২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমাদের সোনার কিশোর-কিশোরী : একটি পোস্টমোর্টেম

আমাদের সোনার কিশোর-কিশোরী : একটি পোস্টমোর্টেম - ছবি : সংগ্রহ

আশরাফুল ইসলাম জিতুর বয়স স্কুলের নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশান অনুযায়ী ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি (কালের কন্ঠ, ২৮ জুন, ২০২২ )। শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের হত্যা মামলায় তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৬ বছর। বয়সটা এখানে কোনো ফ‍্যাক্টর না। ১৬ আর ১৯-এ বিশেষ তফাৎ নেই। তাকে সাজা দেয়াও এখানে কোনো ফ‍্যাক্টার না। এক জিতুর শাস্তি হোক বা না হোক, আরেক জিতু এসে হাজির হবে। সাপ্লাই চেইনের মতো জিতুরা আসতেই থাকবে। কারণ এই জিতুদের আমরাই নির্মাণ করেছি। নির্মাণ করেছি তিলতিল করে, খুব সূক্ষ্মভাবে। জিতুর বয়স যদি ধরেও নেই ১৯ বছর, তাকে বুঝমান হতে হতে অন্তত ১০ বছর সময় লেগেছে। অর্থাৎ ২০১৩ থেকে সে তার চারপাশটা দেখতে বুঝতে শেখার প্রক্রিয়ার মধ‍্যে দিয়ে গেছে। তো এই ২০১৩ থেকে ২০২২-এর মধ‍্যে সে কেমন বাংলাদেশ দেখেছে?

দেখেছে-
১. এখানে অন‍্যায় (রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি ) করলে অনায়াসে পার পাওয়া যায়। বরং প্রতিবাদ করলে উল্টা তাকেই আটক করা হয়।

২. চারদিকে ঘুষ, দুর্নীতির মতো কাজ করে গেলেও কারোর কিছুই হয় না।

৩.. এখানে অবলীলায় হত‍্যা করে সম্মান রাখা যায়, মুনিয়া হত‍্যা যার জ্বলজ‍্যান্ত সাম্প্রতিক ঘটনা।

৪. নারী ধর্ষণ কোনো ঘটনাই না। যে কেউ যেকোনো মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারে। এই ধরনের ধর্ষণে উল্টা মেয়েকেই দোষারোপ করা হয়।

৫. মানুষের সামনে মানুষকে হত‍্যা করা একেবারেই জায়েজ। সেই মা'র কথা মনে আছে ? যে তার পাঁচ বছরের শিশুকে স্কুলে ভর্তির জন‍্যে একটা স্কুলে গিয়েছিল আর তাকে নারীপাচার সন্দেহে সবাই মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল?

৬. শুধু দল বেঁধে হত‍্যা না, প্রকাশ‍্যে হত‍্যা করলেও, আশেপাশের মানুষেরা থ্রিলার মুভি দেখার মতো চেয়ে থাকে। একটা মানুষও এগিয়ে যায় না। বরং এই ধরনের হত‍্যালীলা মজা করে উপভোগ করে (ধর্ষকাম আর মর্ষকামীদের মতো)। একটা সমাজে যখন ভালো সিনেমা, নাটক, গান ইত্যাদির মতো বিনোদন থাকে না, টিকটকের মতো ফালতু বিনোদন থাকে, তখন এসব হত‍্যালীলাই বিনোদনের জায়গা দখল করে নেয়।

আমি জিতুকে একেবারেই দোষ দেবো না। কারণ ওকে আমরাই নির্মাণ করেছি। এখন সে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে আমাদের উপর চড়াও হয়েছে। আরও আরো জিতুরা আসবে আগামী দিনে। এখন জিতুদেরই সময়। জিতুদেরই জিত। এখানে শিক্ষক হত‍্যা বড় বিষয় নয়। হত‍্যাটাই মুখ‍্য। শিক্ষক উৎপল কুমারের জায়গায় অন‍্য যেকোনো ব‍্যক্তি হতে পারত। মূল বিষয় হত‍্যা এবং সবচেয়ে বড় বিষয় জনসম্মুখে হত‍্যার সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতি এখন খুন, লুণ্ঠন, চুরি, ধর্ষণ, হিংসা, প্রতিশোধ স্পৃহা, সীমাহীন লোড, অর্থ পাচার ইত্যাদির সংস্কৃতি। এইরকম সংস্কৃতিতে যেসব কিশোর-কিশোরীরা বড় হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে তারা তো তাদের সামনে রাখা এসব আইডল সংস্কৃতি নিয়েই বড় হবে। ছোট বয়সে শিশু তার চারপাশে যা দেখে, সেসব নিয়েই বড় হয়। জিতুও এসব নিয়ে বড় হয়েছে। জিতুকে শাস্তি দেয়ার আগে নিজেদের শাস্তির কথাটা আগে ভাবা দরকার। নিজেরা ঠিক না হলে কাউকেই ঠিক করা যায় না। জিতুদেরকেও আমরা ঠিক করতে পারব না।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব


আরো সংবাদ



premium cement