২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইউরোপে বর্ণবাদের ভয়াবহ চিত্র

ইউরোপে বর্ণবাদের ভয়াবহ চিত্র - প্রতীকী ছবি

আমেরিকা ও ইউরোপীয় সরকারগুলো গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নিজ শ্বেতাঙ্গ জনগণের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারলেও বর্ণবাদ ও বহিরাগতদের প্রতি ঘৃণার বিষয়টির সুরাহা এখনো করতে পারেনি। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলছে। আমেরিকায় শুধু গায়ের রঙ কালো বা তামাটে হওয়ায় প্রতি বছর বহু মানুষ হত্যার শিকার হয়। একই ভাব ইউরোপে কেবল গায়ের রঙ ও বিদেশী হওয়ায় ঘৃণার শিকার হয় অসংখ্য মানুষ। সেসব খবর খুব কমই জানে বাকি বিশ্বের জনগণ। আর এ ধরনের মানসিকতা থেকেই আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে উত্থান ঘটেছে শ্বেতাঙ্গ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের স্লোগান।

এবার আমরা দেখলাম কিভাবে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের নিয়ে ইউরোপের সৌহার্দ্যপূর্ণ অভিবাদনের পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের প্রতি বিরূপ আচরণ, যার মধ্য দিয়ে মূলত ইউরোপীয় বর্ণবাদের নগ্ন চিত্রই ফুটে উঠেছে। অনেক বছর ধরে আমরা ইউরোপীয় ফুটবলে বর্ণবাদের কথা শুনে আসছি। মনে হতো এসব বুঝি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের নিয়ে মাতামাতির পাশাপাশি অন্যদের প্রতি বিরূপতা প্রদর্শন দেখে মনে হয়েছে ইউরোপীয় সভ্যতা কপটতা ও ভণ্ডামির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

অদ্ভুত এক দ্বৈতসত্তায় দ্বিখণ্ডিত শ্বেতাঙ্গ বিশ্ব। যেখানে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকের শরণার্থীদের জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যেখানে এসব দেশের মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করা হচ্ছে। যখন আমরা টিভি ফুটেজে দেখতে পাই পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির সীমান্ত থেকে এসব অসহায় মানুষকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে; তখন ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের প্রতি ইউরোপের এমন ভালোবাসা বর্ণবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কী হতে পারে?

এখানে উল্লেখ করতে হয়, শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলায় ইউরোপীয় দেশগুলোর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সাধারণত তারা নিজ নিজ দেশে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের চেয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আশ্রয় দেয়াকে প্রাধান্য দেয় এবং সেসব দেশে অর্থের জোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু এবার আমরা অবাক ও বিস্ময়ে দেখলাম, ইউরোপ কিভাবে ইউক্রেন শরণার্থীদের সমাদরের সাথে গ্রহণ করছে। শুধু তাই নয়, তারা এসব শ্বেতাঙ্গ শরণার্থীকে মহিয়ান করতে গিয়ে বাকি বিশ্বের শরণার্থীদের যেভাবে কটাক্ষ করেছে তাতে ইউরোপীয় সভ্যতার মুখোশ খসে পড়েছে। এ যেন নীল রক্তের শ্রেষ্ঠত্বের জয়গান।

ইউক্রেনীয় শরণার্থীর স্রোত যখন ইউরোপে ঢুকতে শুরু করে, তখন ওই সব দেশের সরকার ও সাংবাদিকরা যে মন্তব্য করেছে তা তৃতীয় বিশ্বের তাবত মানুষের বিবেকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। যেমন বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিরিল পেটকভ বলেছেন, ইউক্রেনীয়রা বুদ্ধিমান, শিক্ষিত ও উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন। শুধু তাই নয়, বিবেকের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত সাংবাদিকরা পর্যন্ত যা বলেছেন তা আরো বিস্ময় জাগায়। এদের মধ্যে আরব অ্যান্ড মিডল ইস্ট জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমে কর্মরত মার্কিন সাংবাদিক চার্লি ডি আগাথা অন্যতম।

তিনি ইউক্রেন সম্পর্কে বলেছেন, ‘সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এটি কয়েক দশক ধরে সঙ্ঘাতে থাকা ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো কোনো জায়গা নয়। কিয়েভ সম্পর্কে তার মন্তব্য হচ্ছে, এই শহর অপেক্ষাকৃত সভ্য, অপেক্ষাকৃত ইউরোপিয়ান। অর্থাৎ তিনি ইরাক ও আফগান জনগণকে অপেক্ষাকৃত অসভ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে গত ১০০ বছর যত বড় বড় শরণার্থী সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য দায়ী আমেরিকা ও ইউরোপ। গত দুই বিশ্বযুদ্ধের ফলে ইউরোপে সৃষ্ট শরণার্থী সঙ্কটের কথা বাদ দিলে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিপর্যয়কর বেশির ভাগ শরণার্থী সঙ্কট সৃষ্টি করেছে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। বিশেষ করে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা গত দুই দশকে মৌলবাদী সন্ত্রাস দমন ও একনায়কতন্ত্র উৎখাতের নামে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় যে সামরিক অভিযান চালিয়েছে; তাতে কেবল হাজার হাজার নারী, শিশু ও পুরুষ নিহত হয়নি, উদ্বাস্তু হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ আদম সন্তান। এদের ৯৯ শতাংশই মুসলমান। এদের মধ্যে গত ১০ বছরে ইউরোপে আশ্রয় দিয়েছে মাত্র ১০ লাখ। এর পাঁচ লাখই আবার জার্মানিতে। অথচ গত দুই মাসে ইউরোপ ৮০ লাখ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে ব্যাপক সুবিধাদি দিয়ে।

হয়তো বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা উঠত না, যদি কিনা ওই ধরনের বিরূপ মন্তব্য না আসত। সেই সাথে ঘটনাপ্রবাহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইউরোপের বর্ণবাদী মানসিকতা। ওই সময় শ্বেতাঙ্গ ইউক্রেনীয়দের পাশাপাশি কিছু ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের নাগরিক পোল্যান্ডে প্রবেশ করলে তাদের মারধর করাসহ নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। এই বিদ্বেষ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ রাখঢাক না করেই ঘটেছে।

এখানে দু’টি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক রেসিজম, দুই জেনোফোবিয়া; অর্থাৎ বর্ণবাদ ও বিদেশী বা বহিরাগতদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ। যদিও দু’টি শব্দের মর্মার্থ একই। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই অন্য দেশ থেকে আগত মানুষদের ব্যাপারে একধরনের ভীতি কাজ করে। দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে তো ১৯১৯ সালে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। সেখানে অনেক বাংলাদেশীও হামলার শিকার হন। হত্যার শিকারও হয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। এ ক্ষেত্রে গায়ের রঙের ব্যাপারটি গৌন। কিন্তু ইউরোপে যা সংঘটিত হয় তাকে সোজাসাপ্টা ভাষায় বর্ণবাদ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
যদিও ইউরোপে এটিকে বর্ণবাদের চেয়ে বহিরাগতদের ব্যাপারে ভীতি হিসেবে বেশি দেখা হয়। তা যদি সত্যি হয়; তাহলে পূর্ব ইউরোপের লোকজন পশ্চিম ইউরোপে গিয়ে জেনোফোবিয়ার শিকার হয় না কেন? কিংবা ইউক্রেনীয় শরণার্থীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কেন, যা ঘটে থাকে আরব কিংবা অন্য দেশগুলোর বেলায়। যদি বিদেশী অভিবাসীদের কারণে স্থানীয়দের সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়া কিংবা চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হওয়ার ভীতি থেকে এ ধরনের ঘৃণার সৃষ্টি হয়ে থাকে; তা হলে সেটি তো মধ্যপ্রাচ্যে আরো ভয়াবহ আকারে হওয়ার কথা। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ শ্রমিক বিদেশী। কিন্তু সেখানে তো তা হয়নি। অথচ পশ্চিমাদের সৃষ্ট শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলা করতে ধুঁকছে তুরস্ক, জর্দান, লেবানন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ।

সবার স্মরণ থাকার কথা, যখন পশ্চিমারা জোর করে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি রাষ্ট্র গঠন করে; তখন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন জর্দান, লেবাননসহ গোটা আরব দুনিয়ায়। ইউরোপের কোনো দেশ তাদের আশ্রয় দেয়নি।

সুতরাং ইউরোপের ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা স্রেফ বর্ণবাদ এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা, যা উত্তরাধিকারসূত্রে তারা পেয়ে আসছে। কারণ পৃথিবীর কোনো শিশু তো চামড়ার রঙ কালো বা সাদা কিংবা অন্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা নিয়ে জন্মায় না। জন্মের পর ধীরে ধীরে সে তার মা-বাবার কাছ থেকে সব শেখে। যেমন আমাদের রাসূল সা: বলেছেন, ‘প্রতিটি নবজাতক মুসলিম হয়ে জন্মায়। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি, নাসারা ও মাজুসি (অগ্নিপূজক) রূপে গড়ে তোলে।’ তাই বলা যায় যে, অভিবাসীদের প্রতি ইউরোপের সাদা মানুষদের যে ঘৃণা, তা বংশপরম্পরায় চলে আসছে।

অন্য দিকে ইউরোপে যারা অভিবাসী তারা ওখানকার অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কারণ ওইসব দেশে জন্মহার খুবই কম। কোনো কোনো দেশে জন্মহার মাইনাসে চলে গেছে। অথচ তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে আরো কর্মশক্তি দরকার। সেখানে এমন সব অস্বাভাবিক কঠিন কাজ আছে, যা শ্বেতাঙ্গরা করতে চায় না। আর সেসব কাজ করে ওই ‘নিন্দিত’ অভিবাসীরা। অথচ তারাই হয়ে গেল ঘৃণার পাত্র!

এ দিকে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা কিংবা অন্য দেশের ফুটবলার যারা ইউরোপের লিগগুলোতে খেলে তারা ভালো করে জানে ওখানের মানুষ কতটা বর্ণবাদী। সেটি ইংলিশ, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি যে দেশেরই ফুটবল লিগ হোক না কেন, বর্ণবাদের চিত্র একই। ইউরোপের অনেক ক্লাবেই কালো খেলোয়াড় আছেন। কিন্তু তারা যে কী পরিমাণ ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈষম্যের শিকার হয় তা এই আধুনিক যুগে অকল্পনীয়। ঘৃণা ও গালাগালির শিকার হয়ে অনেক কালো ফুটবলার খেলাই ছেড়ে দিয়েছেন। ব্রিটেনের চেলসি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো নামকরা ফুটবল ক্লাবের সমর্থকরা ভয়াবহ বর্ণবাদী হিসেবে পরিচিত।

অন্যান্য ক্লাবের সমর্থকরাও কম যায় না। আমেরিকায় একটি ফুটবল টিমের নামই হচ্ছে ‘ওয়াশিংটন রেডস্কিন’। এ থেকে বুঝে নিতে পারি আমেরিকা ও ইউরোপ কতটা বর্ণবাদী। অথচ তারাই নাকি বর্তমান বিশ্বে মানবতার দিশারি!


আরো সংবাদ



premium cement
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন মজবুত করতে হবে : শামসুল ইসলাম ইউরো ২০২৪’কে সামনে রেখে দল নির্বাচনে বিপাকে সাউথগেট ভারতীয় পণ্য বর্জনকে যে কারণে ন্যায়সঙ্গত বললেন রিজভী মাকে ভরণ-পোষণ না দেয়ায় শিক্ষক ছেলে গ্রেফতার প্রথম বাংলাদেশী আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিরাপত্তা-বিষয়ক আলোচনা করতে উত্তর কোরিয়ায় রুশ গোয়েন্দা প্রধান বদলে যেতে পারে এসএসসি পরীক্ষার নাম সীমান্তে বাংলাদেশীদের মৃত্যু কমেছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাবো : মেসি

সকল