২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মোহন মিয়া এক মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ

মোহন মিয়া এক মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ। - ছবি : নয়া দিগন্ত

ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশিষ্ট নাম। এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তি। এক বিরাট মাপের মানুষ। যে যুগে মোহন মিয়া তার কর্মমুখর জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন সে যুগ ছিল সাফল্যে পরিপূর্ণ। এ যুগেই ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি কোনা ক্ষেত্রেই শূন্যতা ছিল না। অভাব ছিল না সুযোগ্য নেতৃত্বের।

সে দিনের রাজনৈতিক অঙ্গনে মোহন মিয়া ছিলেন এক সুযোগ্য এবং বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আমার কর্মজীবনে এই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসে তাকে জানার কিছুটা সুযোগ হয়েছিল। তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন এই বাংলার মাটি ও মানুষকে। তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল মানবতাবাদ। বর্তমান এই পুঁজিবাদ প্রভাবিত বিশ্বে চূড়ান্ত মানবতাবাদের স্তরে হয়তো কোনো দিনই আমরা পৌঁছতে পারব না। মোহন মিয়া পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ কোনোটিতেই বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন এক লোকাশ্রিত গণতন্ত্রে।

১৯৪৫-১৯৪৭ সালে আমি তখন ফরিদপুরে স্কুলছাত্র ছিলাম। তখন তাকে একবার দেখেছিলাম। বিরাট মিছিলের পুরো ভাগে মাল্যভূষিত একটি সৌম্য শান্ত মানুষ অম্বিকা ময়দানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম ইনিই ফরিদপুরের জনপ্রিয় নেতা মোহন মিয়া। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বার ঢেউ দিল্লি থেকে তখন সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফরিদপুরের সেই গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইউসুফ আলী মোহন মিয়া। ’৫২ সালের রক্তাক্ত বাংলার মাটিতেই রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। ভাষা আন্দোলনের দিনটিতে মোহন মিয়া ফরিদপুরে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। মুসলিম লীগে থাকলেও তিনি ভাষা আন্দোলনে নুরুল আমিনের কার্যক্রমকে সমর্থন করেননি। ওই সময় মোহন মিয়া একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন।

১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলন করে নেতাজি সুভাস গেট, গান্ধী গেট করে বিতর্কিত হলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হন। এই সময়ই তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ এবং সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আধিপত্য এবং প্রতিপত্তি অনেকটাই বজায় ছিল। আইয়ুবের সামরিক শাসন আমলে দীর্ঘ কয়েক বছর রাজনৈতিক কার্যক্রম একেবারেই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বা পৃথকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ৬০-এর দশক থেকেই ধীরে ধীরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ বাড়তে থাকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরশাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি গণ-আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯৬২ সালের জুন মাসে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে একটি যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব বিরোধী দলের নেতারা এক আলোচনা সভায় মিলিত হন এবং একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করেন। এই বিবৃতি নয় নেতার বিবৃতি নামে পরিচিত। ৯ নেতার মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মুসলিম লীগ নূরুল আমিন, ন্যাপ থেকে মাহমুদ আলী, নেজামী ইসলাম থেকে পীর মোহসিন উদ্দিন এবং কৃষক পার্টি থেকে হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) ও ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া।

মোহন মিয়াদের এই বিবৃতি গণসমর্থন লাভ করেছিল। জনগণের মধ্যে একটা আশার আলো সঞ্চারিত হয় এবং একটা আলোড়ন তোলে। এতে আইয়ুব খান ভীত হলেন। তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের ৩০ জুন জাতীয় পরিষদে একটি বিল আনেন। এই বিলের সংক্ষেপ নাম এবডো। এই আইনে যেকোনো রাজনৈতিক নেতাকে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে এবং তিনি কোনো দল গঠন করতে পারবেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি দলহীন ঐক্য সংস্থা গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সব বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করেন।

এই জোটের ঘোষণাপত্রে আইয়ুবের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া হয় এবং গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার সঙ্কল্প ব্যক্ত করা হয়। এই জোটে ৫৪ জন নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দীসহ ৯ নেতার সবাই ছিলেন যেমন- ইউসুফ আলী চৌধুরী, মোহন মিয়া, নুরুল আমিন, আজিজুল হক, আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।

আইয়ুবের উদ্ভট চিন্তার ফসল হচ্ছে তার দেয়া মৌলিক গণতন্ত্র। ১৯৬২ সালের আইয়ুব খান নতুন মেম্বারদের জন্য নির্বাচন দিলেন। অর্থাৎ জনগণ ভোট দিয়ে মেম্বার নির্বাচন করবেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে নির্বাচন হবে। অর্থাৎ জনগণ সরাসরি ভোট দিতে পরবেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে মৌলিক গণতন্ত্রী অর্থাৎ মেম্বারদের ভোটে। যদিও এ নির্বাচন ছিল একটি প্রহসনের নির্বাচন।

মোহন মিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কর্মবহুল দিন ছিল ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে আইয়ুববিরোধী প্রচারণার দিনগুলো। মোহন মিয়ার জনপ্রিয়তা ছিল সবার শীর্ষে, সাধারণ মানুষকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন অত্যন্ত আপনজনের মতো। সাধারণ মানুষও তাকে দেখতেন আপনজন, প্রিয়জনের মতো। তাই তারা তার কাছে তাদের যেকোনো সুখ-দুঃখের কথা, সমস্যার কথা বলতে দ্বিধা করতেন না।
শেষ পর্যন্ত সেই কাক্সিক্ষত নির্বাচনের দিনটি এলো ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি। ফরিদপুরের ভোটারের অনুকূল সাড়া দেখে আমরা ভেবেছিলাম নির্বাচনে জয়লাভ করব। কিন্তু আমাদের ধারণা ভ্রান্ত ছিল। কারণ ফরিদপুরের অনুকূল সাড়ার পেছনে ছিল মোহন মিয়ার অবদান। সারা দেশের চেহারাটি ছিল ভিন্নরূপ।
আইয়ুব খানের সামনে সব পথ তখন অবরুদ্ধ। উপায়ন্তর না দেখে তিনি দ্রুত ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন। আইয়ুব খানের বিদায় ভাষণটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। কোনো স্বৈরশাসকের নিজের ভুল স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার নজির খুব বিরল। তবে আইয়ুব খানের দূরদৃষ্টি ছিল পাকিস্তানের দুই অংশ যে, এক দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এটি বোধ হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

ইউসুফ আলী চৌধুরী, মোহন মিয়া স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চিরকালই সোচ্চার ছিলেন। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক। এ দেশের গণমানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মানুষের কল্যাণের জন্যই তিনি রাজনীতি করেছেন, নিজের ভাগ্য গড়তে নয়। মোহন মিয়াও নীরবে চিরবিদায় নিয়েছেন। আমরা ভুলে যাই আমাদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, অতীতের মনীষী ও মহিয়ানদের কথা।

মোহন মিয়া এক কালজয়ী নেতা, মহান ব্যক্তিত্ব, তাকে ভোলা যায় না। তার কাছে দেশবাসী তথা ফরিদপুরের জনগণের ঋণ সীমাহীন। মোহন মিয়া মানেই এক আপসহীন সংগ্রামী নেতা। মোহন মিয়া মানেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক সিংহপুরুষ। মোহন মিয়া মানেই সততা, ন্যায়, নিষ্ঠা ও ত্যাগের এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি। মোহন মিয়া মানেই মানবপ্রেমিক দরদি মরমি একক মানুষ। যিনি ভালোবেসেছিলেন তার দেশকে এবং দেশের মানুষকে।

স্বদেশের কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তার স্মৃতির প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও বিনম্র প্রণাম।


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাবির কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে প্রথম হয়েছেন যারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের নিজ দেশে ৫ বছর পর ফিরল দিপক চট্টগ্রামে ৬ কিশোর গ্যাংয়ের ৩৩ সদস্য আটক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন মজবুত করতে হবে : শামসুল ইসলাম ইউরো ২০২৪’কে সামনে রেখে দল নির্বাচনে বিপাকে সাউথগেট ভারতীয় পণ্য বর্জনকে যে কারণে ন্যায়সঙ্গত বললেন রিজভী মাকে ভরণ-পোষণ না দেয়ায় শিক্ষক ছেলে গ্রেফতার প্রথম বাংলাদেশী আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিরাপত্তা-বিষয়ক আলোচনা করতে উত্তর কোরিয়ায় রুশ গোয়েন্দা প্রধান

সকল