২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দান করে ধন্য হই

- ছবি : সংগৃহীত

দান বা ‘সাদকাহ শব্দটি আরবি মূল শব্দ ‘সিদক’ থেকে এসেছে। ইসলামী পরিভাষায় সাদকা বলতে বোঝানো হয়- ‘বিনিময়ে না চেয়ে শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে কাউকে কিছু দেয়া’। শরিয়তে দান দুই ভাগে বিভক্ত। একটি এমন দান যা বিশেষ কিছু শর্তে মুসলিম ব্যক্তির বিশেষ কিছু সম্পদে ফরজ হয়। এমন দানকে বলা হয় জাকাত। আর অন্য দানটি এমন যে, মুসলিম ব্যক্তিকে তা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু তার ওপর অপরিহার্য করা হয়নি। এমন দানই হলো সাদকা। আল্লাহ ধনীদের ওপর সম্পদের জাকাত ও ওশর ফরজ করেছেন। সেই সাথে সাদকার ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছেন। ইসলামে জাকাত ও ওশরের পরিমাণ নির্ধারিত কিন্তু সাদকার ব্যাপারে কোনো সীমা বাঁধা নেই। উদ্দেশ্য দানের ক্ষেত্রটাকে প্রসারিত করে এর মাধ্যমে সব অভাবীরাই যেন সুবিধা পায় আর দাতা অফুরন্ত কল্যাণের অধিকারী হয়। সব ভালো কাজের পুরস্কার সমান নয়, হওয়ার কথাও নয়।

পবিত্র কুরআনই এ ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিচ্ছে কোন কাজের পুরস্কার কতটুকু। ‘যে সৎকাজ নিয়ে আসবে, তার জন্য প্রতিদান হবে ১০ গুণ। আর যে অসৎ কাজ নিয়ে আসবে, তার প্রতিদান হবে শুধু অনুরূপ এবং তাদের ওপর জুলুম করা হবে না।’ (সূরা আল আনআম-১৬০)
‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে এক শ’ দানা।

আর আল্লাহ চাইলে তার জন্য আরো বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারাহ-২৬১)
দান করতে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয় বিধায় সাধারণ ভালো কাজের চেয়ে দানের পুরস্কার অনেকগুণ বেশি। আবার জীবন মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান বিধায় কেউ শহীদ হলে ঋণ ছাড়া অন্য সব গুনাহ মাফ করে জান্নাতে প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং যে কাজে যত বেশি ত্যাগ স্বীকার সে কাজে তত পুরস্কার, কাজের ফলাফল বা পরিমাণ যাই হোক না কেন। দানের পূর্বশর্ত হলো মানুষের প্রতি সহনশীল হওয়া।

দানের ব্যাপারে এত তাগিদ কেন
প্রথমত, দাতা-গ্রহীতার অনিবার্য নিয়মটি একটি প্রকৃতিগত বিষয়ও বটে। দান এমন একটি কাজ যা ছাড়া মানুষ তো দূরের কথা প্রকৃতিও তার জায়গায় এক দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সূর্য ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূর থেকে পৃথিবীবাসীকে প্রতিনিয়ত আলো ও তাপ দান করে সজীব রাখছে। আকাশ থেকে বর্ষিত বৃষ্টির ফোঁটা কাজে লাগিয়ে গাছপালা সূর্যালোক ও প্রকৃতিতে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে ছেড়ে দেয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে তার খাবার তৈরি করে অক্সিজেন ছেড়ে দিচ্ছে। সে অক্সিজেন ব্যবহার করে আমরা প্রাণীরা বেঁচে আছি। দেখা যাচ্ছে প্রকৃতিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাতা-গ্রহীতার খেলা। এ খেলায় গ্রহীতা দান গ্রহণ করে বেঁচে যাচ্ছে, কিন্তু দাতা দান করে কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, দাতা-গ্রহীতার এই প্রক্রিয়া জোরদার করা ছাড়া মানব জাতি টিকে থাকতে পারবে না। এ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তশালী জাতি বা লোকটিও স্বয়ংসম্পূর্ণ নন। তাকেও সবচেয়ে দুর্বল খ্যাত কথিত নিম্নশ্রেণীর শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমে বানানো অট্টালিকায় বসবাস আর রাস্তাঘাটে চলাচল করতে হয়।

তৃতীয়ত, প্রকৃতিতে দাতা থাকছেন উচ্চ মর্যাদায় আর গ্রহীতা থাকছেন কৃতজ্ঞ। গ্রহীতা দাতার কোনো ক্ষতিই করে না বা করতে পারে না, বরং দান করে যেন দাতার আরো শক্তি বৃদ্ধি পায়। যেমন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গাছপালাকে দান করা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিজে গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখছে এবং গাছপালা নিজেও প্রকৃতিতে অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে আমাদের বাঁচার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
চতুর্থত, দাতা-গ্রহীতার এই ধারা যেন প্রশান্তি আর সান্ত্বনার অনিবার্য বিষয়। পিতা-মাতা সর্বস্ব ত্যাগ করে কোনোরকম প্রতিদানের আশা ছাড়াই সন্তানকে বড় করে গড়ে তুলে প্রশান্তি পাচ্ছে আর সন্তান-সন্ততিরও উচিত বড় হয়ে মা-বাবার সেবা করে তাদের সান্ত্বনার জবাব দেয়া। এভাবে দান-প্রতিদানের ধারাবাহিকতা পৃথিবীকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে।

পঞ্চমত, দাতা-গ্রহীতার এ নিয়মে পারস্পরিক সহাবস্থান, ভালোবাসা ও সামাজিক বন্ধন মজবুত করছে। চিকিৎসক তার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে রোগীর চিকিৎসা করছে আর রোগী প্রতিদান হিসেবে কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি কিছু বিনিময় বা অন্য কিছু দিয়ে চিকিৎসককে খেয়েপরে বেঁচে থাকায় সহযোগিতা করছে।

এ ছাড়া দান-সাদকা একটি উত্তম আমল। মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর মানবতার মূর্তপ্রতীক। এ জন্যই সব ধর্ম এবং সমাজে দান-সাদকাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সাদকাহ প্রাপ্তি হলো গরিব বান্দার হক। এই হক প্রদানে কোনো ধরনের গাফিলতি হলে কঠিন জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হবে।

তাই মানুষে মানুষে সম্পদ ও অন্যান্য বৈষম্য যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা দানকে উৎসাহিত করার আরেকটি কারণ। দানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে দেশে দেশে কখনো দুর্ভিক্ষ হতো না। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, দেশে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ খাদ্যাভাবের কারণে নয়, বরং তা অনেকটাই মানবসৃষ্ট।

উত্তম দানের শর্তাবলি : দান হতে হবে নিজের প্রিয় জিনিসের। ‘তোমাদের প্রিয় জিনিসের দান খরচ করা ছাড়া কখনোই তোমরা প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না।’ (সূরা আল-ইমরান-৯২)
‘হে মুমিনগণ, তোমরা ব্যয় করো উত্তম বস্তু, তোমরা যা অর্জন করেছ এবং আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে এবং নিকৃষ্ট বস্তুর ইচ্ছা করো না যে, তা থেকে তোমরা ব্যয় করবে। অথচ চোখ বন্ধ করা ছাড়া তোমরা নিজেরাও তা গ্রহণ করো না। আর নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।’ (সূরা বাকারাহ-২৬৭)
দান হতে হবে শর্তহীন এবং কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। ‘আর যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও নিজদেরকে সুদৃঢ় রাখার লক্ষ্যে সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা উঁচু ভ‚মিতে অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে পড়েছে প্রবল বৃষ্টি। ফলে তা দ্বিগুণ ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেছে। আর যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিই যথেষ্ট। আর আল্লাহ তোমরা যা আমল করো, সে ব্যাপারে সম্যকদ্রষ্টা।’ (সূরা বাকারাহ-২৬৫) এখানে প্রবল বৃষ্টিপাত বলতে এমন দান-খয়রাতকে বোঝানো হয়েছে যার পেছনে থাকে চরম কল্যাণ আকাক্সক্ষা ও পূর্ণ সদিচ্ছা। আর হালকা বৃষ্টিপাত বলতে কল্যাণ আকাক্সক্ষার তীব্রতাবিহীন দান-খয়রাতকে বোঝানো হয়েছে।

দান হতে হবে শয়তানের প্ররোচনামুক্ত ভেজালহীন। ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় (দান করার ক্ষেত্রে) এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারাহ-২৬৮)
দান করতে হবে দানের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দানযোগ্য ব্যক্তিকে। এখানে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি কারা। প্রথম অগ্রাধিকারযোগ্য ব্যক্তি একবারেই নিঃস্ব, উপার্জন ক্ষমতাহীন, যার সাহায্য করার মতো আর কেউ নেই- এমন ব্যক্তি। আর অগ্রাধিকারযোগ্য ব্যক্তি হলো উপার্জন করার শক্তি-সামর্থ্য সবই আছে কিন্তু দ্বীন বা মানবতার জন্য কাজ করতে গিয়ে উপার্জনের জন্য সময় দিতে পারে না।

যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানবিক শিক্ষা-চিকিৎসার খরচ চালাতে অসমর্থ তারাও অগ্রাধিকারযোগ্য। একসময় সামর্থ্যবান ছিল কিন্তু সঙ্গত কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কিংবা সফরকালীন সময়ে সাময়িক সময়ের জন্য টাকা ফুরিয়ে গেছে এমন ব্যক্তিও দানের যোগ্য।

দান হতে হবে সময়োপযোগী ও মৃত্যুর আগেই; কারণ মৃত্যুর সময় আসার পর কাউকেই এক রত্তি পরিমাণ অবকাশ দেয়া হবে না। ‘আর আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করো, তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগে। কেননা তখন সে বলবে, হে আমার রব, যদি আপনি আমাকে আরো কিছু কাল পর্যন্ত অবকাশ দিতেন, তা হলে আমি দান-সাদকা করতাম। আর সৎ লোকদের অন্তর্ভুুক্ত হতাম।’ (সূরা মুনাফিকুন-১০) ‘আর আল্লাহ কখনো কোনো প্রাণকেই অবকাশ দেবেন না, যখন তার নির্ধারিত সময় এসে যাবে। আর তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।’ (সূরা মুনাফিকুন-১১)

সর্বোত্তম দান কোনটি?
এখন প্রশ্ন হতে পারে, কোন কাজটি আল্লাহর কাছে সৎকাজ হিসেবে গণ্য। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসের পাশাপাশি সহিহ নিয়ত এবং আল্লাহ ও রাসূলের দেয়া নিয়ম মেনে সর্বাত্মক চেষ্টায় রত যেকোনো পরিমাণ আল্লাহ ঘোষিত কাজকেই সৎকাজ বোঝায়। ইসলামে সৎকাজের পুরস্কার পেতে প্রয়োজনীয় শর্ত মেনে যেকোনো ব্যক্তি যখন এমনভাবে দান করে যে অন্য কেউ টের পায় না, তখন পরিমাণ যাই হোক না কেন, তা-ই সর্বোত্তম দান হিসেবে গণ্য হবে।

‘আপনার প্রয়োজন থাকা সত্তেও আপনি নিজে ত্যাগ করে দান করবেন, আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করবেন, সাদকা করবেন, আর এই সাদকা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সাদকা।’ (আল হাদিস)

জীবিত ব্যক্তি কী কী দান করতে পারে?
জীবিতাবস্থায় ব্যক্তির দানকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি। জ্ঞান দান, অর্থসম্পদ দান, উত্তম জীবনাদর্শ দান ও উত্তম বংশধারা বা সন্তান-সন্ততি দান। প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তি জীবিতাবস্থায় চাইলেই পৃথিবীবাসীকে চারটির চারটিই অথবা যেকোনো একটি দান করে ধন্য হতে পারে।
মৃত ব্যক্তি জীবিতকে কোনো কিছু দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। তবে তারা নিজেরা উত্তম প্রতিফল কিয়ামত পর্যন্ত পেতে থাকেন যদি মৃত্যুকালে উত্তম আদর্শ ও আদর্শবান সন্তান রেখে যান অথবা অর্থসম্পদ দান করে যান বা এমন জ্ঞানভাণ্ডার রেখে যান, যার ফল সুদূরপ্রসারী।

সাদকায়ে জারিয়া : একটি সর্বোত্তম মানবিক কাজ
সাদকায়ে জারিয়া আরবি শব্দ। সাদকা শব্দের অর্থ দান করা এবং জারিয়া অর্থ প্রবহমান, সদাস্থায়ী প্রভৃতি। সাদকায়ে জারিয়া হলো- এমন দান যার কার্যকারিতা কখনো শেষ হবে না এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে যত দিন এর কার্যক্রম থাকবে তত দিন পর্যন্ত কবরে শুয়ে শুয়ে সাদকাকারী ব্যক্তি এর সওয়াব পেতেই থাকবে। বিধায় প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সাদকায়ে জারিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা।

সাদকায়ে জারিয়া স্থায়ী ও অবিনিময়যোগ্য দান। এর অন্যতম উদ্দেশ্য সামাজিক ও সামষ্টিক পরোপকার। পরোপকার সাধারণত দু’ভাবে করা যায়- ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু করলে বৃহত্তরভাবে পরোপকার করা যায়। যেমন- কেউ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করল আর কেউ শুধু একজন রোগীকে সেবা দিলো। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের মাধ্যমে এরকম বহু রোগীর সেবা করা সম্ভব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি
towhid.drhossain@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement