২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব ও আল কুরআন

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব ও আল কুরআন - ছবি : সংগৃহীত

সৃষ্টির প্রথমাবস্থায় মহাবিশ্ব সুষম এবং সমতাপীয়রূপে একটি অতি উচ্চ শক্তি ঘনত্ব এবং উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপবিশিষ্ট বিন্দুবৎ পদার্থ ছিল। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০৪৩ সেকেন্ড পর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো কার্যকারিতা লাভ করে। তাই এই সময়কে প্ল্যাংকের সময় বলা হয়। প্ল্যাংকের সময়ের প্রায় ১০৩৫ সেকেন্ড পর একটি অবস্থান্তর অবস্থার সূচনা ঘটে যার ফলে মহাজাগতিক স্ফীতি শুরু হয়। এই সময় মহাবিশ্ব সম্প্র্রসারিত হতে শুরু করে।

মহাবিশ্বের শুরুতে এর ভর ছিল ১০ (৫১) কেজি এবং ঘনত্ব ছিল ১০ (২১) কিউবিক মিটার। এমতাবস্থায় আভ্যন্তরীণ চাপ ও তাপ, উচ্চ শক্তি ঘনত্বের প্রভাবে ডিম্বাকার বিশ্বের মহাবিস্ফোরণ ঘটে যার নাম বিগব্যাং। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত মানুষ মনে করত পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র যাকে ঘিরে ঘুরে চলেছে চাঁদ, সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র। ষোড়শ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কোপার্নিকাস, কেপলার এবং গ্যালিলিও প্রমুখ বিজ্ঞানীর কল্যাণে মানুষ মনে করতে থাকল যে পৃথিবী নয় সূর্যের চার দিকেই সৌর জগতের সব সদস্য ঘুরছে। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ জানতে পারে, এই মহাবিশ্বে ১০ সংখক গ্যালাক্সি আছে যারা সবাই চলমান-ঘূর্ণায়মান। আমরা যে গ্যালাক্সিতে আছি সেটির নাম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেও ১০(১১) সংখ্যক নক্ষত্র আছে। এক একটি নক্ষত্র মহাকাশের এক একটি উজ্জ্বল বাতিসদৃশ। সূর্য আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একপ্রান্তে অবস্থান করে সর্বদা ঘূর্ণায়মান একটি মাঝারি ধরনের নক্ষত্র। মিল্কিওয়ে গ্যালক্সি হাজার হাজার সৌরজগত দ্বারা পূর্ণ।

মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বলতে কী বুঝায়?
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বলতে স্থানের মেট্রিক সম্প্রসারণ বুঝায় যা সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি দূরবর্তী বস্তুর দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে। স্থানের সম্প্রসারণে ছায়াপথগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর কারণ ছায়াপথগুলোর নিজস্ব কোনো বেগ নয় বরং স্থানের সম্প্রসারণে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে।

প্রত্যেকটি সৌরজগতে আছে অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে গেলেও এর ভেতরকার গ্রহ নক্ষত্রগুলো কিন্তু পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না। এরা প্রত্যেকেই নিজস্ব কক্ষপথে সংশ্লিষ্ট গ্যালক্সির চার দিকে ক্রমশ ঘূর্ণনের মধ্যে আছে। যেমন পৃথিবী নিজস্ব কক্ষপথে সূর্যের চার দিকে ঘুরছে কিন্তু পৃথিবী থেকে সূর্য দূরে সরে যাচ্ছে না। এ হিসেবে প্রতিটি ছায়াপথ বা গ্যালক্সি মহাবিশ্বের এক একটি পরিবার। সম্প্রসারণের ফলে এ গ্যালাক্সি পরিবারগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু ছায়াপথের মধ্যকার সদস্য গ্রহ-নক্ষত্র পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না। সারা পৃথিবীর মোট বালুকণার সংখ্যার চেয়েও বেশি তারাসহ অন্তত দুই লাখ কোটি ছায়াপথ পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে অবস্থিত। পর্যবেক্ষণহীন মহাবিশ্বের বাহিরে কী আছে তার কিছুই আমরা জানি না।

মেট্রিক সম্প্রসারণ মহাবিস্ফোরণ বিশ্বতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য
সম্প্রসারণকে ফ্রিদমান-ল্যমের্স্ত্রন-ওয়াকার মেট্রিকেন (ফলরও মেট্রিক) মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। ‘মেট্রিক সম্প্রসারণ’ শব্দ দুটির মাঝে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের প্রকৃত অর্থ নিহিত আছে। তবে ‘ফলরও মেট্রিক’ শুধু মহাবিশ্বের অনেক বড় স্কেলে প্রযোজ্য, ছোট স্কেলে নয়।। পুরো মহাবিশ্বকে একসাথে সমসত্ত্ব এবং সমরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের আশপাশে তাকালে স্পষ্টত দেখতে পাই মহাবিশ্ব সমসত্ত্ব ও সমরূপ নয়, পৃথিবীর পৃষ্ঠের চেয়ে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব অনেক কম, তারাদের তুলনায় তাদের মধ্যবর্তী স্থানের ঘনত্ব অনেক কম। কিন্তু অনেক বড় স্কেলে গেলে, অর্থাৎ অনেক ছায়াপথের সমষ্টিকে একটি একক হিসেবে বিবেচনা করলে মহাবিশ্ব আসলে প্রায় সমসত্ত¡ ও সমরূপ, অর্থাৎ এ বিশ্বের এক দিকের মহাছায়াপথ স্তবকগুলোর সাথে অন্য দিকের মহাছায়াপথ স্তবকগুলোর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এ জন্য ফলরও মেট্রিক কেবল মহাছায়াপথ স্তবকদের স্কেলে প্রযোজ্য। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এমন নয়। যেমন আমাদের এ সৌরজগত যে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত সেই ছায়াপথটি কিন্তু ধীরে ধীরে তার নিকটবর্তী এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের কাছাকাছি চলে আসছে এবং ধারণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে এ দুই ছায়াপথের মধ্যে সংঘর্ষও বেধে যেতে পারে। এর কারণ, তারা এত কাছাকাছি অবস্থিত যে প্রসারণমুখী বলের তুলনায় তাদের পারস্পরিক মহাকর্ষ বল বেশি শক্তিশালী। তাই এটি ফলরও মেট্রিকের কোনো নিয়ম মেনে চলে না।

বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রানুসারে কোনো বস্তুর সাপেক্ষে অন্য কোনো বস্তুর বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। কিন্তু স্থানের প্রসারণের বেগ আলোর চেয়ে বেশি হতে পারে। তাই অনেক দূরে অবস্থিত দুটি বস্তু নিজেদের স্থানের সম্প্রসারণে একে অপরের থেকে আলোর চেয়েও বেশি বেগে সরে যেতে পারে। মহাবিশ্বে আমাদের থেকে কোনো বস্তুর দূরত্ব যত বেশি তার পশ্চাৎপসরণের বেগও তত বেশি, তাই একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পর বস্তুর বেগ আলোর চেয়ে বেশি হবে এবং আমরা সেটি দেখতে পারব না। যে দূরত্ব পর্যন্ত বস্তুগুলো আলোর চেয়ে কম বেগে অপসৃত হয় সেটুকু দূরত্বকে তাই পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব বলা হয়। মহাবিশ্বের প্রকৃত আকার এ পর্যবেক্ষণযোগ্য আয়তনের চেয়ে অনেক বেশিও হতে পারে। অন্য দিকে, আলোর সসীম বেগে অনেক দূরের বস্তু দেখার অর্থ দাঁড়ায় আসলে বস্তুটির অতীত অবস্থাকে দেখা। যেমন, ১০০ আলোকবর্ষ দূরের একটি তারা থেকে আলো আমাদের কাছে আসতে ১০০ বছর সময় নেয়। তাই তারাটি দেখার অর্থ দাঁড়ায় তার ১০০ বছর আগের অবস্থা দেখা। এমনকি মহাবিস্ফোরণের কাছাকাছি সময়ে সঙ্ঘটিত কোনো ঘটনা হয়তো দূরের কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে এই মাত্র পৌঁছাবে। যেমন আমরা মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করি যা মহাবিস্ফোরণের মাত্র তিন লাখ বছর পর নিসৃত হয়েছিল। তবে মেট্রিক সম্প্রসারণ নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে।

গ্যালাক্সিগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে
১৯২৯ সালে এডউইন হাবল নামে এক আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণমূলক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঘোষণা করেন, ছায়াপথগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, যার অর্থ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে। মহাবিশ্বের এ প্রসারণ আজ বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

খ্যতিমান জ্যোতিপদার্থবিদদের মধ্যে থেকে অন্যতম শীর্ষ বিজ্ঞানী স্টেফিন হকিং তার ‘সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন : ‘মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে’-এ আবিষ্কারটি বিংশ শতাব্দীর মহান বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবগুলোর অন্যতম। পবিত্র কুরআনে মহাবিশ্বের এ সম্প্রসারণশীলতার উল্লেখ রয়েছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দীর্ঘ নয় বছর গবেষণার পর পৃথিবীর সম্প্রসারণ সম্পর্কিত গবেষণার ফল সূত্রাকারে প্রকাশ করেন। এ সূত্রানুসারে, গ্যালাক্সিগুলো প্রতিনিয়ত অতিদ্রুত বেগে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গ্যালাক্সিসমূহের দূরগমনের হার আমাদের থেকে দূরত্বের সমানুপাতিক। অর্থাৎ যে গ্যালাক্সি আমাদের থেকে যত দূরে তার দূর গমনের বেগ তত বেশি।

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব এবং বিগব্যাং তত্ত্বের জনক জর্জ ল্যামাইটার
হাবলের সূত্র প্রদানের দুই বছর আগে ১৯২৭ সালে একজন বেলজিয়ান কসমোলজিস্ট, ক্যাথলিক ধর্মযাজক বিজ্ঞানী জর্জ ল্যামাইটার (১৮৯৪-১৯৬৬) সম্প্রসারণশীল বিশ্বসংক্রান্ত তত্ত¡ দেন যা হাবলের সূত্রের সাথে মিলে যায়। পরে ১৯৩১ সালে তিনি প্রস্তাব করেন, প্রসারণশীল বিশ্বকে যদি সময়ের সাথে পিছিয়ে নেয়া যায়, তাহলে আমরা একটা বিন্দুতে উপনীত হতে পারব যেখানে একসময় সমস্ত ভর এক বিন্দুতে পুঞ্জীভূত ছিল এবং যেখান থেকে স্থান ও কালের উদ্ভব। এ মিলন বিন্দুকে বলা হয় সিংগুলারিটি যেখান থেকে বিগব্যাংয়ের সূচনা হয়েছিল।

বিগব্যাংয়ের পরিণতি
এখন সব বিজ্ঞানীর কাছে এটি পরিষ্কার, এ মহাবিশ্বের সৃষ্টি যেমন মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে, তেমনি ধবংসও হবে শব্দের মাধ্যমে। মহাবিশ্বের জায়গায় জায়গায় এখনো সুপারনোভার বিস্ফোরণের ফলে অসংখ্য নীহারিকা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে অসংখ্য নক্ষত্রের। আর নীহারিকা গ্যাসপিণ্ড গঠিত ৫০-৭৫ শতাংশ হাইড্রোজেন ও ২০-৪৫ শতাংশ হিলিয়াম এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য মৌলিক পদার্থ দিয়ে।

কোন কারণে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে
মহাবিশ্ব সম্প্রদারণের দুটো মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিগব্যাং এরপর সৃষ্ট বিকর্ষণ যা আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন ছিল এবং যা কখনই কোনো ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিসম্পন্ন কোনো কিছু টেলিস্কোপ কিংবা ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য বর্তমান জেমস্ ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে বিগব্যাংয়ের পর ১৩৫০ কোটি আলোকবর্ষ আগেকার ছবি ধারণ করতে পেরেছে, ১৩৮০ কোটি আলোকবর্ষ আগেকার বিগব্যাংয়ের ছবি ধারণ করতে পারেনি।

দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস ৯৩০০ কোটি আলোকবর্ষ
দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরের অঞ্চলে স্থানের প্রসারণ আলোর বেগের চেয়ে বেশি বেগে ঘটছে তাই এ সীমান্তের বাইরের কোনো কিছু থেকে আলো দৃশ্যমান মহাবিশ্বে কখনো প্রবেশ করতে পারবে না; কারণ সে আমাদের দিকে যতটা অগ্রসর হবে, তার চেয়ে দ্রুত আরো দূরে সরে যাবে। ফলে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সীমান্তটি একটি কৃষ্ণগহ্বরের সীমান্তের মতো। এ কারণে এই সীমান্তের ভেতরের অংশটিকে ‘দৃশ্যমান’ বলা হয় এবং সীমান্তটিকে ‘মহাজাগতিক ঘটনা দিগন্ত’ বলা হয়।

মহাবিশ্ব একসময় একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত ছিল। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তিতে একটি বিন্দু থেকে বিশাল মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়া স্ট্রিং থিওরি মেনে চলে। মহাবিশ্ব যেহেতু একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সব শক্তি এবং অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র, বিভিন্ন বস্তুসমূহ ছড়িয়ে পড়েছে, সেই শক্তির জন্য মহাবিশ্ব এখনো প্রসারিত হচ্ছে এবং মহাকর্ষীয় বস্তুগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরে সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের প্রকৃত বিস্তার সম্পর্কে কোনো ধারণা আমরা করতে পারি না। হতে পারে এটা অসীম।

একটি বোমা বিস্ফোরণের পর বোমার ভেতর থাকা সবকিছু চার দিকে ছিটকে পড়ে। স্থান-কালের মহাবিস্ফোরণের পরও তেমনিভাবে স্থান ছিটকে পড়ছে বা প্রসারিত হচ্ছে। নিউটনের গতি সূত্র মতে, একটি গতিশীল বস্তুর ওপর বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ করা না হলে সে আজীবন সমবেগে চলতে থাকবে। স্থানও তেমনি সমবেগে প্রসারিত হতে থাকার কথা, যদি বাহ্যিক কোনো বল ক্রিয়া না করে। কিন্তু আসলে বাহ্যিক দুটি বলের প্রভাব রয়েছে। একটি মহাকর্ষ বল যা অবশ্য আকর্ষণমুখী অর্থাৎ এ বলের কারণে এক বস্তু অপর বস্তুকে আকর্ষণ করে। এ আকর্ষণের কারণে প্রসারণ বেগ দিন দিন কমতে থাকার কথা, তথা মহাবিশ্বের মন্দন ঘটার কথা। কিন্তু ১৯৯৭ সালে বিজ্ঞানীরা এর ঠিক উল্টোটি সত্যি বলে জানতে পারেন। অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে বর্তমানে দায়ী করা হচ্ছে ডার্ক এনার্জিকে। তাত্ত্বিকভাবে দেখানো যায় যে, মহাবিশ্বের তিনটি উপাদান, বিকিরণ, পদার্থ এবং এনার্জির ঘনত্বের ওপর প্রসারণের ত্বরণ নির্ভর করে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অধুনা নিশ্চিত করেছেন যে আমাদের মহাবিশ্ব ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটারে ভরপুর। এই ডার্ক এনার্জির রয়েছে এক রহস্যময় বিকর্ষণী শক্তি। যার ধর্ম মহাকর্ষকে বিকর্ষণ করা; ফলে মহাশূন্যে প্রবহমান এ শক্তি মহাজাগতিক বস্তুনিলয়কে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে চার দিকে।

১৯৯০-এর দশক থেকে মহাবিশ্বের ত্বরিত সম্প্রসারণে বিজ্ঞানীরা ডার্ক এনার্জিকে দায়ী করে আসছিলেন। অবশেষে ১৯৯৮ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাডাম রিস এবং সাউল পার্লমুটার ও অস্ট্রেলিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রায়ান শ্মিড্টের অন্তর্ভুক্ত দুটি আন্তর্জাতিক দল ডার্ক এনার্জি আবিষ্কার করেন। ভৌতিক কসমোলজি এবং জ্যোতির্বিদ্যায়, ডার্ক এনার্জি হলো একটি অজানা শক্তি যা মহাবিশ্বকে সবচেয়ে বড় স্কেলে প্রভাবিত করে। বর্তমান সর্বোত্তম গবেষণা নির্দেশ করে যে ডার্ক এনার্জি বর্তমান সময়ের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মোট শক্তির ৬৮% অবদান রাখে। ২০২১ সালের পর থেকে ডার্ক এনার্জির মৌলিক প্রকৃতি বোঝার জন্য সৃষ্টিতত্ত্ব গবেষণায় বিজ্ঞানীগণ বিশেষভাবে সক্রিয় রয়েছে।

ডার্ক মেটা
ডার্ক ম্যাটার হলো একটি প্রো-গ্রাভিটেশনাল ফোর্স যুক্ত ভর বস্তু। যে কোনো বস্তুর ভর থাকা মানে সে অন্য বস্তুকে আকর্ষণ করবে। মহাবিশ্বে অবস্থিত প্রত্যেক গ্যালক্সিতে বিপুল পরিমাণ ভর রয়েছে যারা মহাকর্ষ বল সরবরাহ করে। মহাকর্ষ ভর ঘিরে নক্ষত্রগুলো গ্যালাক্সির চার দিকে সর্বদা ঘূর্ণায়মান থাকে। কিন্তু গ্যালাক্সিতে বিদ্যমান গ্রহ-নক্ষত্র পরস্পর থেকে দূরে সরে যায় না। তবে কোনো তাড়িতচৌম্বক বিকিরণ নিঃসরণ করে না বিধায় তা আমাদের রেডিও টেলিস্কোপে ধরা পড়ে না। এসব অদৃশ্য অথচ আকর্ষণ সৃষ্টিকারী ভরকে অদৃশ্য ভর বা ডার্ক ম্যাটার বলে। ধারণা করা হয় গ্যালাক্সিতে অদৃশ্য ভরের পরিমাণ দৃশ্যমান ভরের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ১৯৩২ সালে জন ওর্ট ডার্ক মেটারের কথা উল্লেখ করেন। ২০০৬ সালে ছায়াপথগুলোর সংঘর্ষকালে পর্যবেক্ষণ করে ডার্ক ম্যাটারের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেয়েছেন।

ডার্ক এনার্জি
ডার্ক এনার্জি হলো একটি অ্যান্টি গ্রাভিটি বল যা মহাবিশ্বের ত্বরান্বিত সম্প্রসারণের জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এ মহাবিশ্বে মহাকর্ষ বলের বিপরীতে আরেকটি ক্রিয়াশীল শক্তি কার্যকর রয়েছে যার ফলে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত না হয়ে বরং ত্বরিত গতিতে সম্প্রসারণ হচ্ছে। যে অদৃশ্য শক্তির বলে মহাবিশ্ব ক্রমাগত ত্বরিত গতিতে সম্প্রসারণ হচ্ছে, সে শক্তিকে কস্মোলজিস্টগণ ডার্ক এনার্জি বলছে। এই যে একটি অদৃশ্য শক্তি বা ডার্ক এনার্জি বলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হচ্ছে তা কিন্তু নির্দিষ্ট হারে বা গতিতে হচ্ছে না, বরং ক্রমাগতভাবে ত্বরিত গতিতে হচ্ছে। এ পর্যায়ে এসে সৃষ্টিতত্ত্ববিদেরা বিশ্বাস করেন যে, মহাবিশ্বের এ ত্বরান্বিত সম্প্রসারণ কোনো নতুন শক্তি ক্ষেত্রের কারণে হচ্ছে যা প্রায় এক শতাব্দী আগে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন অনুমান করেছিলেন। অদৃশ্য বস্তু বা ডার্ক ম্যাটার মহাকর্ষ ক্ষেত্র সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। অপর দিকে ডার্ক এনার্জি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে ত্বরান্বিত করে। অর্থাৎ এরা পরস্পরের বিপরীতে কাজ করে।

বর্তমান বিশ্বের সব বিজ্ঞানী একমত, মহাবিশ্ব একটি পরম উত্তপ্ত ও পরম ঘনত্বের একটি বিন্দু কণার বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এ বিস্ফোরণের সাথে সাথে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বেশ কয়েকটি ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। সময়ের সূচনা, ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার, পর্যায়ক্রমে মহাকর্ষণ বল, সবল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বল, ঘূর্ণন, সম্প্রসারণ এবং প্রচুর এনার্জি। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন যে মহাবিশ্বের সব ধরনের পদার্থ এবং শক্তি সময়ের সাথে সাথে সম্প্রসারণকে ধীর করে দেবে।

এটা প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানীদের একটি গ্রুপ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেন যে, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ধীর হওয়ার পরিবর্তে বরং ত্বরিত গতিতে সম্প্রসারণ হচ্ছে। তখন বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে নিশ্চয় মহাবিশ্বের এমন একটি বহির্মর্খী শক্তি কাজ করছে যার কারণে বিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ বহির্মুখী শক্তিটাকে ডার্ক এনার্জি বলে। বর্তমান মহাবিশ্বের মোট শক্তি ঘনত্বের শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশজুড়ে রয়েছে এ অদৃশ্য শক্তি।

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কী
মহাবিশ্বের পরিণতি নিয়ে তিনটি ভিন্ন মত রয়েছে। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কি হবে তা নির্ভর করে দুটো জিনিসের ওপর। একটি মহাবিশ্বের জ্যামিতিক আকৃতি, অন্যটি বিদ্যমান ডার্ক এনার্জি। এই দুটো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে তিনটি তত্ত্ব আছে।

প্রথমত, ‘আবদ্ধ মহাবিশ্ব তত্ত¡’ যাতে বলা হয়েছে যে মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব সঙ্কট ঘনত্বের চেয়ে বেশি হবে ফলে সম্প্রসারণের এক পর্যায়ে প্রসারণ বন্ধ হয়ে, সঙ্কুচিত হয়ে গোলক জ্যামিতিক আকৃতি ধারণ করবে এবং মহাসঙ্কোচন বা বিগ ক্রাঞ্চ হবে।

দ্বিতীয়ত, ‘উন্মুক্ত মহাবিশ্ব তত্ত¡’ যাতে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব সঙ্কট ঘনত্ব অপেক্ষা কম হবে ফলে অনন্তকাল ধরে প্রসারণ চলতে থাকবে। উন্মুক্ত মহাবিশ্বের জ্যামিতিক আকৃতি হবে অধিবৃত্তাকার। এ অবস্থায় মহাবিশ্বের প্রসারণ এবং অদৃশ্য শক্তি অসীম হবে। একসময় সব কিছুই হারিয়ে যাবে। একে বলে মহাবিচ্ছেদ বা বিগ রিপ।

তৃতীয়ত, ‘সমতল মহাবিশ্ব তত্ত¡ যাতে বলা হয়েছে- মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব সঙ্কট ঘনত্বের সমান অথবা কম হবে, তবে প্রসারণ ধীর হয়ে যাবে কিন্তু অনন্ত কাল ধরে চলতে থাকবে। সমতল মহাবিশ্বের জ্যামিতিক আকৃতি হবে সমতল। এ ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব যত সম্প্রসারিত হবে তত তাপমাত্রা কমতে থাকবে। নতুন কোনো নক্ষত্রের সৃষ্টি হবে না। ফলে তাপমাত্রা কমতে কমতে এক পর্যায়ে বিগ ফ্রিজ বা মহাহিমায়ন হবে।

কুরআনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি, সম্প্রসারণ এবং শেষ পরিণতির ধারণা
বিগব্যাং, মহাসম্প্রসারণ এবং বিগ ক্রাঞ্চ তত্ত্বের মূল ধারণা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা তার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন মাত্র। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মত হলো, বিগব্যাং ঘটনার পর সম্প্রসারিত হওয়ার একপর্যায়ে আর প্রসারিত না হয়ে বরং বহির্মুখী শক্তি (ডার্ক এনার্জি) দুর্বল হয়ে বরং কাছাকাছি চলে আসতে আসতে ঘনীভূত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাবে। এটি ‘বিগ ক্রাঞ্চ তত্ত¡’।

বিগব্যাং, মহাসম্প্রসারণ তত্ত্ব ও বিগ ক্রাঞ্চ তত্ত্বের পক্ষে পবিত্র কুরআনের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের বক্তব্য হুবহু মিলে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা অস্বীকার করেছে তারা কি চিন্তা করে না যে, এসব আকাশ ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিল, তারপর আমি আলাদা করলাম এবং পানি থেকে সৃষ্টি করলাম প্রত্যেকটি প্রাণীকে। তারা কি (আমার এ সৃষ্টি ক্ষমতাকে) মানে না?’ (সূরা আম্বিয়া-৩০)। এ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী একসময় একত্রে ছিল ( সিঙ্গুলারিটি তত্ত¡) পরে তা আলাদা (বিগব্যাং) হয়ে গেছে। আল কুরআনে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্পর্কে আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন সূরা আয-যারিয়াতের ৪৭ নম্বর আয়াতে : ‘আমিই স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমি অবশ্যই এর মহাসম্প্রসারণকারী।’

বিগ ক্রাঞ্চ হাইপথেসিস অনুসারে বিগ ব্যাং এরপর একটা পর্যায়ে তা সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন আমি আসমানসমূহ গুটিয়ে নেব, যেভাবে গুটিয়ে রাখা হয় লিখিত দলিলপত্রাদি। যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। ওয়াদা পালন করা আমার কর্তব্য। আমি তা পালন করবই’। (সূরা আম্বিয়া-১০৪)। এ আয়াতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, আসমান-জমিন একসময় গুটানো অবস্থায় পরম ঘনচাপে ও তাপে একত্রে ছিল। পরে বর্তমান অবস্থানে চলে আসে। আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া হবে। কুরআনের সাথে বিজ্ঞানীদের বিগ ক্রাঞ্চ ধারণা পুরোপুরি মিলে যায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement
বান্দরবানে বৃষ্টির চেয়ে চোখের পানি ফেলে বিশেষ নামাজ চকরিয়ায় যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা, গ্রেফতার ৭ উপজেলা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্র ক্ষুণ্ন হবে: সিইসি বাগাতিপাড়ায় ইসতিসকার নামাজ পরিবর্তনশীল জলবায়ুর জন্য কাসাভা উপযুক্ত, হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫-৫০ টন : বাকৃবি অধ্যাপক বৃষ্টির জন্য হাকাকার, সাভারে ইসতিসকার নামাজ আদায় বরিশালে সালাতুল ইসতিসকার আদায় অর্ধ শতাব্দীতে ভ্যাকসিন সাড়ে ১৫ কোটি লোকের জীবন বাঁচিয়েছে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আল্লাহর রহমত কামনায় সকলকে সিজদাহ অবনত হতে হবে-মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন কাউখালীতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা ভাঙ্গায় বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

সকল