২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বানভাসিদের প্রয়োজন একটু সহানুভূতি

বানভাসিদের প্রয়োজন একটু সহানুভূতি - ফাইল ছবি

‘মানুষ মানুষের জন্যে জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত গানের উপরিউক্ত কলিটি খুব বেশি করে মনে পড়ছিল যখন ত্রাণ পাওয়ার আশায় বানভাসি মানুষগুলোকে অথৈ পানিতে সাঁতার কেটে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলতে দেখলাম। অনেকের গলা সমান পানিতে সীমাহীন কষ্ট করে একটু ত্রাণের আশায় ছুটে আসার দৃশ্যটা চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছি না। অবর্ণনীয় দুর্দশাগ্রস্ত জীবন কাটিয়েছে বানভাসি মানুষ। তাদের দেখে মনে হয়েছে কত দিন, কত রাত বা কত যুগ তারা খেতে পায়নি। চোখগুলো ভেতরে চলে গেছে। না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। অনেকে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না।

এই তো কিছু দিন আগে তাদের সব ছিল। ধান, চাল, গরু, ছাগল ফসলাদি সবই ছিল। আজ তাদের কিছুই নেই। সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যায় মানুষ হয়তো ভেসে যায়নি তবে বন্যার পানি তাদের সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। যারা কোনোদিন অভাব দেখেনি আজ তারা খুবই অভাবী। যারা দু’হাত প্রশস্ত করে মানুষকে সাহায্য করত আজ তারাই সাহায্যপ্রার্থী। বন্যার পানিতে তাদের ঘরবাড়ি, হাড়ি-পাতিল, কাঁথা-বালিশ, কাপড়চোপড় সব গেছে। অনেকের পরনের কাপড় ছাড়া আর কোনো কাপড়ও নেই। এ দৃশ্য বন্যা উপদ্রুত সব জনপদের।

এবারের বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ওই অঞ্চলের মানুষ। কেবল সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাতেই ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। এর আগে প্রাক-বর্ষা মৌসুমে আকস্মিক বন্যায় একই অঞ্চলগুলো প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল। প্রায় ১২টির বেশি উপজেলা পানিতে তলিয়ে যায়। বিশাল জনপদ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ থাকায় টেলিযোগাযোগও প্রায় বন্ধ ছিল। রাস্তাঘাট পানির নিচে থাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগও। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার পরে এটিকে অঞ্চলগুলোর সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক বন্যা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায় । বেসামরিক প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনিবলে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড মোতায়েন করা হয়। বন্যাকবলিত অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রয়োজন সাহায্য।

সামান্য নয় অনেক বেশি সাহায্য। বিশুদ্ধ পানি নেই। চুলা নেই রান্না করে খাবার। চুলাই বা থাকবে কেমন করে যেখানে মানুষ থাকার জন্য এতটুকু মাটি নেই। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী এই দুর্দশার বর্ণনা দিতে পারবেন, টেলিভিশনের পর্দায় দেখে এর বিন্দু পরিমাণ অনুভব করা যাবে না।

এখানে কোনো রাজনীতি নেই, মানুষের জীবন বাঁচানোই একমাত্র কর্তব্য। কিন্তু কী আশ্চর্য! একদিকে বন্যাদুর্গত মানুষের বুকফাঁটা কান্না অন্যদিকে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলে উৎসব। মনে হয়েছে এই অসহায় মানুষগুলোর প্রতি সরকারের কোনো দায় নেই। পদ্মা সেতু দেশের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সেতুর চেয়ে কি মানুষের জীবনের মূল্য নেহায়েত কম? পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে শত শত টয়লেট নির্মাণ, হাজার হাজার বোতল পানিসহ খাদ্যের প্যাকেট, কোটি কোটি টাকার সাজসজ্জা মনে হচ্ছিল বানভাসি মানুষেদের সাথে চরম প্রহসন। বিষয়টি এমন হয়েছিল, ‘রোম শহর যখন পুড়ছিল আর নিরু বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’। ঠিক তেমনই একদিকে বানভাসি মানুষের দুঃখ দুর্দশার অর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। অন্যদিকে লাল-নীল আলোয় আনন্দ-উল্লাসে পদ্মার এপাড়-ওপাড় মাতোয়ারা ছিল।

গান-বাজনা সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সংসদ তো আর গান বাজনার জায়গা নয়। জনগণ সংসদ সদস্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায় জনকল্যাণমূলক আইন তৈরি করার জন্য। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করে সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সংসদে এখন গান-বাজনার আসর বসে। করতালি দিয়ে গায়িকাকে প্রশংসার সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সর্বোচ্চ মহলের প্রশংসা পেয়ে সংসদ সদস্যদের বক্তব্য পূর্ণ থাকে নানা স্তব, স্তুতি আর স্মৃতিচারণে অথচ অধিবেশন চলা অবস্থায় সংসদের প্রতি মিনিটে খরচ হয় এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা। অন্যদিকে যারা ভোট দিয়ে এমপি বানিয়ে সংসদে পাঠায় তারা বন্যার পানিতে ভেসে গেলেও তাদের জন্য নামকাওয়াস্তে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে। এখানে হিসাব করা হয় কড়ায়গণ্ডায়।

গত ১ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের টিম গিয়েছিল সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য। সেই টিমের সাথে আমিও ছিলাম। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। ট্রলারযোগে প্রায় দুই ঘণ্টা পানিপথ পাড়ি দিয়ে সুনামগঞ্জ সদরের মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ‘দেখার হাওরের’ বিভিন্ন জায়গায় খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। পানির গভীরতা না মাপতে পারলেও অনুমান করেছিলাম এর গভীরতা ১০ ফুটের নিচে নয়। মানুষ সাঁতার কেটে আসছিল ত্রাণ নিতে। তাদের ভাষ্যমতে, তখনো পর্যন্ত তারা কোনো সরকারি সাহায্য পায়নি। কী খেয়ে তারা বেঁচে আছে? জিজ্ঞাসা করতেই অনেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠছিল। খাবার তো দূরে থাক বিশুদ্ধ পানি পর্যন্ত তারা পাচ্ছে না।

একজন বৃদ্ধা কান্নারত অবস্থায় বলছিলেন, এভাবে আর কয়দিন না খেয়ে থাকলে তাদের মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না। সেখানেই দেখেছিলাম এক প্যাকেট খাবারের জন্য কত জনের কাড়াকাড়ি। ক্ষুধার যন্ত্রণা যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তা প্রত্যক্ষ করার সাথে সাথে আমার বেদনার্ত হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বুভুক্ষু মানুষের করুণ চিত্র ইতিহাসের যে পাতায় লিপিবদ্ধ তা আমার চোখের সামনে হাজির হয়ে গেল। বিনিময়ে চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না। সেখান থেকে আবার ছুটে গেলাম মনপুরা ইউনিয়নের জয়নগরের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানেও একই অবস্থা।

বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তই বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেটা খুব বেশি নয়। এ ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে নির্মোহ জায়গায় থেকে জনগণের পাশে এসে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্র যে ত্রাণ পাঠাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। সংসদকে গান আর কবিতার আসর না বানিয়ে, টাকা অপচয় না করে ওই টাকা দিয়ে দুর্দিনে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে কোটি কোটি টাকা খরচ না করে সেই টাকাও বন্যার্তদের দেয়া উচিত ছিল। কারণ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বন্যাকবলিত এলাকায় শুধু খাদ্য আর পানির সঙ্কটই নয়; বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে এলাকায় দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি পানিবাহিত রোগ। কাজেই জরুরি ভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগে দুর্গত এলাকায় খাদ্য, পানীয় জল ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে বহু মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

দেশের লাখ লাখ মানুষ বন্যার পানিতে ভাসলেও তা নিয়ে কোনো বক্তব্য না দিয়ে ব্যক্তির স্তুতি গেয়ে গান পরিবেশন করে যারা সর্বোচ্চ ব্যক্তির আনুক‚ল্য পাওয়ার চেষ্টা করে তাদের সংসদ সদস্য হওয়ার আদৌ কোন যোগ্যতা আছে কি না সেটি একটি প্রশ্ন। হয়তো এ কারণেই প্রফেসর লেকি গণতন্ত্রের সবচেয়ে খারাপ দোষ সম্পর্কে নিম্নোক্ত উক্তিটি করেছেন। তিনি বলেছেন, Democracy is a government by the poorest, the most ignorant, the most incapable, who are necessarily the most numberous.’ জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে লেকির মন্তব্য যদি এই হয় তাহলে যারা বিনা ভোটে কিংবা দিনের ভোট রাতে করে, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে সরকার গঠন করেছে সেখানে কোন ধরনের ব্যক্তি সংসদে এমপি হয়ে এসেছেন তা অনুমান করা খুব বেশি কষ্টের কাজ নয়। কাজেই তাদের মুখে জনগণের কথা নয়; নিজের আখের গুছানোর জন্য যা প্রয়োজন তাই করবে এটিই স্বাভাবিক।

পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, ‘জনগণের জন্য সরকার, সরকারের জন্য জনগণ নয়’। এই উপলব্ধিবোধ নিয়েই একটি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা করা উচিত। জনগণের বিপদে মশকরা নয়; সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে গেলে বিরাট বিপদ থেকে জনগণ বেঁচে যাবে। জনগণ বেঁচে গেলে তারাই ভোট দিয়ে আপনাদের আবারো এমপি-মন্ত্রী বানাতে পারবে। সিয়াসিত্তাহ, বুখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ, আবু দাউদ শরিফ পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেছেন কিন্তু বাস্তবে তার কিছু জানেনও না আবার পালন করেন এমন দৃষ্টান্তও নেই। আপনাদের সম্পর্কে জনগণ অবহিত। কাজেই বলব সংসদে অহেতুক কথা না বানভাসিদের পাশে এসে দাঁড়ান।
harun_980@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement