২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জংয়ের কলাম

বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে

- ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একবার হামিদ মীরকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকায় খেলা, একটি ক্রিকেট ম্যাচের কথা উলে­খ করেছিলেন। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ জিতলে সেই পুরনো স্মৃতি তাজা হয়ে ওঠে।

অনূর্ধ্ব-১৯ দলের টুর্নামেন্টের ফাইনাল। সম্ভবত শেষ ম্যাচ ছিল, যা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো একটি টিম ঢাকায় খেলছিল। আমার এ ম্যাচটির কথা মনে আছে, কারণ লাহোর বিভাগের টিমের ক্যাপ্টেন ওয়াসিম হাসান রাজা লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজে আমার সমসাময়িক ছিলেন। সে সময় অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটের মানও ছিল নিম্নপর্যায়ের। লাহোর বিভাগের টিম খুব সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের টিমকে হারিয়ে দেয়। ওই জয়ে কেউ অবাক হয়নি। কেননা ক্রিকেট পাকিস্তানের উভয় অংশে একই রকম জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ক্রিকেটের হেডকোয়ার্টার ও প্রশাসনের বাগডোর সর্বদা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে ছিল। ঢাকা ও চট্টগ্রামেও ক্রিকেট স্টেডিয়াম ছিল। অবশ্য বিস্ময়করভাবেই শুধু একবার ফাস্ট বোলার নিয়াজ আহমদ ১৯৬৭ সালের জাতীয় দলে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ওই খেলোয়াড়ও পৈতৃকসূত্রে বিহারি ছিলেন এবং পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তিনি করাচিতে থেকে যান। এখানে তিনি ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের জয়ে মনে পড়ল, বিগত ১১ বছরে পাকিস্তান নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কোনো টেস্ট ম্যাচ জেতেনি। গত বছরও আমরা সিরিজের দু’টি টেস্ট ম্যাচ হেরেছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ক্রিকেটসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ময়দানে বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা স্বীকার করতেই হবে।

যত দিন পূর্ব পাকিস্তান আমাদের সাথে ছিল, আমরা বাঙালিদের কোনো যোগ্যই ভাবতাম না। ১৯৬৭-৬৮ সময়ের ঋৎরবহফং ঘড়ঃ গধংঃবৎং গ্রন্থে চোখ বুলিয়ে জানা গেল, আইউব খান ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অধিনায়ক ছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা খুব কম। তবে এ পার্থক্য দূর করতে বাঙালিদের কাক্সিক্ষত যোগ্যতার অধিকারী বানাতে হবে।’ আইউব খান আর্মি চিফ হন। এরপর মার্শাল ল জারি করে ১০ বছর পাকিস্তান শাসন করেন। সম্ভবত ওই সময়ও তিনি সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত সংখ্যক বাঙালিদের যোগদানের যোগ্য বানাতে পারেননি। ১৯৬৫ সালে যখন যুদ্ধ হলো, তখন আমি হাসান আবদাল ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। যুদ্ধ চলাকালে আমাদের ইংরেজ প্রিন্সিপাল কর্নেল অব: জেডিএইচ চপম্যান ও অপর এক শিক্ষকের মাঝে কথাবার্তা শোনার সুযোগ হয়। উভয়ে এ বিষয় নিয়ে ভাবছিলেন যে, যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ করে, তা হলে ওই অঞ্চলকে কি রক্ষা করা সম্ভব হবে? ১৭ দিনের যুদ্ধ শেষ হলো। পূর্ব পাকিস্তান সুরক্ষিত থাকল। কিন্তু আমার মাথায় এ প্রশ্ন কিলবিল করতে থাকে। অনেক পরে জানা গেল যে, পাকিস্তানের সামরিক কৌশল হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নিযুক্ত সেনাবাহিনীর ক্ষমতার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছিল।

ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন হওয়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি ছিল এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার গঠনের ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল। এই অপছন্দীয় সম্ভাবনাকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সরকার ব্যবস্থাপনার ধরনটাও এমন হলো যে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সব চিফ সেক্রেটারি পাঠানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আর কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সেক্রেটারি কর্মকর্তা পদের জন্য বাঙালিদের অযোগ্য ভাবা হয়েছে। রাজনৈতিক ময়দানেও যখন বেইনসাফির ধারা দীর্ঘ হতে লাগল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিহত করা হয়। আমাদের এ পরির্বতন পছন্দ হয়নি। শেরে বাংলা মৌলভী ফজলুল হক, যিনি লাহোরে গণসমাবেশে ২৩ মার্চ, ১৯৪০ সালে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে আবারো গভর্নর জেনারেলের পূর্ণ নেতৃত্বে সোপর্দ করে দেয়া হলো। সাবেক ব্যুরোক্র্যাট আলতাফ গওহর, নওয়াব অব কালাবাগ আমির মুহাম্মদ খান আইউব খানের শাসনামলে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর, সরকারে শামিল ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে পাঞ্জাবের গভর্নর এক পত্রিকায় কলামে উলে­খ করেন যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তান গেলে, গোশত, সবজি এমনকি খাবারের পানিও লাহোর থেকে সাথে করে নিয়ে যেতেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ধর্মীয় উগ্রতার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতেও নিয়ন্ত্রণ এনেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে এবং বাকি ৪৬ শতাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এখন এই তুলনা উল্টা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ যে কার্যকৌশলের মাধ্যমে এ সফলতা অর্জন করেছে, তা আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য অনুসরণীয়। অর্থনৈতিক ময়দানেও বাংলাদেশ আমাদের অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও আয় আমাদের দ্বিগুণ। শিক্ষার হার ও শিক্ষার মানও তুলনার বাইরে। আর কী বলব? বাংলাদেশে (তেমন) কার্পাস তুলার চাষাবাদ হয় না, তার পরও তৈরী পোশাকের উৎপাদন আমাদের টেক্সটাইল এক্সপোর্টের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। বাংলাদেশ সরকার ও বস্ত্রশিল্পের সাথে যুক্ত সংগঠনগুলো যৌথ সহযোগিতায় ঘরোয়া নারীদের কাজ শেখাতে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা ৯০ শতাংশের বেশি। তারা কষ্টার্জিত আয়ের অর্থ নিজেদের পরিবারের উন্নয়নে ব্যবহার করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির উন্নতির জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় নেই। অথচ আমরা বাংলাদেশ থেকে কিছুই শিখব না। কারণ আমরা তাদের চেয়ে বেশি ‘বুদ্ধিমান’।

পূবর্ পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর অনেক গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে মেজর জেনারেল খাদেম হোসাইন রাজার সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ অ ঝঃৎধহমবৎ ওহ গু ঙহি ঈড়ঁহঃৎু এ দিক দিয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে, তিনি ঢাকায় আর্মি অ্যাকশনের সময় জিওসিতে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি সেনা হাইকমান্ড সম্পর্কে লিখেছেন, যা কিছু হয়েছে তার সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তবে ওই গ্রন্থে তার একটি বিশ্লেষণ বেশ লক্ষণীয়। তিনি লিখেছেন, বাঙালি তাদের ‘সোনার দেশ’-এর ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী যে, তারা স্বাধীনতার পর তাদের দেশ ও জীবনে মনোরম পরিবর্তন আনবে। কেননা তারা যে অঞ্চলে বসবাস করে, সেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা ছাড়া আর কোনো কিছুর আশা করা যায় না। আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন আমাকে এটি ভাবতে বাধ্য করছে, আমরা আর কত দিন পুরনো চিন্তাভাবনায় বন্দী থাকব?
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১১ জানুয়ারি,
২০২২ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
গ্যাটকো মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুন বুড়িচংয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ গলাচিপায় স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে ৩টি সংগঠনের নেতৃত্বে মানববন্ধন থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ছেলে হারা মা সাথিয়ার কান্না যেন থামছেই না বৃষ্টির জন্য নারায়ণগঞ্জে ইস্তিস্কার নামাজ আদায় প্রবাসী স্ত্রী থেকে প্রতারণার মাধ্যেমে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায়, ছাত্রলীগ নেতাকে শোকজ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ভোটারের তালিকা চান হাইকোর্ট আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরো ৪৬ বিজিপি সদস্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে কুপিয়ে হত্যা কক্সবাজারে ট্রেন লাইনচ্যুত, যোগাযোগ বন্ধ

সকল