২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হিন্দুত্ববাদের সাথে আইএস ও বোকোহারামের তুলনা

-

কংগ্রেস নেতা সালমান খুরশিদ বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেডের টার্গেটে রয়েছেন। তার ‘অপরাধ’ হচ্ছে, তিনি অযোধ্যা বিবাদের ওপর তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থে বোকোহারাম ও আইএসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদের তুলনা করেছেন। সম্প্রতি দিলি­তে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের হাতে তার ইংরেজি গ্রন্থ Sunrise Over Ayodhya (অযোধ্যায় সূর্যোদয়)-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। গ্রন্থটি পুরোপুরি বাজারে না আসতেই তা নিয়ে হই চই শুরু হয়ে গেছে। সাধারণত রাজনীতিবিদরা যে গ্রন্থগুলো লেখেন, তা নিয়ে একটা বিতর্ক তো থাকেই যা লেখক বা প্রকাশকের পক্ষ থেকে গ্রন্থের ভালো কাটতির জন্য জেনে বুঝে সৃষ্টি করা হয়। তবে এ বিতর্কটা মোটেও সে রকমের নয়। বরং এ গ্রন্থের একটি প্রাসঙ্গিক অংশ নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হচ্ছে। আর এতেই হঠাৎ গ্রন্থটির বিক্রি বেড়ে গেছে। বাহ্যত এর অর্থনৈতিক লাভটা লেখক ও প্রকাশক উভয়েই পাবেন। কিন্তু বেশ সম্ভাবনা রয়েছে যে, সালমান খুরশিদ ও তার দলকে এর রাজনৈতিক ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করা হবে এবং তাদের ‘হিন্দুবিরোধী’ অভিহিত করা হবে। এর ধারা শুরুও হয়ে গেছে। কেননা বিজেপি এই গ্রন্থের সূত্র ধরে সালমান খুরশিদের পাশাপাশি সোনিয়া গান্ধী, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেও লক্ষ্য বানিয়েছে। বিজেপির মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়ার বক্তব্য, ‘এটা শুধু সালমান খুরশিদের কথা নয়, বরং আজ এটাই কংগ্রেসের চিন্তাধারা। সোনিয়া, রাহুলের ইশারাতেই এমনটা বারবার হচ্ছে।’ এটা ভিন্ন বিষয় যে, সালমান খুরশিদ কংগ্রেস দলের ‘নমনীয় হিন্দুত্ববাদ’কেও তার গ্রন্থে টার্গেট করেছেন।

সালমান খুরশিদের গ্রন্থ প্রকাশ্যে আসার পর ওই মহলেই সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, যারা হিন্দুত্ববাদকেই ভারতের মুক্তির পথ মনে করে। এখানে আমরা আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি, হিন্দুত্ববাদের দর্শন সর্বপ্রথম আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকার তৈরি করেছেন। এর ভিত্তি হচ্ছে, ভারতের আসল ও বিশ্বস্ত অনুগত অধিবাসী তারাই, যাদের বাপ-দাদাদের জন্মভূমি ভারত এবং তারা সেই ধর্মের অনুসারী হবে, ভারত ভূখণ্ডে যার জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ গোলওয়ালকারের দৃষ্টিতে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরাই ভারতের আসল অধিবাসী; যারা ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী, দেশের প্রতি তাদের বিশ্বস্ততা সন্দেহযুক্ত। সালমান খুরশিদ তার গ্রন্থে হিন্দুত্ববাদের এই দর্শনের সমালোচনা করেছেন। তিনি হিন্দুত্ববাদের সূত্র ধরে তার গ্রন্থে এই বিষয়টার ওপর জোর দিয়েছেন যে, ‘সাধু সন্ত যে সনাতন ধর্ম ও ধ্র“পদী হিন্দুত্বের অনুসারী, তা সরিয়ে দিয়ে হিন্দুত্বের এমন এক ভার্সন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা আইএস ও বোকোহারামের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই এর ব্যবহার করা হচ্ছে।’

তিনি তার গ্রন্থে হিন্দুত্ববাদীর পাশাপাশি মুসলমান উগ্রপন্থীদেরও আলোচনা করেছেন, অথচ তার প্রতিক্রিয়া শুধু সেই মহলগুলোতেই হচ্ছে, যারা উগ্র হিন্দুত্ববাদীর পতাকা বাহক এবং যারা ভারতে সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকাকে ‘হারাম’ করে রেখেছে। ওই ব্রিগেডেরই অংশ মনে করা হয় এমন দু’জন, সুপ্রিম কোর্টের উকিল সালমান খুরশিদের বিরুদ্ধে যথারীতি দিলি­ পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।

সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে আমরা আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি যে, সালমান খুরশিদ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা হওয়ার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত উকিল। তিনি মরহুম প্রেসিডেন্ট ড. জাকির হোসেনের দৌহিত্র ও সাবেক গভর্নর মরহুম খুরশিদ আলম খাঁর পুত্র। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তাকে ভারতের শীর্ষ ১০ উকিলের একজন গণ্য করা হয়। তিনি কয়েকবার ইউপির ফররুখাবাদ আসন থেকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কংগ্রেসের শাসনামলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রীও হয়েছেন। অযোধ্য বিবাদের সাথে তার সম্পর্ক হচ্ছে, তিনি সুপ্রিম কোর্টে কয়েকবার এ মামলায় মুসলিম পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন। বাবরি মসজিদ পুনরুদ্ধারকরণ আন্দোলনের নেতা সৈয়দ শাহাবুদ্দীন, যিনি নিজেও সুপ্রিম কোর্টের উকিল ছিলেন, এ মামলায় সালমান খুরশিদের কাছ থেকে উপকৃত হন। এ হিসেবে অযোধ্যা বিবাদ সম্পর্কে তার এ গ্রন্থ গুরুত্বের দাবিদার, যা বেশ দেরিতে সবার সামনে এলো। এ গ্রন্থে বাবরি মসজিদ ও রামজন্মভূমি বিবাদ এবং তার ফলাফলের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি এ গ্রন্থে অযোধ্যা বিবাদের আইনি লড়াই এবং এ মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলোও যুক্ত করেছেন। সালমান খুরশিদ লিখেছেন, ‘অযোধ্যা বিবাদ মূলত অন্য ধর্মের বিশ্বাসের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করানোর জন্য দাঁড় করা হয়েছে। সেই সনাতন ধর্ম ও ধ্র“পদী হিন্দু ধর্ম, যা সন্ত ও বাবাদের তপস্যাকেন্দ্রিক, তাকে হিন্দুত্বের একটি শক্তিশালী ভার্সন কোণঠাসা করে দিয়েছে। হিন্দুত্বের এই শক্তিশালী ভার্সনকে রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য সেইভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেভাবে জিহাদি ইসলামী গ্র“প আইএস ও বোকোহারাম করেছে। উলে­খ করার মতো বিষয় হচ্ছে, সালমান খুরশিদ তার গ্রন্থে হিন্দুত্বের প্রশ্নে স্বয়ং তার দলের সেই সব নেতারও সমালোচনা করেছেন, যারা সেকুলারিজম থেকে সরে গেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের দলের ভেতরেও এমন একটি শ্রেণীর উত্থান ঘটছে, যারা এ বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে যে, দলের ইমেজ সংখ্যালঘুর সমর্থক হয়ে গেছে।’ তিনি লিখেছেন, “এই শ্রেণীটাই দলের নেতৃবৃন্দকে ‘পৈতাধারী’ হওয়ার পরামর্শ দেয়। আবার এই শ্রেণীই অযোধ্যা বিবাদ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেখানে বৃহৎ মন্দির নির্মাণের সমর্থন করেছিল এবং রাহুল গান্ধীকে ‘পৈতাধারী হিন্দু’ বলেছিল।” কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা গোলাম নবী আজাদ সালমান খুরশিদের অবস্থান নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে টুইট লিখেছেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুত্বের বিরোধিতা তো করি, কিন্তু আইএসের সাথে হিন্দুত্বের তুলনা করা সরাসরি ভ্রান্তি ও বাড়াবাড়ি।’

যখন বোকোহারাম বা আইএসের সাথে হিন্দুত্বের তুলনা নিয়ে কথা উঠেছে, তখন এ কথা সবাই জানেন যে, অযোধ্য বিবাদের আড়ালে হিন্দুত্ব সমর্থক শক্তিগুলো দেশে ভীতি-সন্ত্রাসের যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, তা সেই পরিবেশ থেকে ভিন্ন নয়, যা আইএস ও বোকোহারাম তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দ্বারা আরব বিশ্ব ও নাইজেরিয়াতে সৃষ্টি করেছে। যদি আপনি শুধু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথাই ধরেন, তাহলে চিন্তা করে দেখুন, কিভাবে মুষ্টিমেয় শক্তির জোরে পাঁচ শত বছরের প্রাচীন ইবাদতের স্থানকে সন্ত্রাসের মাধ্যমেও বর্বরোচিতভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর পুরো দেশে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার যে অনিঃশেষ ধারা শুরু হয়েছে, তার কবলে পড়ে হাজার হাজার নিরপরাধ নিষ্পাপ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মুসলমানদের। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, যারা দিনের উজ্জ্বল আলোয় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য বিদ্যমান ছিল, তাদের ‘সসম্মানে’ মুক্তি দেয়া হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও এর পরবর্তী দাঙ্গার কোনো একটা অপরাধীকেও আজ পর্যন্ত শাস্তি দেয়া হয়নি। এমনকি ১৯৯২-৯৩ সালে বোম্বাইয়ে ঘটিত ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ-দাঙ্গার কোনো এক অপরাধীকেও চূড়ান্ত শাস্তি পর্যন্ত পৌঁছানো হয়নি। অথচ ওই দাঙ্গার তদন্তকারী বিচারপতি শ্রী কৃষ্ণ তার প্রতিবেদনে অপরাধীদের চিহ্নিত করে সম্পূর্ণরূপে তাদের উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। সালমান খুরশিদ তার গ্রন্থে লিখেছেন, মহারাষ্ট্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বিচারপতি শ্রী কৃষ্ণ কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ওই সময় এ কথা বলে বিষয়টাকে শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, কিছু ক্ষত সময় অতিবাহিত হওয়ার পাশাপাশি আপনাআপনি শুকিয়ে যায়। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেডের তৎপরতা সম্পর্কে পুরো দেশবাসী জানে, কীভাবে এ দেশে সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকা হারাম করে দেয়া হয়েছে। যখন থেকে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তখন থেকে মুসলমানদের গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার ঘটনা ক্রমাগত হচ্ছে। তাদের কখনো ‘লাভ জিহাদ’, কখনো ‘ল্যান্ড জিহাদ’, আবার কখনো জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগে একের পর এক লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের মাঝে ভীতি ও ত্রাস সদা বিরাজমান। যারা এর বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইন দিয়ে ভয় দেখানো ও হুমকি প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে। সালমান খুরশিদ সেই চেষ্টার টাটকা শিকার।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১৪ নভেম্বর, ২০২১ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement