২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে চিকিৎসাসেবা পাওয়া প্রত্যেকটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সংবিধান স্বীকৃত এ অধিকার সবার ভাগ্যে জুটছে না। বিশেষ করে যারা গ্রামে বসবাস করেন তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সবার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশের উন্নয়নে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সত্যিকার অর্থে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হলে সারা দেশে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জনশুমারির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে শহরে পাঁচ কোটি ৯ হাজার ৭২ জন ও গ্রামে বাস করেন ১১ কোটি ৬৩ হাজার ৫৯৭ জন। বেশি মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। গ্রামের রাস্তা-ঘাট ও স্কুল-কলেজের উন্নয়ন হয়নি তা নয়। কিন্তু চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন তেমন চোখে পড়ে না। শুধু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না। যাদের জন্য উন্নয়ন তারাই যদি সুস্থ না থাকে তাহলে এ উন্নয়নের উপকারভোগী হবে কে? উন্নয়নের অন্যান্য সূচকও সমানতালে হতে হবে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ! করোনাকালে চিকিৎসা ব্যবস্থার করুণ চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তার পরও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়নি।

দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন সময়ের দাবি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার চাপ কমানোর স্বার্থে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে তকমা পেয়েছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত বাতাসের শহর। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার এ তালিকা প্রকাশ করেছে। জাতিসঙ্ঘের ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসের শ্বাস নেন এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।

বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও শারীরিক, মানসিক ক্ষতি হয়। এমনকি হাসপাতালে রোগী আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ হলে বিভাগীয় ও জেলা শহরে সব প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে, তখন আর চিকিৎসার জন্য কাউকে ঢাকায় পাড়ি দিতে হবে না। এখন বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা না পাওয়া একজন রোগী বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসেন। কিন্তু ঢাকায় আসা-যাওয়া কত যে ভোগান্তির তা ভুক্তভোগী রোগী ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না। অনেকেরই ঢাকায় আত্মীয়স্বজন নেই, তারা বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বারান্দায় থাকার চেষ্টা করেন। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের কথা আলাদা, তারা হোটেলেও থাকতে পারেন। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই তারা বাধ্য হয়ে হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে কখনো বসে, কখনো শুয়ে রাত্রি যাপন করেন।

শ্যামলীর শিশু হাসপাতালের সামনে রাতে দেখা যায়- শত শত শিশুর বাবা-মা রাস্তার ফুটপাথে কনকনে শীতের মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হলে এত কষ্টে তাদের ভুগতে হতো না। এটি তাদের ওপর একটি বাড়তি চাপ।

গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সরকার সারা দেশে প্রায় ১৩ হাজার ৭০৭টি কমিউনিটি কিনিক চালু করেছে। কিন্তু এসব ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবায় কতটুকু ভূমিকা রাখছে খতিয়ে দেখা উচিত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করা না গেলে জনসম্পদের উন্নয়ন হবে না। দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ ও চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার। বর্তমানে সারা দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৬৯টি। এতগুলো মেডিক্যাল কলেজ থাকার পরও মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ- বেশির ভাগ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইমার্জেন্সি, আউটডোর, অপারেশন থিয়েটার, ওয়ার্ড থাকলেও চাহিদা অনুসারে চিকিৎসক নেই। সরকার উদ্যোগ নিলে ওইসব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিউ থেকে শুরু করে সব ধরনের চিকিৎসা, টেস্টের ব্যবস্থা ও সান্ধ্যকালীন চিকিৎসক চেম্বার করার ব্যবস্থা করতে পারে। সেখানে যেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী নামমাত্র ফি দিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। বিশেষ করে কিডনি, কিডনি ডায়ালাইসিস, করোনা, ডেঙ্গু, হার্ট অ্যাটাক, যক্ষ্মা, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, ডায়াবেটিস, জন্ডিস, প্যারালাইসিস, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, টিউমার, ডায়রিয়া, অর্থোপেডিক, স্ট্রোক, নবজাতকের চিকিৎসা, গাইনি চিকিৎসার ব্যবস্থা বিভাগীয় অথবা জেলা পর্যায়ে করা গেলে ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে।
প্রায়ই দেখা যায়, হাসপাতাল আছে কিন্তু চিকিৎসক নেই। ফলে লাখো মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠলেও মানুষ কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না। রোগীদের সরকারি হাসপাতালমুখী করার স্বার্থে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে আরো উন্নত করা দরকার। চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সঙ্কট দূর করা দরকার। চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার। অনেক চিকিৎসক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে চান না। চাকরি রক্ষায় তারা পোস্টিং নিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরে অবস্থান করেন। অনেকে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করেন।

প্রতিটি হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কিছু বিধান আছে। কিন্তু বেশির ভাগ হাসপাতালে এ বিধান প্রতিপালন করা হয় না। গ্রামেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় মানুষ বেসরকারি হাসপাতালমুখী হচ্ছে। এ প্রবণতা রোধে সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement