২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

খলিফার শাসন : ক্রীতদাসের হাসি

-

আজকের লেখাটি শুরুর প্রাক্কালে গত সালের ২৪ নভেম্বরের নয়া দিগন্তে লাল কালিতে লেখা শিরোনামটিতে চোখে পড়ে যায়। সেখানে লেখা, ‘২০১৪ থেকে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে’। এটি নয়া দিগন্তের কোনো রিপোর্টারের ব্যক্তিগত অভিমত নয়; বরং এটি সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের (আইডিইএ) একটি প্রতিবেদনের ভাষ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ‘দুর্বল গণতন্ত্র’ ছিল।

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি গত ২২ নভেম্বর ‘গণতন্ত্রের বৈশ্বিক পরিস্থিতি-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আরো বলেছে, ‘বিশ্বের স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলো আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় নিপীড়নের পথ বেছে নিচ্ছে। কিছু কিছু দেশে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অধীনে নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে, যা মোটেই স্বাধীন, অংশগ্রহণমূলক ও অনিয়মমুক্ত নয়।’ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় রাখা হয়।

আজকের লেখার শিরোনামের একটি অংশ ‘ক্রীতদাসের হাসি’। এটি ঔপন্যাসিক শওকত ওসমানের একটি বিখ্যাত রূপকাশ্রিত উপন্যাস। প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। পাকিস্তানে তখন চলছিল আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন। বক্তব্যের সহজ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রূপকের আশ্রয় নিয়ে লেখক আইয়ুবের সামরিক দুঃশাসন ও বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ফুটিয়ে তুলেছেন খলিফা হারুন-অর-রশীদ ও হাবসি গোলাম তাতারীর মাধ্যমে।

গল্পটি এই রকম, ‘হাবসি গোলাম তাতারীর প্রেমে পড়ে আর্মেনীয় দাসী মেহেরজান। আর তাদের মিলনে সাহায্য করেন রাজমহিষী জোবায়দা। তিনি মেহরেজানকে প্রণয়োদ্দেশ্যে তাতারীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সাথে একটা আংটি দিয়ে এটাও নিশ্চিত করেন যেন দারোয়ানদের বাধা পেরিয়ে মেহেরজান ঠিক তাতারীর কাছে পৌঁছাতে পারে। বেগমের সাহায্য নিয়ে মেহেরজান ও তাতারী রাজপ্রাসাদের বাইরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো হাবসি গোলামদের আবাসে তাতারীর গৃহে প্রতিদিন মিলত হয়। সেখানে মিলনের আনন্দে তারা প্রাণ খুলে হাসে। এক রাতে খলিফা হারুন-অর-রশীদ সেনাপতি মশরুরকে নিয়ে রাজপ্রাসাদের বাগানে বেড়াতে বের হলে হাবসি গোলামদের আবাস থেকে হাসি শুনতে পান। গোলামদের এমন প্রাণখোলা হাসিতে বিস্মিত হন খলিফা। তিনি নিজে বাগদাদের বাদশাহ হয়েও হাসতে পারছেন না, অথচ তার প্রাসাদের বাইরে কেউ এমন সুখ-ডগমগ হাসি হাসতে পারে! খলিফার এমন বিস্ময়ে সেনাপতি তাকে বলেন, ‘পারে, আমিরুল মুমিনিন। ওরা সুখ পায় না, কিন্তু সুখের মর্ম বোঝে। মনুষ্যত্বহীন, কিন্তু মনুষ্যত্বের আস্বাদ পায়। ওরা হাসে।’

ঈর্ষা ও আক্ষেপে আক্রান্ত খলিফা কোনো কাজে মন দিতে পারছিলেন না। তিনি কানে শুধুই হাবসি গোলামের হাসি শুনতে পান। তিনি কেবলই ভাবেন কেন বাগদাদের অধীশ্বর হয়েও তিনি এরকম প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারছেন না। তিনি নিজেও যদি এমন হাসতে পারতেন!

পরের রাতে সেনাপতিকে নিয়ে আবার বের হন হাসির উৎস অনুসন্ধানে। সে রাতে জানতে পারেন, এ হাসি হাবসি গোলাম তাতারী ও বাঁদী মেহেরজানের প্রণয়জাত হাসি। তৃতীয় দিন তিনি তাদের তাতারীর ঘরে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। যেনার অপরাধে তাদের শাস্তি দিতে চান, কিন্তু যখন জানতে পারেন, রাজমহিষী জোবায়দা বিয়ে দিয়েছেন, তখন সবাইকে অবাক করে খলিফা মেহেরজান ও তাতারীকে দাসত্ব মুক্ত করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন, এটা তাদের হাসির পুরস্কার। তিনি মেহেরজানকে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দেন। একই সাথে তাতারীকে বাগদাদ শহরের পশ্চিমে একটি বাগিচার মালিক করে দেন। এর পরিবর্তে তিনি তাতারীর হাসি দেখতে চান। কিন্তু তাতারী হাসতে পারে না।

খলিফা তাতারীর হাসি দেখতে উদগ্রীব হন; কিন্তু মেহেরজানবিহীন তাতারী আর হাসতে পারে না। খলিফার অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, তিনি শেষ পর্যন্ত তাকে বলেন যে, তাতারী যদি তার সামনে হাসতে না পারে সে যেন বারান্দায় গিয়ে একটু হাসে, খলিফার ওই হাসি শুনলেই চলবে। তাতারী তাতেও ব্যর্থ হয়। খলিফা রেগে গিয়ে তাতারীকে হত্যার আদেশ দেন। এ সময় কবি আবু নওয়াস বলেন, ‘আলমপানা, আমি কবি আপনি জানেন। নাফরমানের গর্দান নেয়া উচিত। কিন্তু এর অপরাধ কতটুকু বিচার করে দেখা হোক। ও হাসছে না। কিন্তু হাসির জন্য ওয়াক্ত লাগে, যেমন নামাজের জন্য প্রয়োজন হয়।’ কবির কথায় খলিফা সে দিন তাতারীকে ছেড়ে দেন বটে, তবে তিনি আবার আসবেন বলে জানান। সে দিন তাতারীকে হাসতেই হবে।

তাতারীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য খলিফা বাগদাদের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নর্তকী বুসায়নাকে পাঠান তার কাছে। তিনি বুসায়নাকে এই শর্ত দেন যে, যদি সে তাতারীর মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ হয়, তবে তাকে কতল করা হবে। বুসায়নার নগ্ন দেহের আহ্বানও ফিরিয়ে দেয় তাতারী। ব্যর্থ বুসায়না জানতে চায়, তাতারী যেহেতু এখন আর গোলাম নয়, তাহলে এখান থেকে কেন পালাচ্ছে না। উত্তরে তাতারী বলে, ‘বাহ, বুসায়না। এই ধন-দৌলত দেখে সেই রাতে ভুলে ছিলাম। পরে সব বুঝে ভাবলাম পালাই! বাদ মাগরিব শহরের ফটক থেকে বেরুতে যাব, দেখলাম শাস্ত্রী। বলল, এই শহরের বাইরে যেতে পারবেন না, খলিফার হুকুম। আমি কেমন স্বাধীন, বুঝেছ বুসায়না? এই বান্দি বান্দা মুজরানী ইমারতের মধ্যে আমি স্বাধীন।

ক্রীতদাসের হাসি শুনতে চেয়েও না পাওয়ার অপমানে খলিফা তাতারীকে চূড়ান্ত অপমান করতে মেহেরজানকে সামনে নিয়ে আসেন। মেহেরজান এখন আর বাঁদী নয়, তার প্রেমিকাও নয়, খলিফার বেগম। তাকে দেখে তাতারীর এখন আর হাসি আসে না। একসময় মেহেরজানকে কক্ষ থেকে বের হওয়ার আদেশ দেন খলিফা, আর তখনই তাতারী মুখ খোলে। সে খলিফার নাম ধরে সম্বোধন করে। এতে খলিফা অপমানিত বোধ করেন এবং তাতারীকে চাবুক চালানোর আদেশ দেন। চাবুকের মার খেতে খেতেই তাতারী বলে, ‘শোনো, হারুন রশীদ। দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দি কেনা সম্ভব! কিন্তু-কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি- না-না-না-না’ এরই সাথে তাতারীর মৃত্যু ঘটে।

শওকত ওসমান রূপক অর্থে আইয়ুবের শাসনে নিষ্পেষিত জনতার দুঃখ-বেদনার কথা বলেছেন। জোর করে জনতাকে হাসানো যায় না। হাসাতে হলে অনেক উপাদান প্রয়োজন। সেতু, উড়াল সেতু কিংবা পাতাল সেতু দিয়ে মানুষের চোখে উন্নয়নের ঝাপসা লাগানো যায়, উন্নয়নের ঢেঁকুর তোলা যায়; কিন্তু স্বাধীনতাহীন মানুষের কণ্ঠ চেপে ধরে সুখে আছে বলানো যাবে না। দেশে নির্বাচন হচ্ছে ঠিকই তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নেই। পত্রিকা চলছে ঠিকই সেখানে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নেই। মানুষ খাচ্ছে ঠিকই সেই খাবারে পুষ্টি নেই। মানুষ বাজারে যাচ্ছে; কিন্তু বাজার করতে পারছে না। কারণ দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। তারপরও আমাদের সরকার বলে, সব কিছুর দাম কমানো হয়েছে, আর কত?

জনগণ সুখে নেই; কিন্তু সরকার চাইছে জনগণ বলুক আমরা সুখে আছি। ভাত-কাপড়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে যদি বলা হয় তুমি হাসো, সে কী করে হাসবে? অস্ত্র, ক্ষমতা আর শক্তি দেখিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়; তার স্বাধীন মনের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। সারা দুনিয়া বলছে, বাংলাদেশে কোনো ফেয়ার ইলেকশন হয় না, মানুষের মুক্তকণ্ঠকে চেপে ধরা হয়েছে, সাংবাদিকের স্বাধীনতা নেই, চার পাশে শুধু দুর্নীতি আর দুর্নীতি, আর সরকার বলছে সব কিছুই ঠিকমতো চলছে। কয়েকজন মন্ত্রীর বেসামাল কথাবার্তায় মনে হয় বাস্তবের চেয়ে আবেগ তাদের চেপে ধরেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না পেলে রাষ্ট্র গতি হারিয়ে ফেলবে। স্বাধীনতার মূল চেতনা গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা ধুলায় মিশে যাবে। আজকের বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। সরকার গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুললেও বাস্তবতা হলো- বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অধিকার ও স্বাধীনতার ক্ষয় এবং গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ ঠেকাতে সহায়তার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত ৯ ও ১০ ডিসেম্বরর ভার্চুয়াল সম্মেলনে ১১০টি আমন্ত্রিত গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই লজ্জার। কর্তৃত্ববাদের চাবুক মেরে জোর করে জনগণকে দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার পাচ্ছি বলানো যাবে না। বৈশ্বিক বিচারেও আমরা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছি না।

harun_980@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement