২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সারা জাঁহা ছে আচ্ছা হিন্দুস্তান আজ কিসকা?

সারা জাঁহা ছে আচ্ছা হিন্দুস্তান আজ কিসকা? - প্রতীকী ছবি

বর্ণ বিরোধ : তথ্যমতে, ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের বেদ শিক্ষা দিত। ফলে তারা পড়তে, বলতে বা শিখতে পারত, কিন্তু শিক্ষা দিতে পারত না। যদি করত তবে বিচারকের কাছে হাজির করে জিহ্বা কাটা হতো। কোনো ব্রাহ্মণ সিদ্ধি লাভ করলে বলা হতো ব্রহ্মর্ষি। কোনো ক্ষত্রিয় তা লাভ করলে বলা হতো রাজর্ষি। অন্য কোনো বর্ণ তা লাভ করতে পারত না। ধর্মীয় এই বিশেষিতকরণের কারণে সৃষ্ট বহু আত্মকলহ হয়েছে ভারতীয় ইতিহাসের খোরাক।

বিশেষজ্ঞদের ধারণায়, প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বে মধ্য এশিয়া হতে আর্যরা ভারতে অনুপ্রবেশ করে পূর্ব পাঞ্জাবে হরিয়ান রাজ্যের আম্বালা জেলার সরস্বতী ও ঘর্ঘারা নদীদ্বয়ের মধ্যস্থ ভূমিখণ্ডে সর্বপ্রথম উপনিবেশ গড়ে। ওই স্থানেই পরবর্তীকালে পঞ্চপাণ্ডবদের সাথে যুদ্ধ হওয়ায় এর নাম হয় কুরুক্ষেত্র। এর পূর্ববর্তী নাম ছিল ‘সমন্তপঞ্চক’, যার কারণীয় ব্যাখ্যা দিয়ে শ্রী সুধীর চন্দ্র সরকার তার ‘পৌরাণিক অভিধানের’ ৫৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘পঞ্চ-হ্রদ সমন্বিত ছিল বলে এর নাম সমন্তপঞ্চক। পরশুরাম (দেবতা বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার) ক্ষত্রিয়দের অত্যাচার দমন করার জন্য জন্ম। তাই একবিংশতিবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করে ক্ষত্রিয়দের রক্তে এই পাঁচটি হ্রদ সৃষ্টি করে সেই রক্তে পিতার তর্পণ (তৃপ্তি বা পিতৃযজ্ঞ) করেছিলেন।’

পাঞ্জাব হলো পঞ্চ নদের দেশ। এর শুধু বিতস্তা ব্যতীত অন্য চারটির নামকরণের (শতদ্রু, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিপাশা) ধর্মীয় কারণগত ব্যাখ্যা আছে পূর্বোল্লিখিত পৌরাণিক অভিধানে। এর একটি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় হয়ে কঠোর তপস্যায় ব্রাহ্মণত্ব লাভ করা বিশ্বমিত্র বিবাদরত হয়ে ঋষি (বেদমন্ত্র রচয়িতা) বশিষ্ঠের শত পুত্রকে বিনাশ করেন। তাই পুত্রশোকে কাতর হয়ে যে নদীতে বশিষ্ঠ প্রাণ ত্যাগের চেষ্টা করেন, সেই নদীই তার প্রাণ রক্ষা করলে তিনিই নাম দেন বিপাশা।’

পণ্ডিতগণের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮-৯ শত অব্দে অর্থাৎ আর্যরা ভারতে স্থায়ী আবাস গড়ার প্রায় ৬-৭ শত বছর পরে ঘটে পাণ্ডবদের সাথে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক বিরোধে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, যার পটভূমিকায় রচিত হয়েছে ‘মহাভারত’। এই যুদ্ধেই পঞ্চপাণ্ডবদের কাছে দুর্যোধনাদি, ধৃতরাষ্ট্রগণ এবং দাম্ভিক ক্ষত্রিয় সমাজেরও শোচনীয় অবসানের কথা বলা হয়েছে।

বর্ণ বিদ্রোহ ও নতুন ধর্মের প্রবর্তন : জৈন ধর্মের তীর্থংকর বা ধর্মগুরু মোট ২৪ জনের আদি ও প্রতিষ্ঠাতা ঋষভদেব এবং সর্বশেষ বর্ধমানা বা মহাবীরকে বলা হয়। তাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া ধর্মীয় একটি মতবাদ সুদীর্ঘকাল ভারতে চলে আসছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রায় ৫-৬ শত বছর পরে ব্রাহ্মণের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতে ঘটে ক্ষত্রিয়দের বিদ্রোহ। মহাবীর ও তার সমসাময়িক গৌতম বুদ্ধ উভয়ই ক্ষত্রিয় এবং বর্তমান নেপাল ও বিহার অঞ্চলের রাজপুত্র। এনসাইক্লোপিডিয়া মতে, এই বিদ্রোহের ডাক ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহাবীর।

micropaedia v-x, p-283 মতে, বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবের প্রাক্কালে প্রকাশ করা হয় বেদান্ত বা ব্রহ্মবিদরা বলেন, নীতিশাস্ত্রের ‘উপনিষদ’। এগুলো প্রধানত ক্ষত্রিয় রাজাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানপূর্ণ। ভারতবর্ষ নামকরণে জৈন ও হিন্দুদের পরস্পর বিরোধী দাবির সময় অজ্ঞাত থাকলেও কারণ ধর্মীয় বিরোধ। জীবহত্যা মহাপাপ মনে করা ও নিরামিষভোজী জৈন ধর্মগ্রন্থ ‘আয়ারাঙ্গ সুর্ত্ত’ প্রথমে লেখা হয়েছিল প্রাকৃত ভাষায় এবং বুদ্ধের ইচ্ছায় হিন্দুদের পবিত্র বেদ লেখা সংস্কৃতের পরিবর্তে বৌদ্ধদের ‘ত্রিপিটক’ পালি ভাষায় লেখা হয়। বেদ, পুনর্জন্মবাদ, বর্ণবাদ, ধর্মে শুধু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ইত্যাদি সমূলে অস্বীকার করেন বুদ্ধ।

তৎসত্ত্বেও তাকেই দেয়া হয় দেবতা বিষ্ণুর দশাবতারের মধ্যে নবম অবতার বলে স্বীকৃতি। তার প্রায় ২-৩ শত বছর পরে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ব্রহ্মার মানসপুত্র বলে বিবেচ্য মনু হিন্দু ধর্মের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলো, হিন্দু জাতির আচার, ব্যবহার ও ক্রিয়াকলাপের যথাকর্তব্য নির্ধারণ করে যে সংহিতা গ্রথিত করেন, তা-ই মনু সংহিতা নামে গৃহীত। এতে ব্রাহ্মণত্বের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘যে ব্রাহ্মণ অন্যের ভাড়ায় খাটে, খাটান বা শোষণ করেন তিনি শূদ্র বলে গণ্য হবেন। এমনকি একজন চণ্ডালও ব্রাহ্মণ হতে পারেন।’ উল্লেখ্য, পবিত্র বাইবেল ও কুরআনে দেয়া নূহ নবী আ:-এর বন্যার কাহিনীকে ভিন্নরূপে মনুর কথানুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ‘শতপথব্রাহ্মণ’ নামক হিন্দুদের গ্রন্থে। ওই একই বন্যার কিছু উল্লেখ গ্রিক কবি হোমারও (আ: ৮৫০ খ্রি:পূর্ব) আরেকরূপে করেছেন তার ওডিসি (Odyssey) নামক মহাকাব্যে।

জৈন ও বৌদ্ধ নির্যাতন : বহু রাজ্যে বিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, জৈন, বৌদ্ধ, শূদ্র, উপজাতি প্রভৃতি রাজ ও রাজ্যের মধ্যে ধর্মীয় ও বর্ণবাদী বিরোধ চলে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত। প্রায় রাজ্যের শাসন ক্ষমতা অর্জনপূর্বক হিন্দুদের নির্যাতনে জৈন ও বৌদ্ধরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রায় বাহাদুর ড. দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ বইটির ১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “অষ্টম শতাব্দীতে কুমারিলট্ট ‘বৌদ্ধ মাত্রেই বধ্য’ এই মত প্রচার করেন; কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়ের প্রতি হিন্দুদের যে কি ভীষণ আক্রোশ ছিল তাহা দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে বিশেষরূপে দৃষ্ট হইবে।” এই একই পৃষ্ঠায় এফ. কিংসবারির তামিল সৈভাইট (Saivite) সাধুর স্তব গানের উদ্ধৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘মাদুরার রাজা অষ্টম শতাব্দীতে কবি ও সাধু সম্বন্দরের সম্মতিক্রমে আট হাজার গোঁড়া জৈন পণ্ডিতকে শূলে চড়াইয়াছিলেন।

শঙ্কর বিজয়ে উল্লেখ আছে- রাজা সুধম্বা অসংখ্য জৈন ও বৌদ্ধ পণ্ডিতের মস্তক উলুখড়ে নিক্ষেপ করিয়া ঘোটনদণ্ডে নিষ্পেষণপূর্বক তাহাদের দুষ্টমত চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়েছিলেন।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান শ্রী অসিত কুমার বন্দ্যোপাধায় তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, প্রথম খণ্ড, পৃ-২০৪-এ লিখেছেন, “ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে, শঙ্করাচার্য ও কুমারিল ভট্টের প্রভাবে হিন্দু সমাজের পুনর্জাগৃতি আরম্ভ হইলে বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার্যগণ শিষ্য ও গ্রন্থ লইয়া ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়াছিলেন; যাহারা এ দেশ ত্যাগ করেন নাই, তাহারা কখনো ছদ্মবেশের অন্তরালে, কখনো হীন ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে আত্মগোপন করে ঐ শ্রেণীর বোধগম্য স্থূল রূপকের সাহায্যে স্বীয় ধর্মমতকে সযত্নে রক্ষা করিয়াছিলেন।” ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘গৌড়ের ইতিহাস’, ১ম খণ্ডের ১০৪ পৃষ্ঠায় শ্রী রজনীকান্ত চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানকালে হিন্দু পণ্ডিতেরা বৌদ্ধ দেবালয়গুলোকে নিজস্ব করিয়া লইয়াছিল।

বৌদ্ধ প্রতিমাগুলো অবিকৃতভাবে বা ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে আপনাদের উপাস্য দেবতা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন। বৌদ্ধোৎসবগুলো হিন্দু উৎসবে পরিণত হইয়া গিয়াছিল। রথযাত্রা, দীপালী ও ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পূর্বে বৌদ্ধোৎসব ছিল। উহা এই সময়ে হিন্দু-উৎসব হইয়া যায়।’ পরবর্তীকালে এ ব্যাপারে ড. নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালীর ইতিহাস (সংক্ষেপিত)’-এর ১২৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘দীপালী, রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ইত্যাদি আসলে এই আদিবাসীদেরই দান। আর্য, ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ উচ্চ কোটির লোকেরা সচল নৃত্যগীতসহ এই ধরনের লৌকিক ধর্মোৎসব তেমন সুনজরে দেখতেন না। অশোক এর বিরুদ্ধে অনুশাসন প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তা বন্ধ করা না যাওয়ায় বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ ক্রমে তা মেনে নিয়েছে।’


আরো সংবাদ



premium cement