২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মুলায়েম সিং যাদবের রাজনীতি এবং মুসলমান

সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়েম সিং যাদব - ছবি : সংগৃহীত

সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়েম সিং যাদব ১০ অক্টোবর ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি তিনবার দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং একবার দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৭ সালে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিতের সাহায্যে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারের খুব কাছাকাছি চলে গেছিলেন তিনি; কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং ও লালুপ্রসাদ যাদব তার এ ইচ্ছা পূরণ হতে দেননি। একজন স্কুলশিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করা মুলায়েম সিং রাজনীতির শিখরে কিভাবে পৌঁছলেন, সে কাহিনী যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি শিক্ষণীয়। তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টদায়ক মুহূর্ত ছিল, যখন তার পুত্র অখিলেশ যাদব তাকে অক্ষম করে দিয়ে সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্ব হাতিয়ে নেন। এ পরিস্থিতিতে তীব্রভাবে অস্থির হয়ে তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ কর্মীকে বলেছিলেন, ‘আমি কি এখন আত্মহত্যা করব’? তিনি সমাজবাদী পার্টিকে বেশ কষ্ট ও পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন। আর ইউপির মুসলমান তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুঁজি ছিল। মুসলিম ভোটের বদৌলতে তিনি তিনবার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছেন এবং ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করেন। আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে যেসব রাজনীতিবিদকে খুব কাছে থেকে দেখেছি, তাদের মধ্যে মুলায়েম সিংয়ের নাম সবার শীর্ষে।

এটি সম্ভবত ১৯৯৪ সালের ঘটনা। দিল্লিতে মুলায়েম সিং যাদব এমন একজন ব্যক্তির সন্ধানে ছিলেন, যিনি উর্দু ভাষায় পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি সুন্দর হস্তলিপিতে লিখতেও পারেন। মূলত তৎকালীন শাহী ইমাম সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ বুখারি তাকে মুসলিম সমস্যার ওপর উর্দুতে একটি পত্র লিখেছিলেন। ওই পত্রের জবাব তিনি উর্দুতে দিতে চাচ্ছিলেন। কেউ এ কাজে অধমের নাম প্রস্তাব করেন। এক দিন সকালে সমাজবাদী পার্টির অফিস থেকে আমার কাছে ফোন আসে- ‘মুলায়েম সিং জী আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন। আপনি কি ১১টার সময় নর্থ এভিনিউ পৌঁছতে পারবেন?’

আমি নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছলাম। মুলায়েম সিং ওখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি শাহী ইমামের পত্র আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘একটু পড়–ন তো, এতে কী লেখা আছে’? আমি ওই পত্রের বক্তব্য তাকে শোনালাম। তিনি কিছু উর্দু শব্দ বুঝলেন না। তার অর্থ জিজ্ঞাসা করলেন। এরপর আমাকে বললেন, এমনই সুন্দর হস্তলিপিতে আমার পক্ষ থেকে তাকে জবাব লিখে দিন। তিনি তার জবাব আমাকে বললে, আমি সেটি মনোরম শব্দের জামা পরিয়ে সুন্দর হস্তলিপিতে লিখে ফেললাম। আমার সুন্দর হস্তলিপিতে লেখার বিদ্যা এখানে বেশ কাজে এলো। নিজের পত্রের সুন্দর লেখা দেখে তিনি খুব মুগ্ধ হলেন। তিনি বললেন, আমি কয়েক লাইন লিখতে গেলে বাক্য কোন দিক থেকে কোন দিকে চলে যায়। আপনি এতগুলো লাইন বেশ সুচারুরূপে লিখে দিয়েছেন। এটা ছিল মুলায়েম সিং যাদবের সাথে আমার প্রথম সরাসরি পরিচয়, যা পরবর্তীতে বন্ধুত্বে রূপ নেয়।

মুলায়েম সিং রাজনীতিতে বিখ্যাত সমাজবাদী নেতা রাম মনোহর লোহিয়াকে অনুসরণ করতেন। তিনি লোহিয়ার নাম উজ্জীবিত করে রাখেন। এমনকি তিনি লক্ষ্ণৌতে লোহিয়া ট্রাস্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মুলায়েম সিং লোহিয়ার সমাজবাদী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের দলের নাম সমাজবাদী পার্টি রেখেছিলেন। কিন্তু এটাও এক বাস্তবতা যে, তিনি সমাজবাদকে নতুন পরিচয়ের পোশাক পরিধান করান। মূলত মুলায়েম সিং দূরে তাকিয়ে অপেক্ষার বিপরীতে সর্বদা তাৎক্ষণিক ফায়দাকে গুরুত্ব দিতেন। এ কারণে তিনি সেক্যুলার রাজনীতির অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও সঙ্ঘ মহলেও ওঠাবসা করতেন। অথচ আরএসএস-ই তাকে ‘মাওলানা মুলায়েম’ উপাধি দিয়েছিল। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে যখন তিনি ভরা পার্লামেন্টে সোনিয়া গান্ধীর কাছে বসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশীর্বাদ দেন, তখন সেক্যুলার মহলে তার তীব্র সমালোচনা করা হয়। সম্ভবত এ কারণে ২০১৯ সালের নির্বাচনে লোকসভায় তার সদস্যের সংখ্যা কমে পাঁচে এসে দাঁড়ায়। আর এখন শুধু দু’জন সদস্য ড. শফিকুর রহমান বারক ও ড. এসটি হাসানই লোকসভায় সমাজবাদীর নামটুকু টিকিয়ে রেখেছেন।

এ কথা সবাই জানেন যে, মুলায়েম সিংয়ের রাজনীতির মেরুদণ্ড ও ভিত্তি ছিল মুসলমান। মুসলমানদের শক্তিতে তিনি তিনবার ইউপিতে মুখ্যমন্ত্রীর মুকুট পরিধান করেন। তার রাজনীতি মুসলমানদের জন্য উপকারী ছিল, না ক্ষতিকর ছিল সেই বিতর্ক বাদ দিলে এ কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি প্রকাশ্যে মুসলমানদের পক্ষে কথা বলতেন এবং দুঃখশোকে শরিক হতেন। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, নব্বইয়ের দশকে যখন বিশ^ হিন্দু পরিষদের রামজন্মভূমি আন্দোলন তুঙ্গে, তখন তিনিই একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি বাবরি মসজিদের পক্ষে বক্তৃতা করতেন। তিনি তার শাসনামলে বাবরি মসজিদের গম্বুজে আরোহণকারী নামসর্বস্ব করসেবকদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন এবং উগ্রপন্থী হিন্দুদের মাঝে খলনায়ক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মূলত বাবরি মসজিদ বিতর্কে তার স্পষ্ট অবস্থানই তাকে মুসলমানদের আশার স্থল বানিয়ে দিয়েছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্ট যখন বাবরি মসজিদের ভূমি তিন ভাগে বিভক্ত করার বিস্ময়কর রায় শোনান, তখন এই মুলায়েম সিংই সেই ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা নিজেদের প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত মনে করছেন।’ তিনি মুসলমানদের ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে জানতেন। আর এর সর্বাধিক রাজনৈতিক ফায়দাও তিনিই নিয়েছেন। এটা ভিন্ন কথা, মুলায়েম সিং বাবরি মসজিদের নিকৃষ্ট বিরোধী কল্যাণ সিং ও সাক্ষী মহারাজকে নিজের দলে যুক্ত করে মুসলমানদের ক্ষতস্থানে নুন ছিটানোর কাজও করেছিলেন। যাই হোক, মুসলমানদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তার মৃত্যুকে সেক্যুলার রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি বলে অভিহিত করেছেন।

যদি এটা বলা হয়, তবে অনর্থক হবে না যে, বাবরি মসজিদ বিতর্কের তীব্র আন্দোলনের সময়কাল মূলত তার রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকাল ছিল। এ ইস্যু যেভাবে ক্রমে ক্রমে শক্তি অর্জন করেছে, ওইভাবে তার রাজনৈতিক শক্তিও ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালের ইউপি বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তিনি প্রকাশ্যে এ কথা স্বীকার করেছিলেন, মুসলমানরা তাদের সব ভোট সমাজবাদী পার্টির ঝুলিতে ঢেলে দিয়েছেন। সুতরাং সমাজবাদী কর্মীদের তাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত; কিন্তু মানুষ দেখল, এর এক বছর পর যখন মোজাফ্ফর নগরে ভয়ঙ্কর মুসলিম নিধন দাঙ্গা হলো, তখন তার সরকার সেটিকে থামাতে একেবারে ব্যর্থ হয়েছে। এখান থেকে মুসলমানদের মনে মুলায়েম সিং ও তার দল সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি শুরু হয় এবং সম্ভবত এরই ফলে ২০১৭ সালের বিধান সভা নির্বাচনে তার বিধায়কের সংখ্যা ৩০-এ এসে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের নির্বাচনে মুলায়েম সিংয়ের স্লোগান একেবারে বদলে গিয়েছিল। তিনি দলের কার্যালয়ে কর্মীদের সম্বোধন করে কৃষক, যুবক ও ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ করার স্লোগান দেন। এতে মুসলমানদের নাম পর্যন্ত নেননি। অথচ তিনি তার বক্তৃতায় অবশ্যই মুসলমানদের নাম নিতেন। তথাপি ওই নির্বাচনেও মুসলমানদের প্রথম পছন্দ ছিল সমাজবাদী পার্টি।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানদের ভোট পাওয়ার পর মুলায়েম সিং যাদব তাদের কল্যাণ ও উন্নয়নে কী কাজ করেছেন? এর জবাব শুধু এতটুকুই, তিনি এই পুরো সময়ে মুসলমানদের আবেগময় সান্ত্বনা প্রদানের কাজ করেছেন। হ্যাঁ, এতটুকু তো অবশ্যই করেছেন যে, তিনি তার শাসনকালের দ্বিতীয় মেয়াদে উর্দু শিক্ষক ও অনুবাদক নিয়োগের মাধ্যমে কিছু মুসলমানের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং ইউপিতে সব সরকারি দফতরের নাম উর্দুতে লিখিয়েছেন। কিন্তু অন্য সব সেক্যুলার রাজনীতিবিদের মতো তিনিও মুসলমানদের উন্নয়ন ও কল্যাণে কোনো সুদৃঢ় কাজ করার পরিবর্তে আবেগী স্লোগানের আশ্রয় নিয়েছেন। মুসলিম ভোটের ভিত্তিতে ক্ষমতা হাসিল করা সত্ত্বেও তিনি যাদবদের সামনে এগিয়ে নিয়েছেন।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১৬ অক্টোবর, ২০২২ উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement