২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসরাইলে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট

ইসরাইলে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট। - ছবি : সংগৃহীত

বিতর্কিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলে অল্প সময়ের ব্যবধানে ৫ম বারের মতো জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। অবৈধ দেশটির ৪ দলীয় জোটের প্রধান ও কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগেই নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হলো। ইবরানি মিডিয়ার ভাষ্য মতে, এই সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন ইয়েরা লাপিদ।

ইসরাইলের নির্বাচনি কাহিনী বেশ আকর্ষণীয়! এর আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রায় ১৫ বছর দেশটি শাসন করেছেন। কট্টোর ডানপন্থী ইহুদিদের সাথে গভীরভাবে ঘনিষ্ট নেতানিয়াহু প্রথমবার ১৯৯৬-১৯৯৯ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ২০০৯ সাল থেকে দ্বিতীয় বারের মতো তিন মেয়াদে একাধারে ১২ বছর নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মাধ্যমে ইসরাইলের ৭৪ বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিয়নের রেকর্ডও ভেঙে যায়। নেতানিয়াহুর শাসনামলে ইসরাইল বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সফলতা লাভ করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর যেসব আফ্রিকান রাষ্ট্র তার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, নেতানিয়াহুর সময় তারা পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

আরব দেশ বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুদান ও মরক্কোর সাথেও ইসরাইল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, ইসরাইলি পার্লামেন্টে মোট আসন ১২০টি। ক্ষমতায় আসতে কমপক্ষে ৬১ আসনে বিজয় আবশ্যক। ২০১৯ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নেতানিয়াহুর দল ‘লিকুদ পার্টি’ এবং সাবেক সেনাপ্রধান বেনি গান্টজের দল ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ ৩৫টি করে সমান-সমান আসনে জয়লাভ করলেও নেতানিয়াহু নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। ধারণা করা হচ্ছিল, নেতানিয়াহু ডানপন্থী ছোট দলের সাথে জোটবন্ধ হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সরকার গঠন করবেন। কিন্তু উল্টো তাকে ৫ মাসের ভেতরেই বাধ্য হয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হয়।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে নেতানিয়াহুর জোটের সাথে সাবেক সেনাপ্রধান বেনি গান্টজের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। দ্বিতীয় এই নির্বাচনে গান্টজের ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ দল ৩৩টি আসন লাভ করে। অপরদিকে নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোট লাভ করে ৩২টি আসন। তবে উভয় জোটই নির্বাচনের পর সরকার গঠনের ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়। এমনকি ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নেও উভয় জোট কোনো প্রকার সমঝোতায় পৌঁছতেও সক্ষম হয় না। ফলে ডেট লাইনের ভেতরে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গড়তে বিফল হয় দুই জোটই। এরপর এক বছরের ভেতর তৃতীয়বারের মতো ইসরাইলে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়।

২০২১ সালের মার্চ মাসে ইসরাইলে তৃতীয়বারের মতো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও কোনো দল-জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। কোনো দল ৬১ আসন জিততে পারে না। কিন্তু এবার নেতানিয়াহু তার বিরোধী পক্ষ ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াটসের’ সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ঐকমত্যের সরকার গঠনে সফল হয়। উভয় পক্ষের সমঝোতা চুক্তি ছিল ৩ বছরের। চুক্তি ছিল, ২০২১ সালের আক্টোবর পর্যন্ত নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বেনি গান্টজ।

এসব চুক্তি সত্ত্বেও ওই বছর জাতীয় বাজেট পাশের সময় উভয় জোটের ভেতর ব্যাপক মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। উভয় জোট একে-অপরের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করে। বিরোধের সূত্রপাত ছিল, ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াটস’ দলের প্রধান বেনি কান্টজ নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে ২০২০ ও ২০২১ উভয় অর্থবছরের বাজেট একসাথে পাস করার দাবি তুলেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, ইসরাইলের শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা। কিন্তু নেতানিয়াহু ২০২১ অর্থবছরের বাজের পাস করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে উল্টো অভিযোগ করেন, ‘২০২১ সালের বাজেট পাশের দাবি মূলত দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র! সাবেক সেনাপ্রধান আমাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়!’ নেতানিয়াহুর এমন বক্তব্যের পর থেকেই সেখানে গভীর রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়। ফলে এই মার্চেই ‘দেশ’টিতে দুই বছরের মধ্যে চতুর্থবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ এই নির্বাচনে নেতানিয়াহুর দল ‘লিকুদ পার্টি’ সবচয়ে বেশি ৩০ আসন লাভ করলেও সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়নি।

স্মরণ রাখা দরকার, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তার স্ত্রী সারা নেতানিয়াহু ইসরাইলের মানুষের কাছে একজন উচ্ছৃংখল, উচ্চভিলাসী ও অপব্যয়ী ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে পরিচিত। সারা নেতানিয়াহু আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল অর্থ অবৈধভাবে ব্যবহার করেছে। তাছাড়া সারার বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতনের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে।

২০২১ সালে ইসরায়েলের ৮টি দল নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে না দেখতে নিজেদের ভেতর জোট বাধে। এই ৮টি দল নির্বাচনে বিজয়ী হলে সরকারে অংশীদার হওয়ার চুক্তিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়। অংশীদার সরকারের লক্ষ্যে চুক্তি হয় ইয়েরা লাপিদ ও ‘ইয়ামিনা’ দলের প্রধান নাতফালি বেনেতের মাঝে।

২০২১ সালের জুন মাসে এই ৮ দলীয় জোট গঠনের সবচেয়ে বড় খবর ছিল, জোটে আরব দলের অন্তর্ভুক্তি। মানুসর আব্বাসের নেতৃত্বাধীন আরব দল ‘ইউনাইটেড আরব লিস্ট’ জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সরকার গঠনে অংশীদার হতে সম্মত হয়। এরপরও মানসুর আব্বাসের দল এবং আরো কিছু দলের বিরোধিতার কারণে ৭ জুন ইসরাইল সরকার পশ্চিমতীর জুড়ে ‘ইমার্জেন্সি আইন’ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। এর ফলে ইসরাইলের ৪ লাখ ৭৫ হাজার ইহুদি বাসিন্দা ওই নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রদান থেকে বঞ্চিত হয়। ইসরাইলের জন্য এটা ছিল অনেক বড় ধাক্কা। ফলে ৮ দলীয় জোটবদ্ধ সরকারের ভেতর মতপার্থক্য শুরু হয়। ফলে দেশটির ৩৬তম সরকার মাত্র কয়েকদিনের মাথায় শেষ হতে বাধ্য হয়। শেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী অক্টোবরে সেখানে আবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা হবে ৪ বছরের মধ্যে ইসরাইলের ৫ম জাতীয় নির্বাচন!

-উর্দু থেকে আমিরুল ইসলাম লুকমানের অনুবাদ


আরো সংবাদ



premium cement