২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পদ্মা সেতু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা

পদ্মা সেতু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা - ফাইল ছবি

আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় কয়েক বছর মিরপুর কোটবাড়ি থাকতাম। সে সময় প্রতিদিন ঢাকা-আরিচা রুটের ‘মুড়ির টিন’খ্যাত বাসে চড়তাম। তখন ঢাকা শহরের সবগুলো বাস রুটে, উঠার কোনো নিয়ম কানুন ছিল না। ভিড়ের ভেতর ঠেলাঠেলি করে বাসে চড়তে হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে আমি সিঙ্গাপুরের জাতীয় শিপিং কোম্পানি নেপচুন ওরিয়েন্ট লাইন্সে (এনওএল) কর্মজীবন শুরু করি। চাকরির সুবাদে ১৯৯৬ সালে প্রথম সিঙ্গাপুর সফর করি। সিঙ্গাপুর গিয়ে ওখানকার নিয়ম কানুন, শহরের পরিষ্কার পরিছন্নতা দেখে খানিকটা বিস্মিত হই। সবাই লাইন দিয়ে টেক্সি, বাস ও ট্রেনে উঠছে। চলাফেরা, সব কিছুতেই অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য। বয়স্ক বা শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-সম্মান দেখে মুগ্ধ হই।

ঠিক তখনই আমার মানসপটে ভেসে ওঠে ঢাকার গণপরিবহনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কঠিন চিত্র। তখন মনে হচ্ছিল, আমাদের দেশের মানুষ কেন নিয়ম কানুন মানে না বা মানতে চায় না। দেশের মানুষ সম্পর্কে আমার এ ধারণা ভুল ছিল! ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ঢাকা শহরে চালু হলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রিমিয়াম বাস সার্ভিস, তখন ঢাকা শহরে বাসে চড়ার দৃশ্যপট পাল্টে গেল। এসব বাসের সব যাত্রী দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করে সুশৃঙ্খলভাবে বাসে উঠে আসন গ্রহণ করছে। পরবর্তীতে বেশির ভাগ পরিবহন এ নিয়মে বাস পরিচালনা শুরু করে। অর্থাৎ আমরাও ইচ্ছে করলে বাংলাদেশে সিঙ্গাপুরের মতো নিয়ম কানুন আরোপ করে বাস্তবায়ন করতে পারি।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কঠোর উদাহরণ দিতে চাই, ঢাকা শহরের প্রত্যেক গাড়ির চালক যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর প্রবেশ করে তখন শতভাগ নিয়ম কানুন মেনে গাড়ি চালায়, অথচ সেই চালকই যখন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে গাড়ি চালায় তখন নিয়ম কানুনের কোনো তোয়াক্কা করে না। কারণ সে জানে, এখানে অনিয়ম করে ধরা পড়লে হয়তো কিছু আর্থিক জরিমানা হবে, তবে কোনো শারীরিক বা কঠোর শাস্তি নেই। সুতরাং কিছু ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রয়োগ সুশৃঙ্খল পরিবেশের জন্য সহায়ক।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে, পদ্মা সেতু নিয়ে এদেশের মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। মেঘনা, গোমতী, যমুনার পর পদ্মাতে সেতু হবে, বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নতুন মাত্রা পাবে- এ স্বপ্ন বাংলাদেশী প্রতিটি মানুষের। সেতুর সফল উদ্বোধন নিয়ে দীর্ঘ সময় কমিটি অসংখ্য মিটিং করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ জুন ২০২২ উদ্বোধনী পর্ব চমৎকারভাবে সম্পন্ন করেছে।

অথচ দুঃখের বিষয়- সেতু যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর কিভাবে সেতুটি পরিচালিত হবে, যানবাহনের লেন, টোলপ্লাজার সক্ষমতা, সেতুর উপর প্রশাসনিক নজরদারি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে খুব বেশি অলোকপাত করা হয়েছে বলে মনে হয় না। সেতু বিভাগের আচরণে মনে হয়েছে সফল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, প্রচার প্রচারণা ও সেতু নির্মাণের মহত্ব-কৃতিত্ব নিয়েই সবাই ব্যস্ত। দেশের সাধারণ নাগরিকের অর্থে সেতু নির্মাণ করেছে সরকার, এটি তাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করে মহত্ব দেখানোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেতু ব্যবহারকারী নাগরিকদের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করা।

২৬ জুন ২০২২ সকাল ৬টায় সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। টোলপ্লাজার সামনে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট ও চরম বিশৃঙ্খলা। সেতুর উপর সাধারণ মানুষ গাড়ি রেখে সেলফি তোলা, টিকটক ভিডিও, দৃষ্টিকটু কর্মকাণ্ড, নিয়ন্ত্রণহীন মোটর সাইকেল চালাতে গিয়ে দু’জনের মৃত্যু, কে প্রথম সেতুতে কী করল তা প্রচার- ইত্যাদি মিলে সেতু পরিণত হয় আলোচনা-সমালোচনার বিষয়ে। অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এগুলো করতে উৎসাহিত করেছে। অন্যথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় এসব বাড়তি ঝামেলা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

বেগতিক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ২৭ জুন থেকে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য সেতুর উপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করতে বাধ্য হয়। মোটরসাইকেল ফেরি দিয়ে পদ্মা নদী পার হতে নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানেও বিপত্তি, সময়মতো ফেরি না পাওয়া বা পর্যাপ্ত ফেরির ব্যবস্থা না থাকায় মোটরসাইকেলের যাত্রীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। মাওয়া-জাজিরা রুটে চলাচল করা যাত্রীরা ফেরিঘাটের অনিয়ম নিয়ে এমনিতেই অতিষ্ঠ। একজন যাত্রী হিসেবে বলতে পারি, সাধারণ মানুষের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা এসব সমস্যার মূল কারণ। অন্যথায় ফেরি পারাপারে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।

কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা বা ব্যর্থতার জন্য কোনো শাস্তি বা জবাবদিহিতা নেই। এখানেও চলছে দলীয় নিয়োগ ও লেজুড়বৃত্ত রাজনীতি। তাই সবাই ইচ্ছে ঘুড়ির মতো চাকরি করছে, কোনো নিয়ম কানুনকে পাত্তা দিচ্ছে না।

ভাবতে অবাক লাগে, ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে সেতু ব্যবস্থাপনায় অ্যানালগ পদ্ধতি প্রযোগ করে আমরা প্রথমেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। সেতু ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছি। আবার কর্তৃপক্ষ মুলা ঝুলাচ্ছে, অটোমেটিক টোল চালু হলে টোলপ্লাজার ভোগান্তি কমবে। প্রশ্ন হচ্ছে, টোলপ্লাজা তৈরি হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে, তাহলে এসব উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সবগুলো বুথ উদ্বোধনের দিন চালু করলে সমস্যা কোথায় ছিল? প্রাইভেট গাড়ি, বাস, ট্রাক, লরি-কার্গো এগুলোর জন্য টোল বুথ পৃথকীকরণ খুবই জরুরি, সেটি কেন গুরুত্বসহ চালু করা হয়নি?

ফেরিতে দেখেছি ভিআইপি যাত্রীদের কোনো সমস্যা নেই, এমনকি সেতুও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সেতু হোক বা ফেরি হোক তাদের যাতায়াতের জন্য সব কিছু অবারিত ও সব কিছু প্রস্তুত। দুর্ভাগ্য সাধারণ মানুষের, যাদের টাকায় দেশ চলে তাদের প্রতি সর্বত্র চলছে চরম অবহেলা। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত হাইওয়ের টোলপ্লাজা, পদ্মা সেতু টোলপ্লাজার সমস্ত অসঙ্গতি দূর করে সাধারণ যাত্রীদের ঈদের ছুটি বা বাড়ি ফেরা নির্বিঘ্ন হোক, সেটিই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : পরিবেশকর্মী
ইমেইল : farid.dac@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement