ‘বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার’। ঢাকা শাহবাগ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠাও তারই পরিকল্পনার অংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার স্থাপন ও গ্রন্থাগারে সহকারী গ্রন্থাগারিকের একটি করে পদ সৃষ্টি করেন। এ ছাড়া প্রতিটি জেলায় গণগ্রন্থাগার রয়েছে এবং উপজেলায় গ্রন্থাগার স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদ গ্রন্থাগার পরিচালিত হচ্ছে।

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ ষষ্ঠ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেশের সব পর্যায়ের গ্রন্থাগার এবং শিক্ষার মান পর্যালোচনার সময় এসেছে। আমরা জানি, যে জাতির গ্রন্থাগার যত সম্মৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। আমরা এও জানি, বর্তমান যুগে কোনো জাতির উন্নয়নের ব্যারোমিটার বা পরিমাপক যন্ত্র হচ্ছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের পরিমাণ অর্থাৎ যে জাতি যত বেশি পরিমাণে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশি উন্নত। গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের বর্তমান মানদণ্ড হচ্ছে বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক, বৈশ্বিক অর্থনীতিসূচক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক র‌্যাংকিং।

বিগত ১২-১৩ বছরে দারিদ্র্যদূরীকরণ, উৎপাদনশীলতা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাত, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয়েছে। ফলত ২০১৫ সালে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায়, প্রয়োজনীয় সব চলকে [গ্রস ন্যাশনাল ইনডেক্স (জিএনআই), হিউম্যান অ্যাসেটস ইনডেক্স (এইচএআই) এবং ইকোনমিক ভালনারেবিলিটি ইন্ডেক্স (ইভিয়াই)] ঈপ্সিত ফলাফল অব্যাহত রাখতে পারলে ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে স্বীকৃত হবে। এটি বাংলাদেশীদের জন্য সত্যিকারের গর্বের বিষয় বটে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতেই নয়; বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, উল্লিখিত সময়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদরাসা, কারিগরি এবং উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলদেশকে ঈপ্সিত স্থানে পৌঁছাতে গ্রন্থাগার ব্যবহার ও শিক্ষার মানের আরো উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

চলতি বছরের বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের) তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন (এমবিআরএফ)। এ তালিকায় বিশ্বের ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম।

প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণে ও জ্ঞান অর্থনীতির সূচকে ভালো পারফরম্যান্স করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে ধারাবাহিকভাবে খারাপ করে চলেছে। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ। আর টানা চতুর্থবারের মতো এই তালিকায় শীর্ষে আছে সুইজারল্যান্ড।

২০২১ সালের জ্ঞানসূচক তৈরিতে সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো- প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ। উচ্চশিক্ষায় প্রতি বছর বিভিন্ন সংস্থা যে বৈশ্বিক র‌্যাংকিং করে তাতে প্রথম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই।

এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, গ্রন্থাগার ব্যবস্থা-এসব কিছুতেই সংস্কার আনা প্রয়োজন। অন্যসব আলোচনার আগে আজ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে গ্রন্থাগার উন্নয়নের বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। তার আগে আমাদের গ্রন্থাগারগুলোর বিদ্যমান চিত্র কিছুটা সামনে আনা যায়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারের অবস্থা সবচেয়ে ভালো।

লেখক : উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
amatin.aub@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement