২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শিক্ষা বাণিজ্য

- ফাইল ছবি

শিক্ষাবাণিজ্য ঠেকাতে দেশজুড়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা, পরামর্শ, পরিকল্পনা কিন্তু ফলাফল সরল অঙ্কের ফলাফলের মতো। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্কটগুলো কী কী? সমাধানের উপায় কী?


প্রশ্নফাঁস শিক্ষার মৌলিক সঙ্কট নয়, উপজাত মাত্র। প্রশ্নফাঁস জ্বলন্ত আগুনের মতো দৃশ্যমান বিধায় দ্রুত নির্বাপণযোগ্য। কিন্তু শিক্ষার মৌলিক সঙ্কটগুলো তুষের আগুনের মতো অদৃশ্যমান, নেভানোর তাড়া অনুভূত হয় না সহজে, শুধু ভুক্তভোগীর হৃদয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। চিৎকার করে বলা হয় না- শ্রেণিকক্ষগুলো অনুর্বর, অকার্যকর কেন? প্রাইভেট টিউশনি অবধারিত কেন? শিক্ষাঙ্গনে মূল্যবোধহীন শিক্ষকের আধিক্য কেন? শিক্ষা সমতা বিঘ্নিত কেন?

শ্রেণিকক্ষের উর্বরতা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় মহিমান্বিত। মহিমান্বিত শ্রেণিকক্ষগুলো অনুর্বর, অকার্যকর হলো কিভাবে?

শিক্ষকতা এক মহান ব্রত, আক্ষরিক আর্থে কোনো পেশা নয়। শিক্ষা বাণিজ্যের হাতছানি জীবনের সঙ্গে মহান ব্রতের সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করে শিক্ষক মনকে করে প্রলুব্ধ। ফলপ্রসূ পাঠদানের জন্য যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন, লুব্ধ মন সে প্রচেষ্টাকে ধাওয়া করে শ্রেণিকক্ষের বাইরে লাভজনক আড়তে। বাড়তি আয়, বাড়তি প্রত্যাশা, বাড়তি ব্যস্ততা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছড়ে পড়ে শ্রেণিকক্ষগুলোতে। শ্রেণিকক্ষগুলো পরিণত হয় মহিমাশূন্য অকার্যকর খোঁয়াড়ে। পর্ণ কুটিরের সম্ভাবনাময় মেধাগুলো তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। আমার প্রলুব্ধ মন, আমার বিদ্যাবিপণন স্বপ্ন বুনতে দেয় না দুঃখিনী মাকে। সামর্থ্যহীনরা বাধ্য হয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার মাঠ ছাড়তে। তবু আমি শিক্ষক, মহান শিক্ষক!

প্রাইভেট-টিউশনির সাতকাহন শিক্ষার্থীর ভাগ্যলিপিতে ঠাঁই পেয়েছে। শ্রেণিকক্ষের উর্বরতা বিনষ্ট না হলে প্রাইভেট-টিউশনি অবধারিত হয় না। প্রাইভেটের সাতকাহন সৃষ্টিতে আমার প্রলুব্ধমন একা দায়ী নয়। শিক্ষার পরিবেশ, প্রতিবেশ সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের অপ্রতুল ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তি ও সমাজের অসুস্থ চাহিদা দীর্ঘ পরিক্রমায় আমার স্খলনে রেখেছে সহযোগী ভূমিকা। বৃহৎ শ্রেণিকক্ষ, অর্থ নৈতিক দৈন্য আমাদের স্খলনকে করেছে ত্বরান্বিত।

প্রাইভেট-টিউশনি নতুন কোনো অনুষঙ্গ নয়, সুদূর অতীতেও এটি ছিল। সেকালে প্রাইভেট টিউশনিকে অবধারিত ভাবতে কেউ বাধ্য হয়নি, প্রাইভেটের বাজার সৃষ্টির জন্য কূটকৌশলের বিচিত্র গল্প শোনা যায়নি, প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি শিক্ষকের মূল্যবোধ।

সেকাল আর একালের ব্যবধান অনেক, তখন ছিল সামন্ত যুগ, শিক্ষার অধিকার ছিল না সাধারণের। বলা হতো- Education is not for the poor গরিবের ঘোড়া রোগ বলেও তিরস্কার করা হতো সামর্থ্যহীন শিক্ষার্থীকে। সামন্ত যুগের অবসান হয়েছে, তিরস্কারের ভাষা ভর করেছে শিক্ষাবাণিজ্যের পরতে পরতে। ভর্তি ফি, টিউশন ফি, পরীক্ষা ফি, কোচিং ফি আবার প্রাইভেট-টিউশনি সামর্থ্যহীন শিক্ষার্থীর কাছে এগুলো নব্য তিরস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়। সমতাহীন শিক্ষার যুগে যা ছিল বৈধ, শিক্ষা সমতার যুগে সে সব অনুষঙ্গ বৈধতা পায় কি করে? সামন্ত চেতনার কাছে বিবেক বন্ধক না থাকলে প্রজাতন্ত্রের বাসিন্দারা শিক্ষাবাণিজ্যের যেকোনো প্রয়াসকে অবৈধ বলবে অবলীলায়। শিক্ষা সমতা বৈষম্যহীন চেতনাপুষ্ট, মেধা লালনে সমান সুযোগ সুবিধা। শুধু পাঠদান নয়, পাঠ প্রস্তুতকরণে রাষ্ট্রযন্ত্রের শতভাগ দায়বদ্ধতা। কারণ, জীবনযুদ্ধে আকণ্ঠ নিমজ্জিত অভিভাবক মহল পাঠ প্রস্তুতকরণের দায় প্রতিপালনে হয় অক্ষম, নয়তো অসহায়। এই অক্ষমতা, এই অসহায়ত্বকে সম্বল করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যিক অনাচার, বিনষ্ট হয়েছে শিক্ষা সমতা। শিক্ষা সমতা ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক যেকোনো প্রতিযোগিতা সামর্থ্যহীনদের প্রতি রাষ্ট্রীয় উপহাস। রাষ্ট্র যদি গণপ্রজাতন্ত্র নামে প্রকাশিত হতে চায় তাহলে শিক্ষা সমতা নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে। শিক্ষা সমতা নিশ্চিত করতে হলে- ‘লাভজনক’ মাদকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। পাশাপাশি পাঠদানের সাথে পাঠ প্রস্তুতকরণের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। দায় এড়িয়ে রাষ্ট্র চিরকাল গণপ্রজাতন্ত্রের মর্যাদা দাবি করতে পারে না।

লাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেণিবৈষম্যের সুতিকাগার, শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির হাতিয়ার। জাতির প্রত্যাশা পূরণে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো দায়বদ্ধতা নেই। স্বর্ণকার সম্পর্কে কথিত গল্পের চেয়েও লজ্জাজনক এদের প্রকৃতি। এদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা প্রজন্ম লোলুপ প্রকৃতি ধারণ করতে বাধ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের ফটকে সেবার জন্য বেরিয়ে যাও- উপদেশ প্রবঞ্চনার নামান্তর। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গণপ্রজাতন্ত্রের ভূমি, অবকাঠামো ও বেতনভুক কর্মকর্তা-পরিচালিত। গণপ্রজাতন্ত্রের মদদপুষ্ট কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাভজনক হতে পারে না, শ্রেণিস্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে না, এখানে অর্থনৈতিক কারণে কেউ অযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে পারে, কারণ এ দেশ গণপ্রজাতান্ত্রিক প্রকৃতি ধারণ করার যথেষ্ট সময় পায়নি, অতিক্রান্ত সময় মাত্র অর্ধ শতাব্দী।

উচ্চমূল্যে লালিত মেধা ধারণ করে বেনিয়া প্রকৃতি, সেবা বিপণনে বর্গীদেরও হার মানায়। সেবাক্রয়ে অক্ষম গণমানুষের সাথে দূরতম সম্পর্ক নেই এ বেনিয়া গোষ্ঠীর। তবু তাদের মেধা লালনে প্রজাতন্ত্র অকৃপণ। প্রশ্ন জাগে, প্রজাতন্ত্র কি শ্রেণিস্বার্থে নিবেদিত?

পাঠদানের বাণিজ্যিক আড়ৎগুলো ফলাফলের চমকনির্ভর। ফিডের খাদক ব্রয়লারের মতো মেধাকে পুঁথি খাদক বানাতে পারে, স্মৃতিশক্তির দাপটে তীক্ষ্ম করতে পারে, কিন্তু পরিপুষ্ট করতে পারে না। পরিপুষ্ট মেধা কি? যে মেধা চিত্তের দৈন্যকে প্রশমিত করে, আত্মপ্রতিষ্ঠাকে স্বার্থ প্রতিষ্ঠার ছোবলমুক্ত রাখে, প্রলুব্ধ মনকে শাসিয়ে সভ্যতাকে করে অর্থপূর্ণ, জীবনকে যন্ত্র সভ্যতার স্রোতে ভাসিয়ে দেয় না, সেটিই পরিপুষ্ট মেধা। তীক্ষ্ম মেধা নিয়ে বড়াই করুক যন্ত্রসভ্যতা; জীবনের স্বার্থে, অর্থপূর্ণ সভ্যতার স্বার্থে চাই পরিপুষ্ট মেধা। পরিপুষ্ট মেধা লালনে উর্বর শ্রেণিকক্ষ বিকল্পহীন।

নিয়োগবাণিজ্যের কল্যাণে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অশিক্ষকের অনুপ্রবেশ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদার জাতীয়করণ অশিক্ষকের আধিক্য সৃষ্টির অনুকূল পন্থা। নিয়োগবাণিজ্যের ছিপি খোলা রেখে মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক তালাশ করা হাস্যকর। শিক্ষকনিয়োগে তাদের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা চরমভাবে উপেক্ষিত। সময় নিশ্চয়ই আসবে যেদিন উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে- ফিরিয়ে দাও উর্বর শ্রেণিকক্ষ। মহান শিক্ষক বৈষম্য বঞ্চনার মূলোৎপাটনের অঙ্গীকারে যে জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধে রক্তগঙ্গা বইয়েছে, সে জাতির মেধা লালনে বৈষম্য বঞ্চনা সৃষ্টিকারী অনুষঙ্গগুলো কোনোভাবেই বৈধ হতে পারে না। ঔপনিবেশিক ও সামন্ত চেতনার নিগড়ে আবদ্ধ বিবেক, বোধ-বিশ্বাস জাতি রাষ্ট্রের চেতনায় সিক্ত হয়নি। পাঠ প্রস্তুতকরণের দায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই বিকলাঙ্গ বিবেকের, তাই স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেও জাতির মেধা লালনে বৈষম্যহীন, টেকসই কোনো শিক্ষানীতি প্রণীত হয়নি। একটি স্বাধীন জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় উপকরণের নাম মেধাশক্তি। কিন্তু বৈষম্যহীন, টেকসই শিক্ষানীতির অভাবে সামর্থ্যহীনদের মেধা লালন সান্ত¡না চিকিৎসার মতোই সম্ভাবনাহীন মাত্রায় অবস্থান নিয়েছে বিধায় প্রজাতন্ত্রের সম্মানজনক পদ ও পদবিগুলোর স্থায়ী বন্দোবস্ত পেয়েছে সামর্থ্যবানরা। মানবিক বোধ যখন বিপন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাকুল, এ জাতি তখনো সুবিধাবঞ্চিতদের মেধা লালনে উদাসীন। শিশুশ্রম ও মেধা ঝরার অন্তরালে যে হাহাকার, গোটা জাতি তার নিষ্ক্রিয় দর্শক।

অপরাধের ধারণা (Sense of guilt) ঘটনার পরিণতিনির্ভর। ঘটনার পরিণতি সবার জন্য হিতকর না হলে বঞ্চনার শিকড় শক্ত হবেই। কোনো বিষয়ে প্রাইভেট সুবিধা মানেই, সামর্থ্যবানদের স্বার্থরক্ষা। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাইভেট সুবিধা সৃষ্টি করছে শ্রেণিবৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা। কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ যখন মেধা লালনের পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায়, সামর্থ্যহীনরা তখন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার মাঠ ছাড়তে সময় পায় না, বিঘ্নিত হয় শিক্ষা সমতা। এ বৈষম্য-বঞ্চনার দায় অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের কিন্তু আমার প্রলুব্ধমন বিবেকের রিমান্ড এড়াবে কী করে?

‘নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানো যাবে না’ এমন বিধি-নিষেধ শিক্ষাবাণিজ্যের টনিক-বিবর্জিত নয়। শিক্ষাবাণিজ্যের অনাচার বন্ধ করতে হলে পাঠদানের বাণিজ্যিক বিকল্প ও লাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে পাঠ প্রস্তুতকরণের দায় গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে এবং কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রকে। পাশাপাশি শিক্ষকের প্রলুব্ধ মনকে ফেরাতে হবে মহিমান্বিত শ্রেণিকক্ষে। বেতন বৃদ্ধি নয়, পাঠ প্রস্তুতকরণের বিনিময়ে বাড়তি আয় সংযোগ করে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদার Incentive ব্যবহার করে এ দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত করা যেতে পারে জাতিকে। প্রলুব্ধ মনকে বশে আনতে শ্রেণিকক্ষগুলোকে সিসি ক্যামেরাবন্দী রাখা শ্রেয়। পর্ণকুটিরে মেধার ঝিলিক অবলোকন করতে চাইলে নতুন কোনো ‘৭১-এর প্রয়োজন নেই’; প্রয়োজন শুধু একটি ইচ্ছার, একটি শক্ত সাধারণ ইচ্ছার (Strong general will)। ‘সুদখোর’ দু’টি শব্দ, কুৎসা প্রকাশের মহাকাব্য, ‘বিদ্যা বিপণন’- দু’টি শব্দ, ঘৃণা প্রকাশের মহাকাব্য- এই হোক সময়ের প্রতিপাদ্য।

বৈষম্যহীন শিক্ষানীতির অভাবে, পাঠদানে বাণিজ্যিক বিকল্পের জালে আটকা পড়েছে সামর্থ্যহীনদের মেধা লালন। অন্য দিকে আমার প্রলুব্ধ মন, আমার বিদ্যা বিপণন সামর্থ্যবানদের মেধা লালনে জুগিয়েছে যান্ত্রিক গতি; তাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর দোল খাচ্ছে উৎকট উন্নয়ন তরঙ্গে; এর পরও সংক্ষুব্ধ নয় কোন নির্বোধ?

ওদের ঘরে মেধার বসত
আমার ঘরে মেধা কই?
আমার ঘরে কিস্তির জ্বালা
বঞ্চনা অ-থৈ।


আরো সংবাদ



premium cement