১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারত একটি ফ্যাসিবাদী এন্টারপ্রাইজে পরিণত হচ্ছে

ভারত একটি ফ্যাসিবাদী এন্টারপ্রাইজে পরিণত হচ্ছে - প্রতীকী ছবি

গত কয়েক মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত ভারতের রাজ্যগুলোতে কর্তৃপক্ষ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়ার সন্দেহে মুসলমানদের বাড়ি, দোকান ও ব্যবসার স্থানগুলোতে বুলডোজার চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় এই নীতি গর্ব ও অহঙ্কারের সাথে জাহির করছেন।

আমার মনে হয়, এটি সেই মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করে যখন একটি গভীর ত্রুটিপূর্ণ ভঙ্গুর গণতন্ত্র রূপান্তরিত হয়েছে- প্রকাশ্যে এবং নির্লজ্জভাবে অসাধারণ জনপ্রিয় সমর্থনসহ একটি অপরাধী হিন্দু ফ্যাসিবাদী উদ্যোগে। এখন মনে হচ্ছে, আমরা হিন্দু গুণ্ডাদের দিয়ে শাসিত হচ্ছি। তাদের বইতে মুসলমানরা জনগণের ‘এক নম্বর’ শত্রু।

অতীতে মুসলমানদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে নির্যাতন, নির্বিচারে হত্যা, টার্গেটেড খুন, কারাগারে বা সরকারি হেফাজতে খুন, ভুয়া পুলিশ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও মিথ্যা অজুহাতে কারাগারে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া এই তালিকায় যোগ করা একটি নতুন এবং অত্যন্ত কার্যকর অস্ত্র। যে উপায়ে এ ঘটনাটি রিপোর্ট করা হচ্ছে এবং লেখা হচ্ছে, বুলডোজারটিকে একধরনের ঐশ্বরিকভাবে বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রটিকে তার বিশাল ধাতব নখর দিয়ে শত্রুদের ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটাকে এখন পৌরাণিক অসুরবধের একটি যান্ত্রিক কমিক হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। এটা নতুন, প্রতিশোধমূলক হিন্দু জাতির তাবিজ হয়ে গেছে।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় একজনের পাশে পোজ দিয়েছেন। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, তিনি ঠিক কী করছেন এবং তিনি কাকে সমর্থন করছেন তা তিনি জানেন না। কেন একজন রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রীয় সফরের সময় বুলডোজার দিয়ে জাহির করার মতো উদ্ভট কিছু করবেন?

তাদের পক্ষ থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলে যে, তারা মুসলমানদের টার্গেট করছে না এবং কেবল অবৈধভাবে নির্মিত সম্পত্তি ভেঙে ফেলছে। একধরনের মিউনিসিপ্যাল ক্লিন-আপ মিশন। যে যুক্তি অবশ্যই এমনকি বিশ্বাসযোগ্য হতে বুঝানো হয় না, এটা উপহাস হিসেবে বুঝানো হয় ও সন্ত্রাস জাগানো, কর্তৃপক্ষ এবং বেশির ভাগ ভারতীয় জানেন যে, প্রতিটি ভারতীয় শহর ও শহরের বেশির ভাগ নির্মাণ হয় অবৈধ বা আধা আইনি প্রক্রিয়ায়। সম্পূর্ণ শাস্তিমূলক কারণে অর্থাৎ শাস্তি দেয়ার বা শায়েস্তা করার জন্যই কোনো নোটিশ ছাড়াই এবং আপিলের সুযোগ বা শুনানির সুযোগ না দিয়েই মুসলমানদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বেশ কিছু জিনিস একসাথে বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।

বুলডোজার যুগের আগে, মুসলমানদের জনতা এবং পুলিশ দিয়ে সতর্ক করে দিয়ে শাস্তি দেয়া হয়েছিল- যারা হয় শাস্তিতে অংশ নিয়েছিল বা মুখ ফিরিয়ে নেয়া বেছে নিয়েছিল। সম্পত্তির ওপর বুলডোজার চালানোর ক্ষেত্রে যাই হোক, কেবল পুলিশই নয়, বরং পৌর কর্তৃপক্ষ, মিডিয়া যাদের অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে একটি দানব হত্যার দৃশ্য প্রসারিত, সম্প্রচার করতে ও আদালতগুলোকে অবশ্যই সেখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে দূরে তাকাতে হবে এবং সেখানে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এর অর্থ হলো মুসলমানদের এ কথা বলা, ‘আপনি নিজেই আছেন আপনার সাহায্যে কেউ আসবে না। আপনার আবেদন জানানোর জন্য কোনো আদালত নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যা এই পুরনো গণতন্ত্রের চেকঅ্যান্ড ব্যালেন্সের তথা ভারসাম্য রক্ষা করার অংশ ছিল এমন প্রতিটি এখন একটি অস্ত্র যা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।’

অন্যান্য সম্প্রদায়ের সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সম্পত্তি প্রায় কখনো এভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয় না।
উদাহরণস্বরূপ, ১৬ জুন কয়েক হাজার যুবক বিজেপি সরকারের নতুন সেনা নিয়োগ নীতির বিরুদ্ধে উত্তর ভারতজুড়ে সহিংস তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা ট্রেন ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে, সড়ক অবরোধ করেছে ও একটি শহরে বিজেপি অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই মুসলিম নয়। তাই তাদের বাড়ি ও পরিবার নিরাপদ থাকবে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের দু’টি সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি দৃঢ়তার সাথে দেখিয়েছে যে, জাতীয় নির্বাচনগুলোতে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য তাদের ভারতের ২০০ মিলিয়ন তথা ২০ কোটি মুসলমান জনসংখ্যার ভোটের প্রয়োজন নেই।

সুতরাং কার্যত আমরা একধরনের ভোটাধিকার হরণের দিকে তাকিয়ে আছি যার পরিণতি হবে বিপজ্জনক। কারণ আপনি একবার ভোটাধিকার হারিয়ে ফেললে আপনার কোনো মূল্য থাকবে না। আপনি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবেন। এরপর আপনাকে ব্যবহার বা অপব্যবহার করা হতে পারে। এটাই আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। এমনকি বিজেপির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র সব কিছুকে অপমান করার পরও, দলটি তার মূল সমর্থক ভিত্তির সমর্থন হারায়নি অথবা অর্থপূর্ণ সমালোচনা পায়নি। এসব অপমান ও অবমাননার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানদের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। অপমান ও অবমাননার প্রতিবাদ ছিল বোধগম্য। ওটা ছাড়াও অবশ্যম্ভাবীরুপে আরো কিছু ঘটবে, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ কেউ একটি ব্লাসফেমি আইন করারও আহ্বান জানিয়েছে।

এই আইন পাস হলে বিজেপি সম্ভবত বেশি খুশি হবে। কারণ তখন হিন্দু জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে প্রায় সব মন্তব্যকে এই আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে। এর মাধ্যমে সব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক মন্তব্য ও সমালোচনাকে কার্যকরভাবে বন্ধ করে দেয়া যাবে। রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিক থেকে সব ধরনের সমালোচনাকে বন্ধ করে দেয়ার মতো একটি গর্তে ভারত পড়ে যাবে।

অন্য প্রতিবাদকারীদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম) ধর্ম অবমাননাকারীদের ফাঁসি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং অন্যরা শিরোচ্ছেদ করার আহ্বান জানিয়েছে- যা মুসলমানদের সম্পর্কে প্রতিটি ‘স্টেরিওটাইপ’ নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হবে। বিক্ষোভের পর যে মেরুকরণ হয়েছে তাতে কেবল বিজেপির সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। যে বিজেপি মুখপাত্রকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে- তাকে তার দলের ক্যাডাররা প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করায় তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্বল হবে বলে মনে হচ্ছে।

বর্তমানে ভারতে আমরা রাজনৈতিক পোড়ামাটির নীতির মধ্যে বসবাস করছি। সবকিছু প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যেগুলোকে বছরের পর বছর চেষ্টা করে গড়ে তোলা হয়েছে- সেগুলো ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। স্বচ্ছভাবে চিন্তা করার শক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়া হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে মস্তিষ্ক ধোলাই করার একটি নতুন প্রজন্ম বড় হয়ে উঠবে। তাদের সাথে দেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক জটিলতার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। অর্থাৎ তারা এসব কিছু জানতে পারবে না। প্রায় ৪০০টি টিভি চ্যানেল, অসংখ্য ওয়েবসাইট ও সংবাদপত্রের সমন্বয়ে গঠিত মিডিয়ার সাহায্যে সরকার অব্যাহতভাবে ঘৃণাবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এবং ঘৃণা উদ্দীপক চরিত্র যা হিন্দু মুসলিম বিভাজনে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে।

হিন্দুডান ক্যাডারের মধ্যে একটি নতুন, আক্রমণাত্মক অতিডান বলয় একটি স্পষ্ট অস্থিরতা প্রদর্শন করছে, যা মোদি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে ক্রমবর্ধমানভাবে কঠোর চাপ দিচ্ছে- কারণ তারা বিজেপির মূল সমর্থন ভিত্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলমানদের গণহত্যার জন্য খোলামেলা আহ্বান জানানো এখন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরা পয়েন্ট অব নো রিটার্নে পৌঁছে গেছি। আমরা যারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি বিশেষ করে ভারতের মুসলিম স¤প্রদায়কে এ ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে। আমরা কিভাবে এর থেকে বাঁচতে পারি, সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। আমরা কিভাবে এটা প্রতিহত করতে পারি? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন, কারণ আজকে ভারতে এমনকি প্রতিরোধ যতই শান্তিপূর্ণ হোক না কেন সেটিকে বিবেচনা করা হয় জঘন্য অপরাধ হিসেবে প্রায় সন্ত্রাসবাদের মতো।

আলজাজিরার সৌজন্যে
অনুবাদ : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
লেখক : বুকার পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement
কাঁঠালিয়ায় মাঠে ছাগল আনতে গিয়ে বজ্রপাতে কিশোরে মৃত্যু সালমান খানের বাড়িতে গুলির ঘটনায় গ্রেফতার ২ আরো দুই সদস্য বাড়িয়ে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন রাবির নতুন জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে অপরাধ না করেও আসামি হওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোৎসবে নেমে শিশুর মৃত্যু ধূমপান করতে নিষেধ করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা বড় বোনের বৌভাতের গিয়ে দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্র নিহত কোটালীপাড়ায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত চুয়াডাঙ্গা দর্শনায় রেললাইনের পাশ থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবার রহমানের কবর জিয়ারত করলেন জামায়াত আমির

সকল