২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সেবার নামে বাণিজ্য

-

চিকিৎসা জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চিকিৎসা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসাপ্রাপ্তি ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। সেই সব মানুষের আহাজারি কান পাতলেই শোনা যায়।

মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হয়; তখন বাধ্য হয়ে চিকিৎসক ও হাসপাতালের দিকে ছোটে; কিন্তু সবার কপালে চিকৎসা জোটে না। কিছু মানুষ চিকিৎসাসেবা পেলেও বেশির ভাগের ভাগ্যে চিকিৎসাসেবা পাওয়া দূরের কথা, হাসপাতালের বারান্দায় পর্যন্ত ঠাঁই হয় না। দেশে জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালের ভোগান্তি মানুষকে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য করে। সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণে যত্রতত্র প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল’। গত ৮ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন যমজ দুই শিশুকে ওই হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার পর এক শিশুর মৃত্যু হয়।

চিকিৎসা হলো একটি সেবাধর্মী পেশা। এ পেশার কাউকে ছোট কিংবা বড় করা আমার উদ্দেশ্য নয়! চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের কথাগুলো তুলে ধরাই একমাত্র উদ্দেশ্য। সুস্থ কোনো মানুষ হাসপাতালে যান না। যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হয়। সেখানে কর্মরত কর্মীদের বেপরোয়া আচরণ, অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রয়োজন ছাড়াই আইসিইউতে পাঠানো, অপারেশনের নামে গলাকাটা ফি, ভুল চিকিৎসা, বড় অঙ্কের বিল হাতে ধরিয়ে বলা হয়- টাকা দিন নয় তো অন্য হাসপাতালে চলে যান। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। যখন কেউ কোনো বেসরকারি হাসপাতাল অনুমোদন নেন; তখন স্লোগান দেন- ‘মুনাফা নয় সেবাই আমাদের অঙ্গীকার’; কিন্তু দিন যত গড়ায় সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে প্রায়ই চিকিৎসা না পাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। যথাযথ নিয়ম-কানুন ছাড়াই গড়ে ওঠা হাসপাতালে রোগীরা যাচ্ছেন, অর্থ খরচ করছেন, কিন্তু কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত। এ অবস্থার পরির্বতন হওয়া দরকার।

দেশ যখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে ঠিক তখনো বিনা চিকিৎসায় বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিনা চিকিৎসা কিংবা ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু কারো কাম্য নয়। করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার মান দেশবাসীর সামনে উন্মোচন করেছে। দেশে কিছু সূচকের অগ্রগতি হলেও চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু এখনো হয়নি। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ চরম দরিদ্র হয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশেও এরা বিপুলসংখ্যক। বিশ্বে তিন ধরনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু থাকলেও আমরা এক জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছি। ফলে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে আর্থিকভাবে বহু মানুষ ফতুর হচ্ছেন। একজন রোগী চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন চিকিৎসাসেবা পেতে; কিন্তু আমাদের দেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যাতে রোগীরা চিকিৎসাসেবা পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নাজেহাল হয়েছেন। নিচে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো।

নিকট অতীতে রাজধানীর আজিমপুর মাতৃসদনের পরিচালক, চিকিৎসক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সন্তানসম্ভবা একজন গরিব রোগীর সাথে অমানবিক আচরণের ঘটনা মনে হলে আজো গা শিউরে ওঠে। টাকা না থাকায় ওই মহিলার স্থান সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হয়নি। এক অপরিচিত ব্যক্তির সহযোগিতায় ওই নারী আজিমপুর মাতৃসদনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন; কিন্তু সেখানেও তার ঠাঁই হয়নি। তারা তাকে প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়ার জন্যে চাপ দেয়। কিন্তু টাকা না থাকার অক্ষমতা প্রকাশ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রসব বেদনায় ছটফট করা প্রসূতিকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়। এ ঘটনা কারো কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু ওই মহিলাকে বেশি দূর যেতে হয়নি। মাতৃসদনের বারান্দাতেই তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। সেই নবজাতকটির কয়েক মিনিট পর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। এই নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার দৃশ্যমান কিছু পক্ষেপ নেয়; কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ।
গত ২ জানুয়ারি সাভার থেকে এক মা অসুস্থ যমজ শিশুকে নিয়ে শ্যামলীর একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে ওই হাসপাতাল ছেড়ে শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ’ নামের আরেকটি হাসপাতালে ভর্তি হন। দুই দিনে প্রায় লাখ টাকার বিল করা হয়। ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর চাহিদামতো টাকা দিতে না পারায় চিকিৎসাধীন দুই যমজ শিশুকে এনআইসিইউ থেকে বের করে দেয়ার পর এক শিশুর মৃত্যু হয়। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হওয়ায় হাসপাতালটির মালিককে র‌্যাব গ্রেফতার করে।

১১ নভেম্বর ২০২১ সালে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মাত্র ৫০ টাকা বখশিশ কম দেয়ায় এক রোগীর মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক ও পাইপ খুলে ফেলে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই রোগী মারা যায়। এরকম বহু ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্রে একের পর এক ঘটে চলছে; কিন্তু প্রতিকার মিলছে না।

৬ জানুয়ারি দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছে- চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় বাচেনা খাতুন নামে এক রোগীর পেটে সার্জিক্যাল কাঁচি রেখে সেলাই করে চিকিৎসাপর্ব শেষ করেন ডাক্তার। ২০ বছর পর যন্ত্রণা কাতর বাচেনা খাতুনের পুনঃপরীক্ষায় তা উন্মোচিত হয়। ডাক্তারের অবহেলাজনিত কারণে এমন বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। কিন্তু অবহেলা ও ভুলের শিকার ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়নি। দেশের কিছু হাসপাতালে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা ও রমরমা বাণিজ্য বেড়েই চলছে। বাচেনা খাতুন এর খণ্ডিত দৃষ্টান্ত।

আমার পরিচিত একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা নবজাতককে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিওতে ভর্তি করেন। ২০ দিন চিকিৎসা বাবদ চার লাখ টাকা চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে। প্রতিবার রোগী দেখার জন্য ডাক্তারকে যেমন ভিজিট দিতে হয়; তেমনি অ্যাপ্রনের জন্যও এক হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়াও সার্ভিস চার্জের নামে গলাকাটা ফি আদায় করা হয়। এত অর্থ দিয়ে কি একজন নিম্ন-আয়ের মানুষের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব?

প্রত্যেক জেলায় জেলা হাসপাতাল আছে; কিন্তু সেবার মান নিম্নমানের হওয়ায় মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধ করতে হলে জেলা হাসপাতালগুলোতে কিডনি ডায়ালাইসিস, হাটের রিং, বাইপাস, স্ট্রোক, অর্থোপেডিক, আইসিইউর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জেলাপর্যায়ে অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপক মানের ডাক্তার পাওয়া গেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের ঢাকায় আসতে হতো না। সেবার নামে গলাকাটা বাণিজ্য কোনোভাবেই মানবিক সমাজে মানায় না।


আরো সংবাদ



premium cement
বগুড়ায় গ্যাসের চুলার আগুনে বৃদ্ধা নিহত বগুড়ায় ধানের জমিতে পানি সেচ দেয়া নিয়ে খুন জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম

সকল