২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বপ্ন সেটি নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে

স্বপ্ন সেটি নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে - প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ নিয়ে অনেকেই স্বপ্ন দেখেন, এর অমিত সম্ভাবনার কথা বলেন। তবে প্রাজ্ঞজনের মতে, স্বপ্ন সেটি নয়, যা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে। বরং স্বপ্ন সেটিই, যা পূরণের প্রত্যাশায় মানুষ ঘুমানোর সুযোগ পায় না। বাংলাদেশের যা কিছু সম্ভাবনা তার বাস্তব রূপদান করতে হলে, গণতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষিনীতি, শিল্পনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই নিতে হবে বাস্তবধর্মী উদ্যোগ। পরিবর্তন আনতে হবে মন-মানসিকতায় ও আচার-আচরণে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভাজন থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। কেননা, মাথা যেমন সমস্ত শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশকে এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে। রাজনীতিতে সঙ্কট জিইয়ে রেখে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত। এটি সবাইকে আশাহত করে, বিনষ্ট করে মানুষের উদ্যম ও উদ্দীপনা। কাজেই রাজনৈতিক বিভাজন ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে হবে, জনমতের প্রাধান্য দিয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তা হলেই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের সামনে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে চ্যালেঞ্জও। আগামী দিনগুলোয় চীন, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুমুল প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের দিকে বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা, এ দু’টি দেশের সাথে বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে এ দু’টি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। তারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে কিভাবে এ দু’টি দেশে তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা যায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশী বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভারতের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশকে ব্যবসায় করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের যে সহযোগিতার দরকার, ভারতকে তা দিতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে চীনের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য স¤প্রসারণেও। বাংলাদেশকে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। তাছাড়া মিয়ানমার দিয়েও বাংলাদেশ চীনে প্রবেশ করতে পারে।

বাংলাদেশের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ সুবিধাগুলো এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের নিয়ামক। রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। উপমহাদেশ ও এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়- সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সাথে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভ‚খণ্ডের বৈচিত্র্য দিয়ে। বাংলাদেশের তিন দিকজুড়ে রয়েছে ভারত। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। এর পাশে রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া। তা ছাড়া রয়েছে ভুটান, নেপাল ও সিকিম। ভৌগোলিকভাবে এই দেশগুলো খুবই সন্নিকটবর্তী। বাংলাদেশ থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ১৮ মাইল, ভুটানের ৪৫ মাইল ও চীনের বর্ডার ৪০ মাইল। তা ছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপক‚লবর্তী দেশ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা শুরু সমুদ্রের জলরাশি দিয়ে। আর এ মহাসমুদ্রই বাংলাদেশকে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খ্যাতি। তাই বাংলাদেশকে বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগস্থল। এ জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভ‚মিকা রয়েছে। তা ছাড়া চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের এই ভ‚মিকাকে আরো জোরালো ও শক্তিশালী করেছে। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই রাজনীতিবিদদের পথ চলতে হবে এবং তৈরি করতে হবে কর্মকৌশল।

আগামী দিনগুলোতে যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপরের তালিকায় উঠে আসবে, এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের জন্য চমৎকার রাজনৈতিক সুযোগ। এ জন্য বাংলাদেশকে দেখতে হবে ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্ন দৃষ্টিতে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, সিকিম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল। তা ছাড়া ‘সেভেন সিস্টার’ খ্যাত ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশদ্বারও বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল। ফলে প্রায় শত কোটি মানুষের ব্যবসায়-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপদ নয়; জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশী। পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুসংহত হয়েছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরো বড় বড় দেশ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ। তৈরী পোশাক শিল্পে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জনশক্তি রফতানি ও ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। কাজেই বাংলাদেশের শত্রু এখন চতুর্মুখী। ওপরে উঠতে হলে বাংলাদেশকে এসব চিন্তা মাথায় রাখতে হবে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে; সুনিশ্চিত করতে হবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। তা হলেই কেবল একটি দেশের অর্থনীতির আকার বড় হতে পারে, দেশটি হতে পারে উন্নত, আধুনিক একটি দেশ।

বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ আছে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ কর্মক্ষম ও ফিজিক্যালি ফিট। গত ২০ বছরে প্রায় পাঁচ কোটি উদ্যমী, তরুণ ও যুবক যোগ হয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তিতে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, জনশক্তি ও বেসরকারি খাত একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে, যা একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটির উপরে মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিশ্বে একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের খ্যাতি অর্জন করেছে। পাশাপাশি এ শিল্পটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পের গৌরবের অধিকারী। তা ছাড়া চা, চামড়া, ওষুধ ও হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতেও বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এসব কোনো কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব সত্য। তাহলে এ দেশের উন্নয়ন আটকে রাখার সাধ্য কার? যদি নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত না হই, নিজেদের মধ্যে যদি শৃঙ্খলা থাকে, থাকে দায়িত্বশীলতা- তাহলে উন্নয়ন নিশ্চিত। কাজেই বাস্তববাদী হতে হবে, দূরের জিনিস দেখতে হবে। জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। নদী খনন করে মাছচাষ ও সম্পদের উৎসে পরিণত করতে হবে। কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী গণপরিবহন ব্যবস্থা, রেলকে করতে হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক, রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত শহর হিসেবে। সর্বোপরি সঙ্ঘাতপূর্ণ, হানাহানির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

রাজনীতিবিদদের অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে এক প্লাটফর্মে থেকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এক সুরে কথা বলতে হবে। অহমিকা ত্যাগ করে পরমতসহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করতে হবে এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি সম্পূর্ণ অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ সুগম করতে হবে। তা হলেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে, স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

লেখক : কলামিস্ট
ইমেল : belayet_1@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement