২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নবী অবমাননাকারীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ

মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে ভারতে বিক্ষোভ। - ছবি : সংগৃহীত

শাতিমে রাসূল (সা:) অর্থাৎ নবীর কুৎসা রটনাকারী নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে মুসলমানদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। গত ১০ জুন শুক্রবার জুমার নামাজের পর মুসলমানরা কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার নজির দেখা যায়নি। মুসলমানরা কোনো আহ্বান ছাড়াই দেশব্যাপী নবী অবমাননাকারীর শাস্তি দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। তারা এটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা সব কিছুই মেনে নিতে পারবে, কিন্তু পেয়ারা নবীর অবমাননা তারা মেনে নিতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডে প্রতিবাদের সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষও ঘটে। ঝাড়খণ্ডে পুলিশের গুলিতে অন্তত একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একদিকে দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, অন্য দিকে রাজনৈতিক নেতারা তাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা বেশ কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

মুসলমানদের ক্ষতবিক্ষত অনুভূতিতে মলম দেয়ার জন্য সরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। কষ্টের বিষয় হচ্ছে- পরিস্থিতির এত অবনতি হওয়া সত্ত্বেও বিজেপির লোকেরা নূপুর শর্মার পক্ষেই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় টাটকা বক্তব্য এসেছে মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণের অপরাধী ও ভুপাল আসনের পার্লামেন্ট সদস্য সাধ্বী প্রজ্ঞার। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, যদি সত্য বলা বিদ্রোহ হয়, তাহলে তিনিও বিদ্রোহী। সব আশ্বাস প্রদান সত্ত্বেও বিজেপি সরকার ইসলামের নবীর অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখছে। সম্ভবত তারা দলের নেতাদের বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। বিজেপি তার সদস্যদের যে ভিত্তিতে গড়ে তুলেছে, সেখানে নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালের মতো লোকেরা এর জন্য আদর্শ সদস্যের মর্যাদা রাখে। এ কারণেই অভ্যন্তরীণভাবে নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দাল দলে সমর্থন পাচ্ছে। নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালের প্রগলভতার ফলে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ঝুঁকিতে পড়েছে। দেশের কূটনৈতিক শাখাগুলো পুরোপুরি মাটির সাথে মিশে গেছে। সরকার এটি দূর করার পরিবর্তে তালিপট্টি দিয়ে কাজ চালাতে চাচ্ছে। বিজেপি রাজনৈতিক হীনস্বার্থের জন্য বিদ্বেষের যে বীজ বপন করেছিল, আজ সেটি ফলবান বৃক্ষরূপে সবার সামনে বিদ্যমান। বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সা: ও হজরত আয়েশা রা:-এর বিরুদ্ধে দেয়া বক্তব্যের ইস্যুটি এতটাই ব্যাপকতা লাভ করবে, এটি কেউই ভাবেনি। কিন্তু কানপুরের মুসলমানরা, অতঃপর কাতারের গ্রান্ড মুফতি এ ব্যাপারে এমন এক আন্দোলনের রূপ দেন, যার ফলে সারা পৃথিবীর মুসলমান এক হয়ে যায়। তারা এককণ্ঠ হয়ে এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। ৩ জুন জুমায় কানপুরে মুসলমানদের কঠোর প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পরের জুমাতেও সমগ্র ভারতে মুসলমানরা সর্বাত্মক প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। অথচ মুসলমান নেতারা ও উলামায়ে কেরাম এ ধরনের যেকোনো প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু এ সময় মুসলমানদের অনুভূতি ও আবেগ এতটাই ক্ষতবিক্ষত যে, তারা তাদের উলামায়ে কেরাম ও নেতাদের কথা শুনতেও প্রস্তুত নয়। বিশ্ব জানে, মুসলমান সব কিছু সইতে পারে, কিন্তু তারা তাদের পেয়ারা নবীর অবমাননা মেনে নিতে পারে না। নবীর ভালোবাসায় মুসলমান নিজের জীবন কোরবান করতেও দ্বিধা করে না। ইতিহাস এমন ঘটনাবলিতে ভরে আছে।

এই প্রতিবাদ দেখে হল্যান্ড ও ফ্রান্সের অবমাননাকর কার্টুনের বিরুদ্ধে হওয়া প্রতিবাদের স্মৃতি জেগে উঠল। কয়েকটি আরব রাষ্ট্র ভারতের রাষ্ট্রদূতদের তলব করে নিজেদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ সম্পর্কে তাদের সতর্ক করেছে। আরব ও মুসলমানদের ৫২টি রাষ্ট্রের সংগঠন ওআইসি ভারতকে এ কথা নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দেয় যে, এখন পানি মাথা থেকে উঁচু হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ভারত এখানকার সংখ্যালঘুদের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ও হুমকিকে কেন্দ্র করে ওআইসির প্রতিবাদকে অভ্যন্তরীণ বিষয় অভিহিত করে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। এবারো মোদি সরকার এমনটাই করেছে এবং ওআইসিকে সঙ্কীর্ণমনা সংগঠন অভিহিত করে তার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু নবী অবমাননার বিষয়টি এমন যে, এতে জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত মুখ খুলেছে এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিস্তারকারীদের বিপক্ষে সরকারকে সতর্ক করেছে। মুসলিম দেশগুলোর তীব্র প্রতিবাদের পর দিল্লি পুলিশ নড়েচড়ে ওঠে। তারা নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালের বিরুদ্ধে এফআইআর লিপিবদ্ধ করে বটে, তবে বিষয়টিকে সমান পাল্লা করার জন্য এমআইএম প্রধান ব্যারিস্টার আসাদুদ্দিন ওয়াইসি, সাংবাদিক সাবা নাকবিসহ আরো ৩২ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মামলা করে। এদের মধ্যে কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী সাধু যতী নরসিংহানন্দের নামও রয়েছে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগারে লিপ্ত রয়েছেন। এই নরসিংহানন্দও অনেক দিন আগে দিল্লিতে এক প্রেস কনফারেন্সে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অবমাননা করেছিলেন। এই নরসিংহানন্দের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি হরিদ্বারের ধর্মসংসদে প্রকাশ্যে মুসলমানদের গণহত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। সেখানে মারামারির কথা হয়েছিল। তখনো পুলিশ কোনো তৎপরতা দেখায়নি। ওই ব্যাপারে যদি সাংবাদিক কুরবান আলী সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া না নাড়তেন, তাহলে যতী নরসিংহানন্দের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো না। সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার পরই পুলিশ তৎপর হয় ও তাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। অথচ মুসলিম দেশগুলোকে এ আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, সরকার নবী অবমাননার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

বিজেপি সরকার বিশ্বকে এ আশ্বাস দেয়ার চেষ্টা করছে যে, যারা নবী অবমাননার অপরাধ করেছে, তারা মূলধারার অংশ নয়। বরং তারা বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠীর মানুষ।’ যদি বিজেপি সরকারের এই বক্তব্য নিয়ে আপনি ভাবেন, তাহলে এতে আপনি স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখতে পাবেন। এ বাস্তবতাকে কে অস্বীকার করতে পারবে যে, বিজেপির পুরো রাজনৈতিক স্থাপনাই মুসলিমবিদ্বেষের ওপর দাঁড়িয়ে আছে? তাদের নেতারা প্রকাশ্যে নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে হিন্দুদের ভোট অর্জন করেন। উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে আপনি দেখে থাকবেন, পশ্চিম ইউপির জাটদের অনুগত করার জন্য স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোন ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনারা যদি বিজেপিকে ভোট না দেন, তাহলে আজম খাঁ, মুখতার আনসারি, আতিক আহমদ ও নাহিদ হাসান আবার ক্ষমতায় চলে আসবে। এখানেই শেষ নয়, ২০২০ সালে দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে তিনি ভোটারদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, তারা বিজেপির পক্ষে এতটাই শক্তি দিয়ে ইভিএমের বোতাম চাপ দেয় যেন, তার বিদ্যুৎ শাহিনবাগ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কবরস্থান ও শ্মশান-বিষয়ক বক্তব্য কার মনে নেই, যা তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে দিয়েছিলেন? তিনি এ কথাও বলেছিলেন, আমরা বিশৃঙ্খলাকারীদের তাদের কাপড় দেখে চিনে নিই। এ কথা কারো কাছে গোপন নেই যে, বিজেপির পুরো রাজনীতিটাই মুসলমানদের কোণঠাসা করার কাহিনীতে ভরপুর। নতুবা এর কী কারণ আছে যে, পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে তার একজনও মুসলমান সদস্য নেই? শুধু তাই নয়, ভারতের ৩১টি প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে তার কোনো মুসলমান বিধায়ক নেই। এতদসত্ত্বেও বিজেপি ‘সব কা সাথ আওর সব কা বিকাশ- সবার সাথে সবাইকে সাথে নিয়ে, সবার উন্নয়ন’-এর কথা বলে। বাস্তবতা হলো, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাস্তবায়নকারী বিশ্বের সবচেয়ে বড় দলটিতে দেশের ২০ কোটি মুসলমান অর্থাৎ ১৫ শতাংশ জনগণের কোনো স্থান নেই। এতদসত্ত্বেও বিজেপি যদি আজ বিশ্বের সামনে এ কথা বলে যে, তারা সব ধর্মকে সম্মান করে, তাহলে এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না।

ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত ভারতে সংখ্যালঘু বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি যে জুলুম-নির্যাতন হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে সাধারণত মুসলিম দেশগুলো মুখ খোলা থেকে দূরে থেকেছে। এটাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আরব জনগণের মাঝে গত আট বছর ধরে যে লাভা ঘুরপাক খাচ্ছিল, তা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়েছে। সেখানকার সরকারগুলো রীতিমতো প্রতিবাদের রাস্তা অবলম্বন করেছে। কেননা, এ বিষয়টি শুধু সংখ্যালঘুদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নয়, বরং এর সম্পর্ক মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির সাথে, তাও আবার নবী অবমাননা সম্পর্কিত। বিশ্ব জানে, মুসলমান সব কিছু মেনে নিতে পারে, কিন্তু তারা নিজেদের পেয়ারা রাসূলের অবমাননা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। আবারো বিশ^পরিমণ্ডলে মুসলমানরা এ কথা প্রমাণ করে দেখাল যে, তারা পেয়ারা নবী সা:-এর প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে, সারা পৃথিবীতে তার কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ নেই।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ হতে ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
সৌরশক্তি খাতে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় জার্মানি ‘সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি’ মোদি কি হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের চেনা রাজনীতিতে ফিরছেন? টাঙ্গাইলে বৃষ্টির জন্য ইসতেসকার নামাজ ফুলগাজীতে ছাদ থেকে পড়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু দোয়ারাবাজারে শিশু হত্যা মামলার আসামিসহ গ্রেফতার ২ কাউখালীতে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু চুয়েট শিক্ষার্থীদের সড়কে অবস্থান অব্যাহত, ঘাতক বাসচালক গ্রেফতার তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের দাবিতে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে ২৫ সংসদ সদস্যের চিঠি প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীতে মহিষের আক্রমণে বাবা-ছেলেসহ আহত ৪ গফরগাঁওয়ে গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

সকল