১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য স্বার্থ তুরস্ককে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কাছাকাছি আনছে

- ছবি : নয়া দিগন্ত

গত কয়েক মাসে তুরস্ক (তুর্কিয়ে) এবং দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বেশ কিছু উন্নয়ন ঘটেছে যা অন্বেষণের যোগ্য। বিশেষ করে এমন সময়ে যখন আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলো বিশ্বের সেই অংশের দেশগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক বাড়াতে চাইছে।

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এই সম্মেলনের আগে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, বনায়ন, পরিবেশ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়া পাঁচটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট যখন সম্মেলনে উচ্চপর্যায়ের কৌশলগত সহযোগিতা পরিষদ চালু করার ঘোষণা দেন তখন বালি এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে যায়।

তুর্কিয়ে এবং ইন্দোনেশিয়া হলো মিকতার (এমআইকেটিএ) সদস্য। এই গ্রুপের মধ্যে মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে।

মিকতার নেতারা জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের সাইড লাইনে বৈঠকে মিলিত হন। এই গ্রুপের দেশগুলোর লক্ষ্য হলো, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। গ্রুপের প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব গ্রহণ করবে ইন্দোনেশিয়া।

আঙ্কারা সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া উভয় দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সম্পৃক্ত হয়েছে। এই সাথে ৩০টিরও বেশি তুর্কী প্রতিরক্ষা শিল্প কোম্পানি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা মেলায় তাদের পণ্য প্রদর্শন করেছে। এরপর, প্রধান তুর্কি প্রতিরক্ষা প্রস্তুতকারক রোকেতসান ল্যান্ড-টু-ল্য্ন্ডা, দূরপাল্লার আর্টিলারি সিস্টেম যান ইন্দোনেশিয়ায় রফতানি করার ব্যাপারে তাদের প্রথম চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা করে।

সেপ্টেম্বরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছিলেন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া তুরস্কের প্রতিরক্ষা ফার্ম বেকার থেকে সশস্ত্র ড্রোন কেনার জন্যে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তুর্কি অ্যারোস্পেস মালয়েশিয়ার দরপত্রে জয়লাভ করার পর আঙ্কারা মালয়েশিয়ার কাছে সশস্ত্র ড্রোন বিক্রি করবে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর এই বিবৃতিটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিরক্ষা খাতে চীনা প্রভাবের সম্ভাব্য পতনকে ইঙ্গিত করে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা এটি পড়েছিলেন।

তুর্কিয়ে (তুরস্ক) ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে জ্বালানি সহযোগিতায় জড়িত হতে আগ্রহী তুরস্কের জ্বালানিমন্ত্রী ফাতিহ ডোনমেজ এই মাসে বলেছেন, আমরা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় সফর করেছি। মালয়েশিয়ায় আমরা প্রাকৃতিক গ্যাস সংগ্রহ, অনুসন্ধান ও সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছি।

জুলাই মাসে তুর্কি-মালয়েশিয়া সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্ব পর্যায় থেকে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারিত্ব পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। বিশেষভাবে জ্বালানি খাতে, তেল এবং গ্যাসের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। জুলাই মাসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবারি ইয়াকুবের চার দিনের তুর্কিয়ে সফরের সময় প্রতিরক্ষা, শিল্প ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং মিডিয়ার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উভয় দেশ মালয়েশিয়া-তুর্কি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্প্রসারণ করতেও সম্মত হয়েছে, যা ২০০৪ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটি ছিল প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর (আসিয়ান) একটি সংস্থার সাথে পাকাপাকিভাবে সম্পাদন হয়েছে। আসিয়ানের অপর সদস্য রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের সাথেও অনুরূপ একটি চুক্তি চূড়ান্তভাবে সম্পাদিত হয়েছে। ইয়াকুবের তুরস্ক সফরের এক মাস পর কাভুসোগলু কুয়ালালামপুর সফর করেন। এরপর অক্টোবরে তুর্কি পার্লামেন্টের স্পিকার মোস্তফা সেন্তপ আনুষ্ঠানিকভাবে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া উভয় দেশ সফর করেন।

তুর্কিয়ে আসিয়ানের কয়েকটি রাষ্ট্র বিশেষত মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সাথে গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম শেয়ার করে যেমন ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এবং ডি-৮ অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন, ওআইসি, ডি-৮, মিকতা এবং আসিয়ান। এই প্লাটফর্মগুলো তুর্কিয়ের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, যাতে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলোতে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার সাথে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করে নেয়া যায়।

মালয়েশিয়া হলো তুর্কিয়ের বৃহত্তম আসিয়ান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং আঙ্কারার এশিয়া অ্যানিউ ইনিশিয়েটিভে এটির একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান রয়েছে যা এশিয়ান দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে ২০১৯ সালে তৈরি করা একটি রোডম্যাপ। ২০১৭ সালে তুর্কিয়েকে আসিয়ান সেক্টোরাল ডায়ালগ পার্টনারের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। অক্টোবরে তুরস্ক একটি চার দিনের ইভেন্টের আয়োজন করে। এতে আটটি আসিয়ান সদস্য দেশ : থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ব্রুনেই, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন এবং মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন। এই ইভেন্টের প্রাক্কালে তুরস্কের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আঙ্কারা আসিয়ানকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি প্রধান অংশীদার হিসেবে দেখে থাকে।

মালয়েশিয়ার রাজা আল সুলতান আব্দুল্লাহ রিয়াতউদ্দিন আল-মুস্তফা বিল্লাহ শাহ গত আগস্ট মাসে তুরস্ক সফর করলে মালয়েশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়। গত প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে তুরস্কে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ের এটি ছিল প্রথম সফর। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান মালয়েশিয়ার রাজাকে দ্য অর্ডার অব দ্য স্টেইট অব দ্য রিপাবলিকান অব টার্কিয়ে ভূষিত করেন। এটা হলো বিদেশীদের দেয়া তুরস্কের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অর্ডার অ্যাওয়ার্ড। মালয়েশিয়ার রাজাও এরদোগানকে তাঁর দেশের অর্ডার অব শিভালরি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। রাজা তাঁর সফরের সময় তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হালুসিএকারের সাথে রাজধানী আঙ্কারায় তুরস্কের একটি প্রতিরক্ষা কোম্পানি পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামাদি দেখেন।

এদিকে, চলতি সপ্তাহে ইস্তাম্বুল এশিয়ান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে ১১তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতা এই সাধারণ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলুগলোর মধ্যে মতবিনিময় এবং সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০০০ সালে এই সম্মেলন করার বিষয়টি চালু করা হয়েছিল।
মৌখিক পরিদর্শন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ, তবে দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য জনগণের সাথে জনগণের যোগাযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ বিষয়ে, তুর্কিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছাত্রদের তাদের দেশে অধ্যয়নের সুযোগ দেবার জন্যে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এই বছর আঙ্কারা আরো বেশি মালয়েশিয়ান এবং ইন্দোনেশিয়ানকে তুর্কিয়েতে শিক্ষার সুযোগ দানের জন্য স্পন্সরশিপ বৃদ্ধি করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

এশিয়া অ্যা নিউ ইনিশিয়েটিভের মধ্য দিয়ে তুরস্ক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। এ সম্পর্ক কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়- অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও।

লেখক : তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আরব নিউজের সৌজন্যে

ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement