২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জলবায়ু পরিবর্তনে অর্থনীতির সঙ্কট

-

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত মিলিয়ে ছয়ঋতুর প্রকৃতি এখন বলার জন্য বলা। লেখার জন্য লেখা। বাস্তবতার অমোঘ নিষ্ঠুরতা হচ্ছে, প্রতি দুই মাসের চক্রে ঋতুর আর আবেশ নেই। আর এর জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। কোনো একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার গড়পড়তা ধরনকে বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে- বন্যা, খরা, ঝড়, পানির সঙ্কট, দাবানল, খাদ্য উৎপাদনে অস্থিরতা, সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা তলিয়ে যাওয়া। এক মৌসুমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে তো, আরেক মৌসুমে সর্বনাশ।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকে ধরা হয়; যার কারণে কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের গুটিকয়েক দেশ তথা শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো অধিক হারে কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী, কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে কার্বন নিঃসরণের হার কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ হ্রাস করার কথা থাকলেও কোনো দেশই এখন পর্যন্ত এই বিষয়গুলো তেমন গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়নি। এতে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁঁকিতে রয়েছে। ছোট আয়তন, বিপুল জনসংখ্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় হওয়ায় এ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁঁকি অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেকাংশে বেশি।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। শীতের সময় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির অনেক নিচে নেমে যায় এবং গরমের সময় ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। এতে ধানের পরাগায়নে অনেক সমস্যা হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতেও ফসল উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গবেষকদের মতে, এভাবে যদি কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকে তা হলে কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে। এতে দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান ছাড়া দেশে এখন অন্যান্য শস্য যেমন- পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শিলাবৃষ্টি, ঝড়, আকস্মিক বন্যা প্রভৃতি। এতে তাদের মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছে। রবি মৌসুমে অতিরিক্ত শৈত্যপ্রবাহ থাকায়ও ফসল উৎপাদন অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরেকটি বড় খাত হচ্ছে মৎস্য খাত। তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর পুকুর, পাঁচ হাজার ৪৮৮ হেক্টর বাঁওড় এবং ১১ কোটি হেক্টর চিংড়িঘেরে মাছ চাষ হয়। এ ছাড়া ৪৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর মুক্ত জলাশয়, যেমন- নদী, হাওর, বিল, খালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মাছ বাস করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে মৎস্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। এর ফলে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের ওপর, যাদের জীবিকা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান সময়ে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়ায় মানুষ তাদের সব কিছু হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ছে। এতে তাদের পুনর্বাসন করতে সরকারকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে নিজ এলাকা ছেড়ে বড় শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে অসময়ে বন্যা, বৃষ্টি, খরা, আগাম বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা নিজেরাও বিভিন্ন সময় হাটবাজার গ্রাম উন্নয়ন, নগরায়ন, অফিস আদালত, বসতবাড়ি নির্মাণে আবাদি জমি, গাছগাছালি ধ্বংস করে প্রকৃতিকে রীতিমতো হত্যা করছি। এর বিপরীতে বাড়ছে মানুষ।

বিজ্ঞানীদের একটি মহলের আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর এ পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই। ফলে চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তখন কী হবে বা হতে পারে, তা ধারণার বাইরে। তবে আবহাওয়ায় পরিবর্তন এবং প্রকৃতির একেকটি অ্যাকশন সেই ধারণার কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাতের তাপমাত্রা কয়েক বছরের চেয়ে এখন কম। এ কারণে শীতের অনুভূতি বাড়ছে; যা আসলে শীত নয়। আবার দিনে বেশ তাপমাত্রা দেখা যাবে। বাতাসে গরম হাওয়া বইবে আবার ক্ষণিকের জন্য বৃষ্টিও হবে।

প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুতে স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন আরোপ হয়। তবে যে মাত্রায় তারতম্য বাড়ছে তার পেছনে মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কলকারখানা ও যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস ও কয়লা পোড়াতে শুরু করল সেই সময়ের চেয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ঊনবিংশ শতকের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ হয়।

যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ে অবিরাম কথামালা চলতে থাকলেও তা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের খেসারত টানতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- ক. সরকারের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন বাজেটের বাইরে বিশেষ ক্ষেত্র হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় এই ট্রাস্টের তহবিল ব্যবহার করা; খ. জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; গ. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্প বা কর্মসূচি গ্রহণ করা; ঘ. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং অর্থ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের আলোকে উপযুক্ত বিস্তারসহ বা পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; ঙ. জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপখাওয়ানো এবং ক্ষতিগ্রস্ততা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর ভিত্তিতে কর্মসূচি বা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা; চ. পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে স্থাপিত জলবায়ু পরিবর্তন ইউনিটসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এবং পরিবেশ অধিদফতরে গঠিত জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জলবায়ু পরিবর্তন সেল বা ফোকাল পয়েন্টকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়তা করা; ছ. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা; এবং জ. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী জরুরি কার্যক্রমে সহায়তা করা।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোর কেউ কেউ কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে এবং পরিবেশবান্ধব সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছে। যেটুকু কার্বন নিঃসৃত হবে তা অধিক পরিমাণ গাছ লাগিয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা চলছে।

একই সময়ে একই দেশের কোথাও হিম শীত, কোথাও কড়া রোদ। আবার শৈত্যপ্রবাহের মাঝেই শিলাবৃষ্টি। অনেকের কাছে তা বাপের জনমেও না দেখার ঘটনা। অনেকের কাছে কুদরতি তেলেসমাতি। এটিই প্রকৃতির বাস্তবতা। এটি জলবায়ু ও প্রকৃতির সাথে মানুষের ক্রিয়াকর্মের প্রতিদান। অ্যাকশনের রিঅ্যাকশন। ফলে মনুষ্যসৃষ্ট এই প্রভাবের কারণে দিন দিন প্রকৃতি তার নিজস্ব গতি হারিয়ে ফেলছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের

সকল